• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায়

প্রথম প্রেম 

লোকে বলে যার রূপ থাকে তার নাকি গুণ থাকে না, আবার যার  গুণ থাকে তার রূপ থাকে না৷ লোকে কেন যে এত অবাস্তব কথা বলে সেটাই বুঝে উঠতে  পারি না৷ লোকে আরও অনেক মিথ্যে কথা বলে৷ বলে সরস্বতী, লক্ষ্মী ঠাকুর পাশাপাশি থাকতে পারে না৷ এটা সব থেকে বড় মিথ্যে৷ এই মিথ্যে যারা বলে তাদের ফাঁসি দেওয়া উচিত৷ আরে বাবা সরস্বতীর কৃৃপা না থাকলে লক্ষ্মীর কপা আসবে কোথা থেকে৷ সরস্বতীকে ভাঙিয়েই তো লক্ষ্মী উপার্জন করা হয়৷
দাদু খুব শখ করেই নাম রেখেছিল তৃৃপ্তিসুধা৷ আমি জন্মানোর পর দাদুর মন তৃৃৃপ্তিতে ভরে উঠেছিল৷ তাই আমার নাম তৃৃৃৃপ্তিসুধা৷ যা সংক্ষেপে তিপুতে পরিণত হয়েছে৷ ঈশ্বর আমাকে গড়ার সময় রূপ,গুণ দুটো দিতেই ভুলে গিয়েছিলেন৷ বোধহয় সেই সময় স্বর্গ লোকে অসুর ঘটিত কোন সমস্যা চলছিল৷
যে দেবতা আমাকে গড়েছিলেন, তার মনের অবস্থা নিতান্তই খারাপ ছিল৷ তাই আমার উপর এই অবিচার করে ফেলেছিলেন তিনি৷খুব সাধারণ ভাবে মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই৷ মা চায় নি আবার কলেজে ভর্তি হই৷ তার কথানুযায়ী একটা পাশ হয়ে গেছে, এবার বিয়ে৷ যাই হোক, নিজের খেয়ালে একদিন কলেজে ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়লাম একটা ক্লাস রুমে৷ সেখানে মেয়েরা কিসের একটা রিহার্সাল করছিল,ভাবলাম নাটক৷ দুজন স্যার ছিলেন৷ ঢুকে পড়লাম তাদের অনুমতি নিয়ে৷ কি হচ্ছে জিজ্ঞাসা করতেই একজন বলল, ইউথ পার্লামেণ্ট ডিবেট৷ আমরা অংশ গ্রহণ করেছি৷ তুই করবি? কি জানি, সেদিন কি মতিভ্রম হয়েছিল! আমিও করবো বলে , নাচতে নাচতে স্যারের কাছে গিয়ে হাজির হলাম৷ স্যার অমনি নামটা লিখে দিলেন৷ দুটোর থেকে রিয়ারসেল৷ তখন প্রায় সব ক্লাস শেষ হয়ে যেত৷ আমরা ক-জন একাদশ শ্রেনীর ছাত্রী ছিলাম৷ শপথ নেওয়া৷ পার্লামেণ্টের নতুন সদস্য হিসাবে৷
অন্যদের সাথে আমাকেও একটা কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হল৷ সেটা পড়তে হবে সুন্দর করে৷ আমি কেমন পড়েছি, জানি না৷ তবে আমার পড়ার পর দেখলাম, মেয়েরা সব হেসে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে৷ আমি বোকার মত স্যার দের দিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ এন.ডি স্যার আমাকে দেখে টেবিলে রাখা এক গ্লাস জল শেষ করে ফেললেন৷ আর এ.ডি স্যার কি বললেন ঠিক করতে পারলেন না৷ মাথায় হাত রেখে বসেছিলেন৷ ভাগ্য ভাল এটা কলেজ, স্কুল নয়৷ তা না হলে দিদিদের একটা মারও মাটিতে পড়ত না৷ সেদিন থেকেই আমি ছিলাম বাতিলের দলে৷ তবু আমি যেতাম৷ খুব মজা হত৷একটা আড্ডা৷ বেশ ভাল লাগত৷ সবাই আমাকে নিয়ে খুব মজা করতো৷ আমিও বেশ উপভোগ করতাম৷ সবাই বলতো, সুদীপ্তা কে পড়তে দিন স্যার৷ আমি উঠে দাঁড়াতাম৷ অমনি স্যার থেকে শুরু করে সবাই হেসে লুটিয়ে পড়তো৷ আমিও বোকার মত হাসতে শুরু করতাম৷ এরপর একদিন এল সিরিয়াস ডিসিশন নেওয়ার সময়৷ আমি বাতিলের দলে জানতাম৷ যারা ওথ সুন্দর ভাবে পাঠ করেছিল,তাদের মধ্যে একটা মেয়ের আইসক্রীম খেয়ে গলা গেল খারাপ হয়ে৷ আর দুজন মন্ত্রি হবে বলে ঝাপ দিচ্ছিল৷ তারা ওথ পাঠ করবে না৷ তাদের কথানুযায়ী এটা একটা সামান্য রোল৷ পড়ে রইলাম আমি৷ এন. ডি স্যার এক সপ্তাহ সময় দিলেন৷খুব ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিলেন৷ কিভাবে পড়তে হবে৷ রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস করতে বলেছিলেন৷ গারগল করতে বলেছিলেন৷ করেছিলাম৷ খুব পরিশ্রম৷ ফাইনাল সিলেক্টের দিন৷ খুব ভয় করছিল৷ প্রিন্সিপ্যাল ম্যাম এসেছিলেন৷ আমি কোন কিছু না ভেবে কোন দিকে না তাকিয়ে ওথ পাঠ করেছিলাম৷ সেদিনও স্যার দের দিকে বোকার মত তাকিয়ে ছিলাম৷ সেদিন দেখলাম প্রিন্সিপ্যাল মেম সহ স্যার রাও হাত তালি দিয়ে উঠলেন৷ যে বন্ধুরা একদিন হেসে লুটিয়ে পড়েছিল, সেদিন তারাও হাত তালি দিয়েছিল৷ আমি শুধু কলেজ নয়,কলকাতার জন্য সিলেক্ট হলাম৷
কলকাতা৷ মা রাজি নয় পাঠাতে৷ আমি আর বাবা মিলে মাকে বোঝালাম, সেখানে সবাই মেয়ে৷ ছেলেদের টিকিটিও নেই৷ মা আমার তাই বুঝেছিল৷
এবার আসল কথাতে যাই৷ সেখানে ছেলেরাও ছিল৷ অন্য স্কুলের৷ প্রেসিডেন্সি,রামকৃষ্ণ মিশন ও অন্যান্য কলেজ৷ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রামকষ্ণ মিশনের ছাএ দের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো৷ অল্প পরিচয়েই তাদের মধ্যে একটি ছেলে আমাকে প্রপোজ করে বসল৷আমার অপরাধ, আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ আমাকে একটা আইসক্রিমের বল উপহার দিয়েছিল৷ বিনা প্রতিবাদে আমি বাড়ি ফিরে এলাম৷ তারপর দিন আবার সেই কলেজ৷ তখন আমি কলেজে৷ কেকা দি ছুটে এসে বলল, অনির্বাণ ফোন করেছিল৷ সে তোকে চিঠি দেবে বলেছে৷ আমি ভীতু৷ ভয় পেয়ে বললাম, আমার বাড়িতে যেন না আসে৷ মা,বাবা জানতে পারলে পড়া বন্ধ করে দেবে৷ তারপর সুন্দর চিঠি আসতো আমার কাছে৷ আমি কোন আপত্তি করি নি৷ আমাদের কলেজের এক মেয়ে সুপর্ণা দির মাধ্যমে৷ সুন্দর হাতের লেখা৷ অপূর্ব সেই চিঠি, মুগ্ধ হয়ে পড়তাম সারা রাত ধরে৷ একটি চিঠি একশো বারের বেশি পড়েছি৷ এখনো প্রতিটি শব্দ মাথায় গাঁথা আছে৷ সেই চিঠির মধ্যে ছিল, প্রেম, ভালবাসা, উৎসাহ৷ আমিও দিয়েছি চিঠি৷ ভয় পাই নি৷
এক দিন কলেজের এক গাছ তলায় বসে চিঠি পড়ছি৷ হঠাৎ কোথার থেকে আসা একটি মিষ্টি ফুলের গন্ধ আর এক ঝাঁক পাখি আমার চারপাশ টা ঘিরে দিল৷ তারা বলে গেল আমি প্রেমে পড়েছি৷
আমার জীবনে প্রথম প্রেম অনির্বাণ৷ হয়তো বা শেষ প্রেম৷ তারপর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধু তার কথাই ভেবে গেছি৷ সে হোস্টেলে থাকত৷ আমার সঙ্গে দেখা হয় নি৷ আমি তাকে ভাল চিনিও না৷ শুধু সুন্দর কিছু শব্দ জালে বন্দী হয়ে আমি তাকে ভালবেসে ফেললাম৷ সবসময় মনে মনে তার সঙ্গেই কথা বলতাম৷ নিজের মধ্যে একটা কল্পনার জগত তৈরি করলাম৷ আর তার মধ্যে ডুব দিলাম৷ কেউ বিশ্বাস করবে না, আমি কিছু সুন্দর চিঠি পড়েই তার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম৷ পত্র সাহিত্যের কি মহিমা!
ছ মাসের মধ্যেই আমি কল্পনা জগত থেকে ধাক্কা খেয়ে বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়লাম৷ ভেঙে গেল প্রেম৷ বাস্তবের শক্ত মাটি আমাকে পাগল করে দিল৷ খুব কান্না পেত৷ কোথার থেকে এত চোখে জল আসতো জানি না৷ ফোন নাম্বার ছিল৷ একদিন সাহস করে ফোন করলাম৷ আমি কেন প্রতারিত হলাম তার সঠিক উত্তর পেলাম না৷ বুঝতে পারলাম সে এড়িয়ে যাচ্ছে৷ তার এভাবে এড়িয়ে যাওয়া আমার সহ্য হচ্ছিল না৷ বুক ফেটে কান্না আসছিল৷ তবু ফোন করে গেছি৷ অনুরোধ৷ দয়া ভিক্ষে৷ যে যা মনে করবে৷
আমি অনির্বাণ কে ভালবাসি৷ ভাবতাম তাকে না পেলে আমি আর বাঁচবো না৷ সারা রাত কাঁদতাম৷ স্বপ্নে শুধু অনির্বাণ৷ অনির্বাণ আমার অনির্বাণ৷
এক দিন বুঝতে পারলাম,আমি আমার ভালবাসা হারিয়ে ফেলেছি৷ খুব কষ্ট হল৷ অভিমানে তার লেখা সুন্দর সুন্দর চিঠি ছিঁড়ে তাকে ফেরত দিলাম৷ তারপর সেই সুন্দর চিঠির দুঃখে নির্জন ক্লাস রুমে বসে কাঁদতে লাগলাম৷ যে গাছ তলায় বসে আমি চিঠি পড়তে পড়তে বুঝেছিলাম আমি প্রেমে পড়েছি৷ প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর সেই গাছ আমার অসহ্য লাগত৷ কলেজ যেতে ইচ্ছে করতো না৷কাঁদতে কাঁদতে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম৷ আমি অনির্বাণ কে দেখিনি৷ গাছ তলায় বসে প্রেম করিনি৷ শুধু সুন্দর চিঠি পড়ে আমার এই অবস্থা৷ সাধে লোকে কি আমায় বোকা বলে!
রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি৷ সামনেই পার্ক৷ এক ঝাঁক প্রেমিক-প্রেমিকা৷ জলে চোখ ঝাপসা হয়ে এল৷ হয়তো এখানেও অনির্বাণ আছে৷ শয়তান অনির্বাণ৷ বিশ্বাস ঘাতক অনির্বাণ৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।