নববর্ষের দুপুর। লকডাউন চলছে। আগের বছর এমন দিনের কথা মনে করে চোখে জল আসে কুসী’র। শহরে’র অভিজাত পাড়ায় বড়ঘরে বাঁধাকাজ। এই পয়লা বোশেখে কাজ সেরে ঘরে আসা’র সময় কত কি-ই দিত বৌদি, বেঁচে যাওয়া খাবার-দাবার, ফল-মূল, সেলে কেনা নতুন ছাপা কাপড় একখানা, একটা ক্যালেন্ডারও জুটে যেত, লক্ষীঠাকুরের ছবি দেওয়া! এ বছর কাজটাই আর নেই। ঘরে দু-দুটো বাচ্চা, কোলেরটা’র পুরো দু-বছর হয়নি এখনো। সারসপাখি’র ছানার মত হাঁ করে থাকে সবসময়, হা-ভাতে ঘরে অত খাবার কোথায়? এখন ভ্যানে করে দু-মানুষে সবজি বিক্রি করে পাড়ায়-পাড়ায়, সেই কোন সকালে বেরিয়ে বেলা গড়িয়ে ফেরা, দুটো-তিনটে বেজে যায়! তারপর রেঁধে-বেড়ে দুটো ভাত-জলের ব্যবস্থা। ওদের বাবা ফুটপাতে দোকান দিত, হোলির সিজনে রঙ, আবীর, পুজোর সময় বাজী, সস্তা’র টুনিবালবে’র চেন, দেওয়ালি- ধনতেরসে মাটির প্রদীপ এইসব। এখন তো সব বন্ধ, দোকান-পাটই খুলছে না, বাইরে বেরোলে পুলিশ ঠ্যাঙাচ্ছে ধরে।
চৈত্র-সেলে বেচবে বলে এক গাঁট ছোটদের জামাকাপড় কিনেছিল দুটো রোজগারের ধান্দায়, সে তো আর হলনা মাঝখান থেকে জমানো পয়সাটুকু চলে গেল। একটা ঘরে নিজেদের থাকার সংস্থান হয় না আবার তক্তাপোষের ওপর সেই গাঁঠরিখানা!
আজ কা’র যেন ছেলের মুখেভাত, সরকার থেকে বলছে ওসব অনুষ্ঠান নাকি করা যাবেনা, তাই মন্দিরে প্রসাদ খাইয়ে গরীব-দুঃখীদের দান-ধ্যান করছে কোন বড় বাড়ির বউ।ওমা এযে বউদি গো! তা হবে! কানাঘুষো শুনেছিল বটে! ঘটা করে মুখে ভাত দেবে ছেলের। তারপর কিসব রোগ-বালাই এলো দেশে… বউদি’র ফোন এসেছিল, বস্তি’র একটাই নম্বর আছে, সে আয়া’র কাজ করে, ডেকে দিয়েছিল। পড়িমরি করে ছুটেছিল কুসী ‘অ বউদি! কাজ’টা চলে গেলে খাব কি বলো? ‘
—’সরকার তোদের রেশন দেবে রে! দরকার হলে ডাকব আবার। ‘
ক’টা মলিন নোট হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়েছিল বউদি!
বউদি একটু বেশি করেই দিয়েছিল খাবার-দাবার, বচ্ছরকার দিন, দু’খানা সস্তা’র গেঞ্জি বার করে ছেলদের পরিয়ে খাবার-দাবার বাড়তে-করতে…
কত আওয়াজ বাইরে! এত হল্লা কিসের? ওদের বাবা’কে পুলিশ ধরেছে, সেই সকাল থেকে কুসী তো ওই মানুষটা’র সাথেই ঘুরেফিরে এলো, তবে? ঝড়ে-পড়া পাখির মত দুয়োর থেকে উড়ে আসে কুসী। “কি হল গো? কি করেছে ও “?
নির্বিকার উত্তর দেয় পুলিশ ” থানায় চলো, বাচ্চা-কাচ্চা সমেত “।
কাল দুপুরে ‘নিরাময়’ আপার্টমেন্টের যে বাড়িতে সবজি দিয়ে এসেছিল কুসী আর তার বর, সে বাড়িতে একজন করোনা পজিটিভ। ছোট ছেলেটা’র হাতে তখনো একটা আধখানা লুচি!
বুকের ভেতর’টা হঠাৎ খুব মোচড় দিয়ে ওঠে কুসী’র। মনে হয় ঘন দাম-ওয়ালা পুকুরে ডুবে যাচ্ছে ও, নিঃশ্বাস নিতে পারছে না!
“হ্যাঁ গো করোনা হলে কি এর থেকেও বেশি কষ্ট হয় ? “
অন্তরা দাঁ, পেশায় ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষিকা। লেখালিখি’র শুরু স্কুলে, ম্যাগাজিনের পাতায়।শখ, আবৃত্তি ও নাটক করা।গান শোনা, বই পড়া ও ভ্রমণ খুব প্রিয়। একমাত্র ছেলে, সবসময়ের সঙ্গী।