• Uncategorized
  • 0

অণুগল্প ১ বৈশাখের বিশেষ সংখ্যায় দেবব্রত রায়

বুটাস

সন্ধ্যার থেকেই গরম খিচুড়ির একটা  মৌতাত করা গন্ধ যেন কোথার থেকে ভেসে আসছিল। কৈলাশের পাহাড়ের চূড়ার মতো খাড়া নাকের ফোঁদলে গন্ধটা এসে ঢুকতেই , ওর নোলার জল  সকসক করে উঠলো। গন্ধ শুঁকেই যেন কৈলাশ বুঝতে পারলো এ-গন্ধ সাধারণ চালডালের খিচুড়ির গন্ধ নয়।  মনেমনেই ও আন্দাজ করে নিল খিচুড়ির ভিতরে নিশ্চয়ই অনেক কিছু মিশেল দেওয়া হয়েছে! গন্ধটা যতই গাঢ় হচ্ছিল কৈলাশের উসখুসুনি ভাবটাও যেন ততই বাড়ছিল। আজ সাত-আটদিন তারা শুধু কলমি সেদ্ধ আর, নুন-ভাত খেয়েই কাটাচ্ছে ! সেই কবে নীলু বাবু আর, কমল ঠাকুরের দল দু-কেজি করে চার কেজি চাল, আড়াইশো ডাল, দু-টো বাটি সাবান, দু-প্যাকেট মুড়ি ঘরে ঘরে দিয়ে গেছিল। কৈলাশের ন-জনের ফ্যামিলিতে সে-সব কবেই নস্যির মতো নাকের তলা দিয়ে উড়ে গেছে। রেশনটা আপাতত মাগনাই হলেও সেটাও মাসে একবার বৈ-তো নয়!কিন্তু, কৈলাশের ফ্যামিলিতে তাতেও কুলোই না ! আজকাল লেন্ডিগেন্ডিগুলোরই একেবারে রাক্ষস-খোক্কসের  খোরাকি লেগে যাচ্ছে  !
    সন্ধ্যেটা একটু গাঢ় হতেই , কৈলাশ বুঝতে পারলো নোলায় জল আনা গন্ধটা শুধু ওর একার নাকেই নয়, বস্তির সবার নাকেই সেঁদিয়েছে। বস্তির খুপরি ঘরগুলোর থেকে একে একে নিশিনাথ, ওর পরিবার, সুকুমার লদো হেবো জগাই ফড়িং যে-যার পরিবার আর, ছানাপোনাগুলো নিয়ে একেবারে এক পাল শুয়োরের মতো বাইরে বেরিয়ে এলো।
নিশিনাথের ছোট ছেলে গৌরাঙ্গ আজকাল কখনো নীলু বাবু, কখনো কমল ঠাকুরদের সঙ্গে মিশে একটু নেতা গোছের হয়ে উঠেছে। সে-ই আগ বাড়িয়ে বললো, নীলুবাবু, কমলবাবুরা আখন ক-দিন ইস্কুল-মাঠে খিচুড়ি খাওয়ানোর এক্কেবারে এ-কেলাস বেবস্তা করেচেন !
আরেকবার নোলার জল সুড়ুৎ করে টেনে কৈলাশ ওর পরিবারকে নিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে পা বাড়াল। পিছনে ভিন্ডুলটা। বড়ো রাস্তায় পা দিতেই কৈলাশের দুটো পা-ই যেন পিচে আটকে গেল। ওর একেবারে সামনাসামনি লালকমল দা দাঁড়িয়ে আছে। কৈলাশ থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে যেতেই  পিছনের ভিন্ডুলটা ওদেরকে পাশ কাটিয়ে স্কুল মাঠের দিকে এগিয়ে গেল। কৈলাশ আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো নিশিনাথও ভূতগ্রস্ত মানুষের  মতোই  মাথা নিচু করে ডান পা-টা টেনে টেনে দ্রুত অন্ধকারের মধ্যে  মিলিয়ে গেল। এই নিশিনাথ-ই এক সময় লালকমল দা-দের পার্টির খুব কাছের লোক ছিল। এখন একদমই বসে গেছে। লালকমল  কৈলাশের দিকে তাকিয়ে বললো, আজ তাহলে, তোমরাও বস্তিটা অন্ধকার রেখে মোমবাতি জ্বালালে !
তারপর, ফস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললো, ব্রুটাস, সব কটাই বেইমান!
কৈলাশ কোনোদিনই লালকমলদাদের উপর উচ্চবাচ্য করে কথা বলেনি কিন্তু, আজ হটাৎ-ই সে উষ্ণ গলায় বলে উঠলো, দেখ লালকমল দা, বস্তির একটা মুথাঘাসের জটাও আমার অচেনা লয়। উখানে বুটাস বলে কেউ থাকেনাই ! আর, বেইমান আমরা লই !  আজ ছ-সাত মাস আমাদের বস্তির লাইন নাই। আখুন প্রায় দিন-ই আমরা অন্ধকারে থাকি। গেলদিনে উয়ারা মোমবাতি দিয়ে আইচিল, ছানাপোনাগুলান সেগুলানই  ফুর্তি করে জ্বেলেচিল !
বউটা পিছন থেকে গুঁতো মাড়তেই খিচুড়ির গন্ধটা যেন কৈলাশের নাকে এসে আবার গোঁত্তা মারল। কৈলাশ একটু উসখুস করে বললো, লালকমল দাদা, আমরা তালে আখুন আসচি বটে !
লালকমল নিরবে হাসে। কৈলাশ ইস্কুল-মাঠে পৌঁছে দেখে পাতা পড়ে গেছে কিন্তু, তখনও খিচুড়ি দেয়নাই। দেরি হচ্ছে দেখে নীলুর ডানহাত  ছেনোকে ডেকে সে বললো, ছেনো দা, সবাই তো বসে গেছে, এবার পাতে পাতে দিয়ে দাও কেনে !
ছেনো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, গুরুদের মিটিং চলছে।
মিটিং শেষ না হলে পাতে লাপ্সি পড়বেক নাই !
মিটিন! কীসের মিটিন? কৈলাশ জিজ্ঞেস করে।
গুরু বলেছে, লালকমলদের পার্টির কাছ থেকে কোনো সাহায্য লেওয়া চলবেক নাই এমনকি, উয়াদেরকে পাড়ায় – বস্তিতে ঢুকতে দেওয়াও বারণ ! যারা রাজি হবেক তাদের পাতেই খিচুড়ি পড়বেক নইলে, ফুটুসফুট !
কৈলাশ দেখলো মিটিংয়ের ভিতর থেকে হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে এসে নিশিনাথের ছোট ব্যাটা গৌরাঙ্গ চিৎকার করে বললো, ছেনো দা,পাতে পাতে  খিচুড়ি দিয়ে দাও, মিটিন ছাকছেস!
কৈলাশ ভিড়ের মধ্যেই শালপাতাটা দলামচা করে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর, খাবার লাইন থেকে বেরিয়ে এসে হাতের পাতাটা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘেন্না ঘেন্না মুখ করে মাটিতে এক দলা থুথু ফেলে বলে উঠলো, শালা, বুটাস !
কথাটা বলে পিছন ফিরতেই কৈলাশ দেখলো ওর বউ নিঃশব্দে কখন যেন ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।