অন্য কথায় পিনাক বিশ্বাস

উপেনবাবুর উপন্যাস আবিষ্কার

বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদক কাম সাহিত্যিক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাগলপুরের বাড়িতে নিয়মিত আড্ডার আসর বসে। বাঙালি অধ্যুষিত ভাগলপুর আদালতের দুঁদে আইনজীবী তিনি, সেখানকার সাহিত্যরসিক আড্ডাবাজ বাঙালিদের ঠেক তার বাড়ি। সকলের অবারিত দ্বার, অনেককে তিনি চেনেনওনা।
এদের মধ্যে এক ভদ্রলোক, আধময়লা হেটো ধুতি, হাতে লাঠি আর লন্ঠন নিয়ে রোজই আসতেন গল্প শুনতে। পেছনে বসতেন, আড্ডা ভাঙলে চলে যেতেন, কেউ তাকে কথা বলতে শোনেনি কোনোদিন।
একদিন কালবৈশাখীর ঝড়ের চোটে আড্ডাবাজরা কেউ আসেননি, কিন্তু সেই অজানা লোকটি যথানিয়মে হাজির। উপেনবাবু তার সাথেই গল্প শুরু করলেন।
নাম ধাম জানার পর কথায় কথায় বোঝা গেল তিনি ছিলেন গ্রামের স্কুলের এক মাস্টারমশাই। চাকরি পোষালোনা, তাই সব ছেড়ে এখানেই এক জমিদারের সেরেস্তায় খাতা লেখেন।
স্বভাব লাজুক, চুপচাপ। পাঁচ মাইল দূরে হেঁটে কাজে যান, হাতে থাকে লাঠি, ভয়ডর কম।
সেন্ট জেভিয়ার্স ও প্রেসিডেন্সির তুখোড় ছাত্র উপেন্দ্রনাথ, বিদেশ বিভূঁইয়ে ক্রিমিন্যাল চরিয়ে খান। মানব চরিত্র তিনি ভালই বোঝেন সুতরাং এনার পেট থেকে বার করে ফেললেন কিছু গোপন কথা। শান্তশিষ্ট এই মানুষটির নির্জনে সাহিত্যচর্চার বাতিক আছে কিন্তু সাহস করে প্রকাশ করেননা।
এমনকি একটা উপন্যাসও নাকি লিখে ফেলেছেন!
উপন্যাস! চমৎকৃত উপেনবাবু জানতে চান “হাতে খড়ি হলোনা একেবারে উপন্যাস”?
– হাতে খড়ি মানে?
– মানে আগে কোথাও আপনার লেখা বেরিয়েছে? কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ?
– আজ্ঞে না
উপেনবাবু তাকে উৎসাহ দিয়ে বলেন লেখাটা যেন তিনি পরের দিন নিয়ে আসেন, পড়ে দেখতে চান।
কলকাতার সাহিত্যমহলের পরিচিত নাম উপেন গাঙ্গুলি দেখতে চেয়েছেন এর চেয়ে বড় কথা আর কি হতে পারে, ভদ্রলোক খুশি মনে বিদায় নিলেন।
পরের দিন জমিদারবাটি থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে পান্ডুলিপি নিয়ে হাজির।
উপেনবাবু সেটা নিলেন এবং কদিন পরে পড়ে দেখলেন এনার লেখার হাত ভারি চমৎকার।
তবে অগোছালো করে লেখা, না আছে পরিচ্ছেদ, না আছে তার হিসাব। টানা খাতা লেখার মত লিখে গেছেন। মাস দুই পরে কথাটা তিনি জানাতেই অজানা লেখক মশাই ঘাবড়ে গেলেন।
– তাহলে কি হবে?
– কি আর হবে? আমি ঠিকঠাক গুছিয়ে দেব, লেখাটা আমার পছন্দ হয়েছে। আগে কোথাও পাঠাননি?
– পাঠিয়েছিলাম, প্রবাসী পত্রিকায়, চাকরি ছেড়ে আসার দিন খোঁজ নিয়েছি। মনোনীত হয়নি।
শোনামাত্র হাসিখুশী মেজাজের সম্পাদক রীতিমত গম্ভীর। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন, বেশ এই উপন্যাস প্রকাশের ব্যবস্থা আমিই করব, আপনি ভাববেন না। নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি যান দিকি।
ভদ্রোলোকের মন ভিজে যায় কৃতজ্ঞতায়, সমঝদারের আশ্বাসে, ধুতির আঁচলে চোখের জল মুছে জানান আর যদি প্রকাশ নাও হয় দুঃখ রইলোনা
এর কয়েক মাস পরে ভাগলপুরের পাট চুকিয়ে কলকাতায় ফিরলেন উপেন্দ্রনাথ, নিজেই প্রকাশ করলেন বিচিত্রা পত্রিকা।
সাথে সাথেই সাড়া জাগালো বাংলা সাহিত্য মহলে, ব্যপক কাটতি। স্বাভাবিক, সম্পাদক তো যে সে ব্যক্তি নন। খরচাপাতি হল বিশাল।
বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেল মহানগর।
ওদিকে ভাগলপুরে বসে সেই ভদ্রলোক দিন গুনছেন, উপন্যাস কি তার পাবলিশ হলো।
চিঠি লিখতেও বাধো বাধো ঠেকে যদি সম্পাদক বিরক্ত হন। অগত্যা একদিন ছুটি নিয়ে নিজেই হাজির হলেন কলকাতায়।
বিচিত্রার অফিসে সেদিন তর্কের তুফান উঠেছে, বিষয় সাহিত্যে শ্লীলতা অশ্লীলতা…
একধারে কেবল জজসাহেব-সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রুফ দেখে চলেছেন।
হঠাৎ দরজার ওপারে দেখা দিলেন এক ভদ্রোলোক, আধময়লা ধুতি, পাঞ্জাবির জায়গায় জায়গায় রিফু করা, জুতো ধুলোয় ভর্তি। হাতে আবার চটের থলি।
ভেতর থেকে কে তাচ্ছিল্যভরে জানতে চাইল
– কি চাই? এজেন্ট? দশ কপির বেশি দিতে পারবনা, খুব ডিমান্ড, ওই কোনার লোকটিকে টাকা জমা করুন
– আজ্ঞে আমি এজেন্ট নই
– তবে কি লেখক? কবিতা লিখেছেন? ওই কোনার ভদ্রলোককেই জমা দিন নাম ঠিকানা সহ।
– আজ্ঞে আমি কবিও নই লেখকও নই, এসেছি সম্পাদকের সাথে দেখা করতে।
– উপেনবাবু তো এখনো আসেননি, যা বলার ওই কোনার লোকটিকেই বলে যেতে পারেন।
এমন সময় ঘরে ঢুকলেন উপেনবাবু, এসেই জড়িয়ে ধরলেন আগন্তুককে।
ভাগলপুরের কুশল বিনিময় সাঙ্গ হলে জানালেন আগামী সংখ্যা থেকেই বেরোতে চলেছে তার উপন্যাস। এবার ঘরে উপবিষ্ট সকলে মনোযোগ দিলেন আগন্তকের দিকে, আচ্ছা ইনিই তিনি।
যার লেখা বেরতে চলেছে…
অদ্ভুত সুন্দর লেখার হাত, বড়ই দরদী, মানবিক তার উপন্যাস!
পরের মাস থেকে বেরতে লাগলো সেই বহু প্রতীক্ষিত উপন্যাস। তোলপাড় বাংলার সাহিত্যবোদ্ধা তথা পাঠকমহল।
কে এই নতুন লেখক? কলকাতার সাহিত্যজগতে তো এনার নাম শোনেনি কেউ!
এর কিছুকাল পরে শনিবারের চিঠির স্বনামধন্য সজনীকান্ত দাস নিজে এসে দেখা করবেন লেখকের সাথে, বলবেন এ উপন্যাস বই আকারে আমিই প্রথম ছাপাতে চাই। হাতে গুঁজে দেবেন নব্বই টাকা।
লেখক বলবেন নব্বই টাকা? সে যে অনেক।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে যে উপন্যাস ওই আগন্তুক লিখেছিলেন, নিশ্চিত করে বলা যায় আগামী একশো বছর, কিংবা যতদিন বাংলা ভাষা টিকে থাকবে পাঠক মনে রাখবে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ট উপন্যাস পথের পাঁচালীকে। তার স্রষ্টা, মানবদরদী কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
পুনশ্চ :
উপেন্দ্রনাথ বিচিত্রার পরে গল্পভারতী সম্পাদনা করেছেন, লিখেছেন বহু গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ। সম্পাদক থাকাকালীন তার জহুরী চোখ খুঁজে পায় সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
উত্তমকুমার অভিনীত ছদ্মবেশী বা অমিতাভ বচ্চনের চুপকে চুপকে সিনেমার গল্পটা তারই লেখা। সম্পর্কে তিনি আরেক অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের মামা।
কিন্তু এসওওব ছাড়িয়ে তাকে একটি…
স্রেফ একটি কারণের জন্যেই মনে রাখা যায়, তিনি পথের পাঁচালী আবিষ্কার করেছিলেন।
তথ্যসূত্র:
১) সম্পাদকের বৈঠক – সাগরময় ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স
২) বিভূতিভূষণের লেখক হওয়ার গল্প – সাইফুর রহমান, বাংলাদেশ প্রতিদিন
৩) কলেজ স্ট্রীটে সত্তর বছর (দ্বিতীয় খন্ড) – সবিতেন্দ্রনাথ রায়
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।