“আংটি” ধারাবাহিক বড়ো গল্পে নীলাঞ্জনা (রীনা দাস)

পর্ব – ২

সাত
আবার এক রাতে টলতে টলতে ডিনার টেবিলে এসে বসে শ্রীমতী। খেতে খেতে মুখ তোলে সোমেশ। খানিকটা করুণা মেশান দুঃখ ছাড়া আর কোন অনুভুতি নেই তার, শ্রীমতীর জন্যে।
: আবার ড্রিংক করছ?
: হ্যাঁ। যেমন আবার তুমি খেলছ।
স্খলিত কণ্ঠে বলে শ্রীমতী।
: মানে?
: অ্যালবামটা চলল না, না গো?
: আমি চেষ্টা করে ছিলাম। দারুণ চেষ্টা করে ছিলাম।
: সত্যিই তো। দারুণ চেষ্টা করেছিলে। মরিশাসের সমুদ্রে, শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে, রাজস্থানের মরুভূমিতে, তানিয়ার শরীরে।
: কি যা তা বলছ!
: ঠিকই বলছি। তোমার সব এক্সট্রা কারিকুলার লাফালাফির খবর আমি জানি। তানিয়া, ডোনা, মলি আর এখন ওই ইলা।
হাতের ওপর মাথা দিয়ে টেবিলের ওপরে প্রায় আধশোয়া হয়ে হাসে শ্রীমতী। হাসে, কারন এই অ্যাঙ্গেল থেকে সোমেশের মুখটা কেমন অদ্ভুত লাগছে।
ভীষণ চমকে ওঠে সোমেশ।
: এ সব তোমায় কে বলল?
: কে আবার বলবে। যে সব সময় তোমাকে ছায়ার মত ফলো করে, সেই বলেছে। ছায়ার মত কেন? তুমি তো ছায়াই, হিহিহি। তাই না অভী?
কথার শেষটা সোমেশকে ফুঁড়ে পেছনে আর কাউকে দেখে বলল শ্রী। সোমেশের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। চমকে পেছন ফেরে। কই কেউ তো নেই!
: তোমার নেশা হয়ে গেছে। শুতে যাও।
: তোমারও তো নেশা সোম। টাকার নেশা। আর কত মানি ল্যণ্ডারিং করবে স্বপ্নের প্রোজেক্টকে দিয়ে।
: শোন শ্রী, এসব….
: ভাল লাগছে না শুনতে, তাই তো? কি করব বল। তোমার প্রত্যেকটা ব্যবসার কত কালো টাকা এখানে খাটছে, প্রতিটা ট্র্যানজ্যাকশন জানি যে। অভী সব বলে আমায়।
সোমেশের চোয়াল শক্ত হয়। চাপা স্বরে হিসিয়ে ওঠে,
: শাট আপ!
: ইউ শাট আপ এণ্ড লিসন্ টু মি! অ্যালবামটা আমার। গান গুলো আমার। আমি কাউকে ও গান গাইতে দেব না। ইলাকে নিয়ে তোমার নোংরা খেলা আমি খেলতে দেব না।
আবার চমকায় সোমেশ। শ্রীমতীর কাছে অভীরূপের গান গুলো পেয়ে, প্রথমেই তার কপি রাইট নিয়ে নিয়েছিল স্বপ্নের প্রোজেক্টের নামে। ইলাকে দেখার, তার গান শোনার পরে, একটা অলস চিন্তা ক্রমশঃ দানা বেঁধেছিল মাথায়। ওই গান গুলো ফের যদি গায় ইলা। একটা সফল মিউজিক ভিডিও। কথা বলে প্রোডাকশনের লোকেদের সঙ্গে। সবাই এক বাক্যে রাজী হয়। তারপর একটু একটু করে আজ প্রায় তৈরী ভিডিওটা, কুয়াশা যখন। সামান্য কিছু এডিটিং এর কাজ বাকি আছে। হয়ে যাবে তাড়াতাড়িই। ইচ্ছে আছে স্বপ্নের প্রোজেক্টের জন্মদিনে লঞ্চ করবে সোমেশ ‘কুয়াশা যখন’। আর এখন কি না শ্রীমতী……। সোমেশের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে।
: ভুলে যেও না শ্রী, আমি সোমেশ রায়। পথের কাঁটাদের সরিয়ে দিতে আমার একটুও হাত কাঁপে না!
: সে তো জানিই। যেমন কাঁপে নি অভীকে সরিয়ে দিতে। তা কি করবে তুমি? আমাকেও অভীর মত ফেলে দেবে ব্যালকনি থেকে? সুবিধেই হবে। কষ্ট করে আর মদ ঢালতে হবে না গায়ে। আমি এমনিতেই প্রচ্চুর টেনে থাকি।
পাগলের মত হাসতে থাকে শ্রীমতী। সোমেশের কথা আটকে গেছিল। অবাকও হয়েছিল। এটা শ্রী জানল কি করে? যেন মনের কথা বুঝেই শ্রীমতী বলে ওঠে,
: আর একটু ক্লাস আশা করেছিল অভী। তোমার সুপারী কিলার কিনা শেষে অভীর গায়ে চুল্লু ঢেলে দিল, মাতাল দেখাবার জন্যে। ছ্যাঃ! বড় কিপটে লোকটা, বুঝলে অভী!
ফের শেষটা বলে সোমেশের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে, ঢঙ ঢঙ করে। ফের চমকে পেছন ফেরে সোমেশ। তারপর উঠে দাঁড়ায় টেবিল থেকে। রাগে তার মুখ লাল হয়ে গেছে। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না শ্রীমতীকে। গটগট করে চলে গেল। পেছনে শ্রীমতী তখন হেসে লুটোচ্ছে টেবিলে। কান্নার চেয়েও যেন করুণ সে হাসি। এক সময় টলতে টলতে ঘরে ঢোকে শ্রী। একরাশ অন্ধকারটাও ঘরে ঢোকে তার সঙ্গে, তাকে ঘিরে।
আট
বেশ খানিকটা তরল পানীয় গলায় ঢালার পর স্নায়ু গুলো ঠাণ্ডা হয় সোমেশের। গ্লাসের অবশিষ্ট সোনালী তরলের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তা করতে থাকে সে। নাহ্, শ্রীমতীর জন্যে নিজের বিপন্নতা ছাড়া আর কোন অনুভুতি নেই এখন। বাঁচতে হলে ওকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কবে, কখন, কি ভাবে? চিন্তা করতে থাকে। হ্যাঁ অবশ্যই অ্যাকসিডেন্ট। এবং শ্রীর অ্যালকোহলিজমকেই কাজে লাগিয়ে। অবশেষে একটা আইডিয়া আসে। একটা পরিকল্পনা আস্তে আস্তে রূপ নিতে থাকে। যদি স্বপ্নের প্রোজেক্টের অ্যানিভার্সারীর দিনই ঘটে ঘটনাটা, কেমন হয়? প্রোপাগাণ্ডা, কি বিশাল প্রোপাগাণ্ডা হবে ‘কুয়াশা যখন’ এর! একটা নিষ্ঠুর হাসি ফুটে ওঠে সোমেশের ঠোঁটে। গ্লাসটা রেখে ফোনটা তুলে নেয় সে। একটা নম্বর ডায়াল করে। এ নম্বর কোথাও লেখা নেই। আছে শুধু তার মাথায়। মাঝেমাঝে দরকার মত ডায়াল করে। টেণ্ডার থেকে বাজোরিয়াকে সরাতে করেছিল। সার্কেল ইন্সপেক্টর সুদীপ চ্যাটার্জী, কানা হালিম, ডিসুজা, একদা সেক্রেটারী টিনা, সন্তান সম্ভবা তানিয়া, এরকম কতজনের জন্যে কতবার। আর হ্যাঁ, অবশ্যই অভীরূপের জন্যে।
: হ্যালো?
: হ্যালো, আমি বলছি।
: বলুন বস্।
: কাজ আছে। পুরনো জায়গায় দেখা কর। কাল দুপুর একটায়।
: ওক্কে!
ফোনটা নামিয়ে রাখে সোমেশ।
নয়
অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল এক বিখ্যাত পাঁচতারা হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে। অতিথি অভ্যাগতদের এবং সোমেশের জন্যেও কিছু ঘর বুক করা হয়েছিল এই হোটেলেরই বিভিন্ন তলায়। সোমেশের ঘর ছ’তলায়। মিঃ এণ্ড মিসেস রায়ের নামে বুক করেছে তাঁর সেক্রেটারী। বাড়িতে যদিও আলাদা ঘরে শোয় তারা, এখানে আলাদা ঘর নেয় নি সোমেশ। গসিপ ট্যাবলয়েড গুলো মুখিয়ে থাকে। এমনিতেই শ্রীমতীর পানাসক্তি নিয়ে অনেক রকম লেখে। আলাদা ঘর নিয়েছে জানলে আবার মুখরোচক লেখায় ছেয়ে যাবে। তাই একটাই ঘর। ছ’তলার দুনম্বর ঘরটা সোমেশদের। শ্রীমতীকে পাঁজাকোলা করেই লিফ্ট থেকে বেরিয়ে এল সোমেশ। সোজা হেঁটে গেল দুনম্বরের দরজায়। তারপর নামাল শ্রীমতীকে। দাঁড়াতে পারছিল না শ্রী। তাকে বাঁহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলল সোমেশ। তারপর ফের শ্রীমতীকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। পা দিয়ে দরজার পাল্লাটা ঠেলে আস্তে করে চাপ দিতে ক্লিক করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। খাটের কাছে গিয়ে খুব সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দিল শ্রীমতীকে। বিড়বিড় করে অসংলগ্ন অবোধ্য কিছু বলছিল শ্রী। হঠাৎ দুটো দূর্বল হাতে গলা জড়িয়ে ধরল সোমেশের। হাত দুটো ধীরে ধীরে ছাড়িয়ে বিছানায় রেখে দিল সোমেশ। একটু কি মায়া হল? নাহ্। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, সাইড টেবিল থেকে রিমোটটা তুলে এসিটা চালিয়ে দিল। ঘুমোক শ্রীমতী। তারপর ব্যালকনির দিকের দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। রাতের আলোকোজ্জ্বল শহর পায়ের কাছে ছড়িয়ে রয়েছে। সেদিকে এক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকল সোমেশ। ফের ঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। বিছানায় পুতুলের মত শুয়ে ঘুমোচ্ছে শ্রীমতী। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পুরনো বাতিল পুতুল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে কল করল নিচে পার্টিতে তার ইভেন্ট ম্যানেজারকে। রিং হতে হতে ঘরের দরজা খুলে করিডোরে বেরিয়ে এসে দরজা লক করল। তারপর কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল লিফটের দিকে। বোতাম টিপতে যাচ্ছে, লিফটটা উঠে এল ছ’তলায়। দরজা খুলে উর্দি পরা দুজন রুম সার্ভিসের লোক কাচা ধপধপে তোয়ালের পাহাড় নিয়ে বেরিয়ে এল। প্রথম জন পুরুষ। পিছনের জন মহিলা। তার আর এক হাতে একটা ভ্যাকুয়াম ক্লীনার টানতে টানতে আসছে। দুজনে করিডোর ধরে হেঁটে গিয়ে পাঁচ নম্বর ঘরে ঢুকে গেল। লিফটে ঢুকে নির্দিষ্ট বোতাম টিপল সোমেশ। দরজা বন্ধ হয়ে, লিফট নেমে গেল। ঘরে ঢোকা থেকে বেরোনো পর্যন্ত সোমেশের সময় লেগেছিল তিন মিনিট বেয়াল্লিশ সেকেণ্ড। পরে করিডোরের সিসি টিভি ফুটেজ থেকে জানা গেছিল।
হলে এসে দেখল, পার্টি জমজমাট। ভীড়ের মধ্যে এদিক ওদিক খুঁজতেই চোখে পড়ল, বুফেতে খাবার নিচ্ছে মিসেস ঘোষ, শ্রীমতীর পার্সোনাল অ্যাটেণ্ড্যাট। দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল। সোমেশকে আসতে দেখে খাবার ভর্তি প্লেট নামিয়ে রাখতে যাচ্ছিল মিসেস ঘোষ। ইঙ্গিতে তাকে বারণ করল সোমেশ।
: না না, আপনি খেয়ে নিন। শ্রীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসেছি। গভীর ঘুম ঘুমোচ্ছে। খেয়ে দেয়ে ধীরে সুস্থে যাবেন।
বলে ঘরের চাবিটা এগিয়ে দেয়। মিসেস ঘোষ চাবিটা নিয়ে হাতব্যাগের মধ্যে রাখেন। সোমেশ এগিয়ে যায় অতিথিদের দিকে।
দশ
পাঁচ নম্বর ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দেয় তারা। হাতের তোয়ালে গুলো নামিয়ে রেখে, মহিলাটি ভ্যাকুয়াম ক্লীনারটা প্লাগে লাগিয়ে চালু করে। লোকটিও তোয়ালে গুলো নামিয়ে রাখল। তারপর হোটেলের নীল সাদা উর্দিটা খুলে ফেলল। ভেতরে কালো গেঞ্জি আর প্যান্ট। পায়ে রবার সোলের কালো জুতো। একজোড়া কালো দস্তানা পকেট থেকে বের করে পরে নিল। তারপর দ্রুত ব্যালকনিতে গিয়ে রেলিং টপকে প্যারাপেটের ওপরে নামল। একবার কেউ দেখছে কি না দুপাশটা দেখে নিয়ে, বেড়ালের মত এগোতে লাগল। লক্ষ্য দুনম্বর ঘরের ব্যালকনি। এত উঁচু থেকে পড়ে গেলে ছাতু হয়ে যেতে হবে। কিন্তু দেয়ালের সঙ্গে মিশে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল, দেখে বোঝাই যায়, পাক্কা প্রফেশনাল। দুনম্বর ঘরের ব্যালকনিতে এসে রেলিং টপকে উঠে এল সে। তারপর খুব সাবধানে, খুব আস্তে ভেজানো দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। নাইট ল্যাম্পের আলোয় দেখল, বিছানায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে শ্রীমতী। অ্যাটাচড্ বাথরুমের দরজা খুলল লোকটা। বিশাল বাথরুম। ভেতরে বেসিন, কমোড, শাওয়ার স্টল আর একপাশে বাথটব। তাক থেকে বাথসল্টের প্যাকেটটা নিয়ে কিছুটা ঢেলে দিল বাথটবে। জলের কলটা খুলে দিয়ে ঘরে ফিরে এল। লিকার ক্যাবিনেট থেকে শ্রীমতীর প্রিয় ব্র্যাণ্ডের একটা বোতল আর পেগ বের করে আনল। পেগে অনেকটা মদ ঢেলে, সেটাকে রেখে এল বাথটবের পাশের তাকে। বোতল থেকে খানিকটা ঢেলে দিল সাইড টেবিলের কিনারায়। কিছুটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। বোতলটা টেবিলে রেখে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। ঝুঁকে, যত্ন করে খুলে নিল শ্রীমতীর জামাকাপড়, অন্তর্বাস। ঘরের মধ্যে এলোমেলো ছুঁড়ে ফেলল সেগুলোকে। শ্রীমতীর নগ্ন শরীরটা তুলে নিল দুহাতে। একটা হাত ঝুলে পড়ে গেছিল পাশে। সাবধানে সেটাকে গুছিয়ে তুলে নিয়ে ফিরে এল বাথরুমে। বাথটব প্রায় ভর্তি হয়ে এসেছে। আস্তে আস্তে শ্রীমতীর শরীরটা নামিয়ে দিল সেই ফেনিল জলের মধ্যে। কলটা বন্ধ করল। জলের ছোঁয়ায় শ্রীমতীর বোধহয় একটু জ্ঞান ফিরে আসছিল। মাথার তলায় হাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে, পানীয় ভর্তি পেগটা তার ঠোঁটে ধরল লোকটা। চোখ বুঁজেই দুয়েক চুমুক খেল শ্রীমতী। আবার বেহুঁশ হয়ে গেল। পেগটা রেখে, মাথাটা নামিয়ে দিল লোকটা। দস্তানা খুলে রেখে, কাঁধ ঠেলে জলের তলায় ডুবিয়ে দিল শ্রীমতীকে। দম বন্ধ হয়ে আসতে ছটপট করে উঠল শ্রীমতী। কিন্তু লোকটা ওর মাথাটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল জলের তলায়। একটু বাতাসের জন্যে হাঁ করে, জল গিলতে লাগল শ্রীমতী। অবশ শরীর লড়াই করতে পারছিল না। হাল ছেড়ে দিল। পা দুটো একটু দাপাল। তারপর নিথর হয়ে গেল শরীরটা। জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে, গলার কাছে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দেখে নিশ্চিন্ত হল লোকটা। সব শেষ। এবার শ্রীমতীর ডান হাতটা জলের বাইরে বের করে বাথটবের কিনারায় ঝুলিয়ে দিল। দস্তানা পরে নিয়ে, পেগটা ধরিয়ে দিল শ্রীমতীর মুঠোয়। তারপর ফেলে দিল মাটিতে। কাঁচ ভেঙ্গে মদ ছড়িয়ে পড়ল। খুব সাবধানে, গড়ানো তরল না মাড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। দরজা টেনে বন্ধ করে, ফিরে গেল ব্যালকনিতে। আগের পথে আগের মতই ফিরে গেল পাঁচ নম্বর ঘরে। মহিলাটি ভ্যাকুয়াম ক্লীনার অফ করে দিল। লোকটাও উর্দি পরে নিল। দুজনে মিলে তোয়ালে গুলো বুকের সামনে তুলে নিয়ে, বেরিয়ে এসে দরজা লক করে গিয়ে দাঁড়াল লিফটের সামনে। বোতাম টিপে লিফট তুলে এনে ভেতরে ঢুকল দুজনে। বেসমেন্টের বোতাম টিপল লোকটা। দরজা বন্ধ হয়ে লিফট নেমে গেল। পুরোটায় সময় লেগেছিল সতেরো মিনিট। সেটাও জানা গেছিল সিসি টিভি ফুটেজ থেকে। যদিও তাদের মুখ দেখা যায় নি তোয়ালের পাহাড়ের আড়ালে, উর্দি দেখে চেনা গেছিল হোটেলের রুম সার্ভিসের লোক বলে।
মিনিট দুয়েক পরেই ছ’তলায় উঠে এল মিসেস ঘোষ।
এগারো
ঘরে ঢুকেই এলোমেলো ছড়ান ছিটোন জামাকাপড়, সাইড টেবিল থেকে মেঝেয় গড়িয়ে যাওয়া মদ আর খালি বিছানা প্রায় একই সঙ্গে চোখে পড়ল মিসেস ঘোষের।
: ফের মদ খেতে খেতে চান করতে গেছে। কোনদিন একটা বিপদ বাঁধাবে এবার।
আপন মনে গজগজ করতে করতে বাথরুমের দরজায় টোকা দেয়। কোন আওয়াজ নেই। ফের টোকা দেয় বার কয়েক। শেষে সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজাটা খোলে। মেঝে ভর্তি ভাঙ্গা কাঁচ, তরল পানীয় আর বাথটবের বাইরে বেরিয়ে ঝুলতে থাকা হাতটা দেখেই বুঝতে পারে, বিপদ ঘটে গেছে। মদ খেতে খেতে বেহুঁশ হয়ে তলিয়ে গেছে জলে। হাত থেকে পেগটা পড়ে চুরমার হয়েছে। একটু এগোতেই চোখে পড়ে জলের তলায় নিথর শ্রীমতীর শরীর। ভয়ে চীৎকার করে উঠে ছুটে যায় মিসেস ঘোষ। কোনমতে হিঁচড়ে জল থেকে মাথা আর কাঁধ অবধি টেনে বের করে আনে। এলিয়ে যাওয়া শরীরটা ছুঁতেই বুঝতে পারে সব শেষ। ভয়ে, দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ফোন করে সোমেশকে। বাথটবের মধ্যে আধবসা হয়ে, বিস্ফারিত দুটি দৃষ্টিহীন চোখে চেয়ে থাকে শ্রীমতী।
ফোনটা ধরে প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারে না সোমেশ। খানিক পরে বুঝতে পেরে চীৎকার করে ওঠে।
: মাই গড! সর্বনাশ হয়ে গেছে। প্লীজ সামবডি কল দি ডক্টর অ্যাণ্ড অ্যাম্বুলেন্স!
বলে লিফটের দিকে ছোটে। পেছনে পেছনে আরো অনেকে। ঝড়ের মত ঘরে ঢুকে বাথরুমের দরজায় গিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় সোমেশ। পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখে কেউ চেঁচিয়ে ওঠে, কেউবা হাহুতাশ করতে থাকে। কেউ একজন ফোন করে হোটেল ম্যানেজারকে। সবার পেছনে ঘরে ঢুকেছিল ইলা। ঢুকতেই তার চোখে পড়ল, সাইড টেবিলের পায়ের কাছে কি একটা ঝিকমিক করছে। কাছে গিয়ে চিনতে পারল হীরের আংটিটাকে। সেই লোকটা যখন শ্রীমতীকে তুলে নিচ্ছিল বিছানা থেকে, একটা হাত আচমকা ঝুলে গেছিল। ভীষণ রোগা হয়ে যাওয়া শ্রীর আঙ্গুল থেকে ঢিলে আংটিটা তখনই খুলে পড়ে যায়। ইলা এদিক ওদিক চেয়ে সকলের অলক্ষ্যে কুড়িয়ে নিয়ে জীনসের হিপপকেটে পোরে শ্রীমতীর আংটি। খেয়াল করে না, দু দুটো জমাট বাঁধা অন্ধকার, ঠিক তার পেছনেই।
হোটেলের ডাক্তার বাবু শ্রীমতীকে পরীক্ষা করে মৃত বলে ঘোষনা করেন। খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘর বাথরুম করিডোর পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। সেলিব্রিটি বলে কথা। বিভিন্ন নিউজ পেপার আর টিভি চ্যানেলের লোকেরাও হাজির। খবর ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মত। সকলের মুখে একটাই কথা, হত্যা না আত্মহত্যা।
পুলিশের ফোটোগ্রাফার বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ফোটো তোলে শ্রীমতীর। তারপর ডেডবডি চালান যায় মর্গে। বাকিরা ব্যস্ত ঘর আর বাথরুম থেকে এভিডেন্স সংগ্রহের কাজে। ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো, গড়িয়ে পড়া মদের স্যাম্পেল, শ্রীমতীর জামাকাপড়, বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া হাতের ছাপ, এইসব। এক সময় সব শেষ হয়। পুলিশ দরজা সীল করে দিয়ে চলে যায়।
নিচে লবিতে চুপ করে বসে ছিল সোমেশ। দুয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি অফিসারকে অনুরোধ করছিলেন পোস্ট মর্টেম না করে বডি ছেড়ে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু অফিসার রাজী হচ্ছিলেন না। তিনি এসে সোমেশকে বললেন,
: দেখুন মিঃ রায়, খুবই দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু আনন্যাচারাল ডেথ। পোস্ট মর্টেম তো করতেই হবে। বুঝতেই পারছেন, আইনের কাছে আমার হাত পা বাঁধা। তার ওপরে মিডিয়া একেবারে মাইক্রোস্কোপ নিয়ে বসে আছে।
: ঠিক আছে অফিসার। যা করার করবেন। তবে একটাই রিকোয়েস্ট, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বডি ছেড়ে দেবেন। শেষকাজ গুলো…….
বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কথা গুলো বলে চোখে রুমাল চেপে ধরে সোমেশ। চারদিকে ফ্ল্যাশ ঝলসে ওঠে। পরের দিনের প্রায় সব কাগজের পাতায় এই ছবিটাই বড় বড় করে ছাপা হয়েছিল। সব চ্যানেলের টিআরপি বাড়িয়ে দিয়েছিল এই ছবিটাই। কিন্তু রুমালের আড়ালে সোমেশের হাসিমুখ কোন ক্যামেরার চোখই ধরতে পারে নি।
বারো
ফার্ম হাউসের বারান্দায় বসে শীতল পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল সোমেশ। ভেতরে মাস্টার বেডরুমের বিছানায়, এসির শীতলতায়, ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত, তৃপ্ত ইলা তলিয়ে আছে অতল ঘুমে। অনেক দিন পরে একটা ছুটি মিলেছে সোমেশের। ফোন, ল্যাপটপ, কিছুই সঙ্গে আনেনি। কাউকে বলেও আসে নি কিছু। প্রচণ্ড খাটা খাটুনির পরে এই অজ্ঞাতবাসটা ভীষণ দরকার ছিল শরীরের ব্যাটারী রিচার্জ করার জন্যে। স্বপ্নের প্রোজেক্ট রেকর্ড বিজনেস করেছে। “কুয়াশা যখন” বাজারে হট কেকের মত বিকোচ্ছে। শ্রীমতীর মৃত্যুটাকে অ্যাকসিডেন্টাল ডেথ বাই ড্রাউনিং বলে ডিক্লেয়ার করেছিল পুলিশ। পোস্ট মর্টেমে পেটে অ্যালকোহল আর ফুসফুসে জল ছাড়া অ্যাবনর্মাল কিছুই পাওয়া যায় নি। দুয়েকটা ছোটখাটো প্রশ্ন চিহ্ন ছিল বটে, কিন্তু ওপর মহলের চাপে সে সব নিয়ে আর ঘাঁটেনি কেউ। শ্রীর মৃত্যু এক বিশাল প্রোপাগাণ্ডার কাজ করেছিল। এ ঘটনার পরে, যারা কেউ কোনদিন তার গান শোনে নি, তারাও তার এমপিথ্রী আর মিউজিক ভিডিওর অ্যালবাম কিনতে শুরু করে দিয়েছিল। ইলার সঙ্গে শ্রীর কমপেয়ার করছিল পাবলিক। হাহ্! পাবলিক! এত বড় হুজুগে বোধহয় আর কিছু হয় না। তবে এক দিক থেকে ভাল। তারাই তো লক্ষ্মী। একটা নিশ্চিন্ত সুখি মানুষের মত বসেছিল সোমেশ অন্ধকার বাগানের দিকে চেয়ে। পানীয়ের গ্লাসটা তুলে ধরল সেদিকে,
:- টু ইউ শ্রী, মাই বিলাভেড ওয়াইফ। নো নো। সরিইই। মাই বিলাভেড লেট ওয়াইফ শ্রীমতী রায়।
খিকখিক করে হেসে উঠে দাঁড়ায় সোমেশ। একটু নেশা হয়ে গেছে। গরমও লাগছে। চান করতে হবে। ঘরে এসে মিউজিক সিস্টেমটা আস্তে করে চালিয়ে দিয়ে নগ্ন হয় সোমেশ। তারপর বাথরুমে ঢোকে। ইলার সুরেলা গলা হার্ড রক মিউজিকের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে সারা বাড়িটায়,
না জানি কেনওওওও……
স্বপ্নের যত ঘরবাড়ি গুলো
ভেঙ্গে ভেঙ্গে হয়ে যায় সব ধুলো,
চেনা পথ আজ কোথায় হারাল,
না জানি কেনওওওও……
বৃষ্টির জল করে কারচুপি,
চোখের সঙ্গে ষড় চুপিচুপি,
বলছে এসো না দুজনে হারাই,
তোমার জন্যে দুহাত বাড়াই,
যত কথা ছিল থাক সব বাকি,
চল না পালাই দিয়ে আজ ফাঁকি,
চল না আজকে মৃত্যুকে নিয়ে করি লোফালুফি……
এখন আমাআআআর….
দুহাতে শূন্য নিয়ে বারবার
বুকে বাজে শুধু, শুধু হাহাকার,
চোখের তারায় ঘনায় আঁধার,
এখন আমাআআআর….
বাগানের অন্ধকার থেকে একটা টুকরো আলাদা হয়ে বারান্দায় উঠে এসে একটা অবয়ব ধরে। জমাট বাঁধা কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মত সেই আকৃতি দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে। ঘুরতে থাকে এ ঘর থেকে ও ঘরে। কিছু যেন খুঁজছে। কিছু যেন খুঁজে পেতেই হবে তাকে। অবশেষে একটা ঘরে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। পেয়েছে, খুঁজে পেয়েছে সে, যা সে খুঁজছিল। পায়ে পায়ে বিছানাটার দিকে এগিয়ে যায় সেই অন্ধকারটা।
বাথটবের সুগন্ধী ফেনিল জলে গলা অব্দি ডুবিয়ে শুয়ে ছিল সোমেশ চোখ বন্ধ করে। বাইরে অলস ভাবে ঝুলে থাকা হাতের মুঠোয় পাতিয়ালা পেগ। দুটি কোমল পেলব হাত আস্তে আস্তে তার গলা জড়িয়ে ধরল। চমকে চোখ খুলতেই নজরে পড়ল, সেই কোমল হাতের আঙ্গুলে ঝিলমিল করা আংটিটাকে। তারই উপহার দেওয়া কাতিয়েরের হীরের আংটি। শ্রীমতীর আংটি। ভয়ে চীৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল সোমেশ। কানের পাশে খিলখিল করে একটা কাঁচ ভাঙ্গা হাসি তাকে থামিয়ে দিল। এ হাসি তার চেনা। হাত দুটো জড়িয়ে ধরে মুখ ফেরাল সোমেশ। তারপর ইলার সিক্ত গোলাপী ঠোঁটের মধ্যে ডুবিয়ে দিল তার ভারী পুরুষালি ঠোঁট। শুষে নিতে থাকল তার অধর সুধা। দীর্ঘ সেই চুম্বনের শেষে, এক ঝটকায় নগ্ন ইলাকে টেনে নিয়ে এল বাথটবের ভেতরে, নিজের বুকের ওপরে। শরীরে শরীর মিশিয়ে, পরম আশ্লেষে ফের তার গলা জড়িয়ে ধরল ইলা। তারপর…… টেনে নামিয়ে আনল সোমেশকে জলের তলায়। মদের গ্লাস পড়ে ভেঙ্গে গেল টুকরো টুকরো হয়ে। দম আটকে আসছিল সোমেশের। ইলার হাতের বাঁধন ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু কি কঠিন সে বাঁধন। কি অবশ সোমেশের হাত দুটো। একটু বাতাসের জন্যে ছটপট করতে করতে, বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে দেখল সোমেশ, ইলার মুখে কি ক্রূর নৃশংস এক হাসি। এ কে? ইলা নাকি অন্য কেউ? শুনতে পায়, নাকি অচেতনতার মধ্যে উপলব্ধি করে, ইলা তীব্র কণ্ঠে গাইছে,
এখন আমাআআআর….
দুহাতে শূন্য নিয়ে বারবার
বুকে বাজে শুধু, শুধু হাহাকার,
চোখের তারায় ঘনায় আঁধার,
এখন আমাআআআর….
এ গলা তো ইলার নয়! এ তো শ্রীমতীর!
আস্তে আস্তে ইলার চোখের মণিদুটো ভরে গেল জমাট বাঁধা কালো অন্ধকারে। তারপর সোমেশের সারা পৃথিবীটাই ঢেকে গেল অন্ধকারে। নিথর হয়ে যেতে যেতে কানের কাছে শুনল, ফিসফিস করে বলছে, ইলা নয়, শ্রীমতী,
: গুড বাই সোমেশ। মাই বিলাভেড হাবি! নো নো। সরিইই। মাই বিলাভেড লেট হাবি, সোমেশ রায়।
জল থেকে এক সময় উঠে আসে ইলা। সোমেশের ডান হাতটা জলের বাইরে বের করে তার আঙ্গুলে পরিয়ে দেয় আংটিটা। তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিজের ঘরে গিয়ে পরে নেয় তার জামাকাপড়। একবারও পেছন না ফিরে, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পেরিয়ে যায় ঘর, পেরিয়ে যায় বারান্দা, পেরিয়ে যায় বাগান। ফার্ম হাউসের গেট পেরিয়ে ক্রমশঃ হারিয়ে যায় রাস্তার বাঁকে।
পেছনে পড়ে থাকে একটা নির্জন বাড়ির একটা নিঃঝুম বাথরুমে বাথটবের জলের তলায় পড়ে থাকা একটা নিথর শরীর। আর জল থেকে বেরিয়ে থাকা একটা হাতের আঙ্গুলে ঝিলমিল করতে থাকা একটা হীরের আংটি।

সমাপ্ত…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।