ঊনবিংশ শতাব্দী নিবছে বিংশ শতক প্রবেশের কড়া নাড়ছে দুর্নিবার বেগে, এমনই এক সন্ধিক্ষণে “কল্পনা” কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে প্রাচ্যের নারীকে রবীন্দ্রনাথ মিলিয়েছিলেন পাশ্চাত্যের সাথে। “পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর” পরিয়ে করে তুলেছিলেন বিশ্বের প্রেয়সী। “প্রিয়তম আমি তোমারে যে ভালোবেসেছি” এই ছিল কবির স্বীকারোক্তি। আবার ‘চৈতালী’ কাব্যে কবির উপলব্ধি “শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী/ পুরুষ গড়েছে তোমা সৌন্দর্য সঞ্চারি”। আরও বলছেন, “অর্ধেক মানবী তুমি, অর্ধেক কল্পনা”। পরবর্তীকালে তাঁরই দৃপ্ত ঘোষণা ছিল ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্যে “রজনীর নর্ম সহচরী যেন হয় দিবসের কর্ম সহচরী”।
আসলে রবীন্দ্রনাথ নারীকে এঁকেছেন ” আপন মনের মাধুরী মিশায়ে” হরেক রঙের মেলবন্ধন ঘটিয়ে। তাই তাঁর নারী চরিত্রসমূহ যেন রঙধনুর সপ্তবর্ণের সমাহার। ‘দেনাপাওনা’র নিরুপমা বলে, “আমি মি কেবল একটা টাকার থলি?” চিত্রাঙ্গদার দাপুটে দাবী “নহি দেবী নহি সামান্যা নারী”। তাঁর গল্পে নারী মুক্তির দরজা চিনেছে। এই নারীরা প্রথা বিরোধী অথচ পরম্পরায় সমৃদ্ধ। ‘গোরা’ উপন্যাসের সুচরিতা সর্বংসহা, সহৃদয়া আত্মনির্ভর ব্যক্তিত্ব, আবার ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এক ছকভাঙা প্রেমিকা যে প্রেম কে শেখায় উপাসনার গাম্ভীর্য, দেয় মুক্তির আশ্বাস। সে অনায়াসে বলে “মোর লাগি করিও না শোক, আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক…তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান, গ্রহণ করেছ যত ঋণী করেছ তত আমায়”.
এই নারীরা কেউ কাব্যে উপেক্ষিতা নয়, নয় কাব্যের অলঙ্কার মাত্রও, বরং উপন্যাসে বরাবর পিভোটাল অবস্থান অলঙ্কৃত করেন। চিরদিনই রবীন্দ্রনাথের নারীরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে আধুনিকতার মূর্ত প্রতীক। ‘স্ত্রীর পত্রে’র মৃণাল তার ‘মেজ বউ’ পরিচয় প্রত্যাখ্যান করে ” মাথার উপরে আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ”এর ভরসায়, অথবা ‘সমাপ্তী’র মৃন্ময়ী বালিকা থেকে যুবতীতে রূপান্তরের আত্মপোলব্ধি কিংবা ‘ল্যাবরেটরি’র সোহিনী, ‘মাল্যদান’এর ‘প্রফুল্লতার রসে পরিপূর্ণ’ পটল বা ‘হৈমন্তি’। লাস্যময়ী রাজনর্তকী ‘শ্যামা’ বজ্রসেনের শরীরী সৌন্দর্যে কামমোহিত হয়ে ভেসে যায় “প্রেমের জোয়ারে”। এখানে নারী নির্মম তার দয়িতকে পাবার লক্ষ্যে, ” বালক কিশোর উত্তীয়”র “ব্যর্থপ্রেমে” র “মত্ত অধীর”তা কে সে ব্যবহার করতেও পিছ পা হয় না। পাশাপাশি প্রতিবাদীনি অভিমানিনি ‘শাস্তি’র চন্দরা “স্বামীরাক্ষসের হাত হইতে” নিষ্কৃতি পেতে খুনের অপবাদ মাথায় তুলে নেয়। কিন্তু ‘রক্তকরবী’র নন্দিনী সম্পূর্ন অন্য এক নারী যে তার স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল, আক্ষরিক অর্থেই এক born free ব্যক্তিত্ব। যক্ষপুরিতে প্রাণের আবেগ ঢেলে মকররাজকে আলো পথের সন্ধান দিয়েছিল, রঞ্জনের ভালোবাসার রঙে রঞ্জিত, বিশু পাগলের সে ই ছিল “অগম পাড়ের দ্যুতি”। এরই সাথে পাওয়া যায় ভগবান বুদ্ধের আহবানে সাড়া দিয়ে নগরনটীর শ্রীমতিতে রূপান্তরের ঘটনা ‘নটীর পূজা’ নাটকে। সে প্রেমের অন্য এক সংজ্ঞা । প্রেম আর পূজার মধ্যে ফারাক যে অতি সূক্ষ্ম ‘গীতবিতানে’র কবিতাগুলি তার প্রামাণ্য দলিল। যে প্রেমের আবিলতায় ‘চন্ডালিকা’র প্রকৃতি মা কে বলে “পড় তুই সব চেয়ে নিষ্ঠুর মন্ত্র”, আবার পর মুহূর্তেই তার উত্তোরণ ঘটে, সে চিনে নেয় তার মানবী সত্ত্বা কে। সেই প্রেম ‘তাসের দেশে’র নিয়মের বেড়াজাল ভাঙে, টেক্কাকুমারী, হরতনীরা এক সুরে বলে “শুকনো গাঙে আসুক, জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক” আর এভাবেই বাঁধ ভাঙতে ভাঙতে রবি ঠাকুরের মেয়ে পেরিয়ে যায় যৌনতার প্রাচীর, “বহে মম শিরে শিরে কী দাহ কী প্রবাহ, চকিতে সর্ব দেহে ছুটে তড়িৎলতা”
এতৎ সত্তেও কবির আক্ষেপ ছিল সেই সময়ের সমাজব্যবস্থার প্রতি যা তিনি ‘সবলা’ কবিতায় ব্যক্ত করেছেন, ” নারী কে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিলে অধিকার, হে বিধাতা”.
যুগে যুগে নারীদের দিয়ে তিনি শ্লোগান তুলিয়েছেন “আমি নারী, আমি মহিয়সী, আমার সুরে সুর বেঁধেছে জ্যোৎস্না বীণায় নিদ্রাবিহীন শশী, আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা, মিথ্যা হত কাননে ফুল ফোটা”…