ভারতীয় ভাষান্তর: সমস্যা ও সম্ভাবনা

ভারত ভূখণ্ডের মানুষজন তীর্থ যাত্রায় কত দূর দূরান্তে যান। কেউ বৈষ্ণোদেবী তো কেউ আজমের শরীফ। যারা অত কষ্ট স্বীকার করতে চান না, তাঁদের ভারতদর্শনের জন্যে অন্যরকম এক তীর্থযাত্রা আছে। কত ভাষা  এ দেশে, কত সম্পন্ন সেই ভাষায় রচিত সাহিত্য। অনুবাদকরা সেই সব অজানা ভাষার রত্নরাজি খুঁজে এনে আমাদের হাতে তুলে না দিলে ভারতদর্শন অসম্ভব ছিল, আমরা জানতেই পারতাম না ঘরের কাছে যে আরশিনগর, তার পড়শিদের সুখদুঃখ, রীতি রেওয়াজ, উৎসব সংস্কৃতির খবর।
কিন্তু অনুবাদক যদি মন্দিরের পাণ্ডা হন, তবে দেবতার কাছে তিনি যে ভক্তকে খুব সহজেই পৌঁছে দেবেন, তা কিন্তু নয়। গর্ভগৃহে পৌঁছনর রাস্তাটি জটিল ও গহন। সোর্স ল্যাঙ্গোয়েজ থেকে টার্গেট ল্যাঙ্গোয়েজে পৌছঁনর এই যাত্রাটাকেই তো রাধার অভিসার বলেছেন প্রখ্যাত মালয়ালম কবি কে সচ্চিদানন্দন। মনে আছে, সাহিত্য অকাদেমিতে কর্মসূত্রে তাঁকে একবার নিয়ে যেতে হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ বিভাগে।  বাইরে তখন ঘোর বৃষ্টি পড়ছে।  আর সচ্চিদানন্দন বোঝাচ্ছেন নীল শাড়ি পরে রাধা চলেছেন কৃষ্ণের কাছে , পিছল পথ, ঘনঘোর বৃষ্টি, আকাশ চিরে চিরে  যাচ্ছে বিদ্যুতরেখা। সেই আলোয় পথ বুঝে বুঝে যাওয়া।  রাধা কৃষ্ণের কাছে  আদৌ পৌছঁতে পারবেন কিনা জানা নেই, কিন্তু তাঁর অভিসার অন্তহীন। এই হচ্ছে অনুবাদ। অনুবাদ নিয়ে দেশি বিদেশি তত্ত্ব কিছু কম শুনিনি, অনুবাদ কর্মশালাও প্রচুর করাতে হয়েছে, কিন্তু এমন সহজে অনুবাদের সারকথা মরমে প্রবেশ করেনি কখনো।
বরং বরাবর শুনে এসেছি অনুবাদ  বিশ্বাসঘাতক।  এর আরো এককাঠি ওপরে কট্টর নারী অবমাননাকর একটি কথা-  ‘ ভালো অনুবাদ হচ্ছে সুন্দরী নারীর মতো। যে যত সুন্দরী সে তত বিশ্বাসঘাতক।‘
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়  একবার বলেছিলেন   অনুবাদ শব্দটা তাঁর  পছন্দ নয়, কারণ তাতে অনেক কিছু বাদ যায়। তার থেকে তার ঢের পছন্দ তর্জমা। তাতে অনেক কিছু জমা থাকে!
ভাষান্তরের জমা খরচের হিসেব করতে গিয়ে হঠাৎ তাক থেকে প্রখ্যাত উর্দু কবি নিদা ফাজলীর  সাহিত্য অকাদেমিপ্রাপ্ত কাব্যগ্রন্থ ‘যেন হারানো কিছু’ পেড়ে ফেলি। অনুবাদক বিশিষ্ট উর্দু ও হিন্দি অনুবাদক অরুণা মুখোপাধ্যায়, প্রিয় অরুণাদি। এমন বর্ণময় চরিত্রের অনুবাদক কমই দেখেছি। বেনারসে বেড়ে ওঠা, থাকেন চন্দননগরে, বিয়েথা করেননি, একা থাকেন , সাজপোশাকে মেয়েলিপনার ছিঁটেফোটা নেই, নিজে ভালো লেখক , নেশা অনুবাদ আর বেড়ানো। পাতা উলটে দেখি অনুবাদকের ভূমিকায় কী লিখছেন অরুণাদি। আর ওমনি মেঘ না চাইতে জলের মতো  পেয়ে যাই অনুবাদককে কী অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
‘নিজে মৌলিক রচনাও করি বলেই বুঝি, অনুবাদ করা কত কঠিন। সত্যি বলতে কি, যথাযথ অনুবাদ হয় না, করা সম্ভব নয়। কারণ প্রত্যেকটি ভাষার নিজস্ব দেশজ, কালজ, সাংস্কৃতিক স্বাদ আলাদা। প্রত্যেকটি ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের, বিম্বের, প্রেক্ষিতের; প্রত্যেক লেখকের দৃষ্টিকোণ ও শৈলীর কিছু একান্ত নিজস্ব ব্যঞ্জনা, মূর্ছনা ( Shade and nuance) আছে যেটির সঙ্গে সম্যক পরিচয় না থাকলে অনুবাদের মাধ্যমে সেটির পরিপূর্ণ রস গ্রহণ করা যায় না। এই কথাটিই ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষ তাঁর ‘শ্যাডো লাইন্স’ উপন্যাসে বোঝাতে চেয়েছেন। বাঙালির ‘ইতুর’ আনন্দ আর পঞ্জাবির ‘বৈশাখী’ র উল্লাস- নিতান্তই আঞ্চলিক (topical) সংস্কৃতি। ‘আরন্যক’এর নিবিড় বন্য গন্ধ কিম্বা ওড়িয়া কবি জয়ন্ত মহাপাত্রর ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ ’রিলেশনশিপ’-এ বর্ণিত কলিঙ্গের  রক্তঝরা বীভৎসতার সাক্ষী ধৌলি নদীর চিত্র, অপর ভাষায় ফুটিয়ে তোলা কি যায়? হিন্দীর ‘নাচ না জানে আঙগন টেড়া’ ইংরেজিতে যদি আক্ষরিক অনুবাদ করা হয়, a bad workman quarrels with his tools’ না করে, কী হাস্যকর হবে সে প্রয়াস’
( অনুবাদিকার ভূমিকা/ নিদা ফাজলির উর্দু কাব্যগ্রন্থ যেন হারানো কিছু-র ভূমিকায় লিখেছেন অরুনা মুখোপাধ্যায়।  সাহিত্য অকাদেমি ২০০৭ সালে এটি বার করে। এই বইয়ের ভূমিকাটি ভারতীয় ভাষার অনুবাদকদের পক্ষে একটি অবশ্যপাঠ্য। আঞ্চলিক ভাষার অনুবাদের সমস্যাগুলির এত চমৎকার উদাহরণ তুলে তুলে আলোচনা আর তো চোখে পড়েনি। দু একটা নমুনা দেওয়া যাক।
মূলের মেজাজমর্জি
‘নিদা ফাজলী যাকে ‘বঞ্জারা মিজাজী’ বলেছেন, ভাষান্তরে আমি সেটিকে ‘বেদিয়া মেজাজ’  করেছি। বাংলায় ‘বেদে’ শব্দটির একটি নিজস্ব নিগূঢ় অর্থ আছে- দুর্দম ভ্রমণ পিয়াসি স্বাধীন সত্তাটিকে সমাজের প্রতিষ্টিত শৃংখলে বাঁধা যাবে না।
সলিকা শব্দটির ঠিক প্রতিশব্দ যদি নিয়ম হয়ও, তার বাংলা যোগ্যতা ইচ্ছে করেই করেছি।’
 আবার এই অনুবাদকই অন্য জায়গায় সলিকার বাংলা নিয়ম করেছেন- ‘দিন সলিকেসে সে উগা’ র তরজমা করেছেন ‘দিন নিজের নিয়মে আসে’ অর্থাৎ অনুবাদের প্রথম কথা হচ্ছে মূল পাঠের মেজাজ মরজি বোঝা, বাকি সব পরে।
আবার ফিরি আরও কিছু নমুনায়।
‘এই কাব্যগ্রন্থের নবম দোহার দ্বিতীয় পঙক্তি ‘শায়দ  তুঝমেঁ ন হো, তেরী জ্যায়সী বাত…’ হুবহু অনুবাদ না করে ‘চেয়েছি যেভাবে তোমাকে, পারনি দিতে হয়তো’ এভাবে লেখা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়েছে’ ‘আঁখ কা জাম লিখ, জুলফ কা বরসাত লিখো’ পঙক্তিটি অনুবাদক করেছেন ‘আঁকো চোখের নেশা মেঘ চূর্ণকেশে’ ‘আক্ষরিক অনুবাদ তাতে হয়নি, ভাবানুবাদ হয়েছে। ভাবানুবাদ করা অপরিহার্জ বলেই স্বাধীনতাটুকু নিতে হয়েছে।’
আর কবিতা বলেই কাব্যগুণ বজায় রাখা সবচেয়ে জরুরি। তাই ‘জিস্কে আগে মাদ যে, সারে বৈদ্য হাকম’ যা আক্ষরিক  অনুবাদে হয় – তার সামনে ফিকে হয়ে যায় সমস্ত বৈদ্য হাকিম, কিন্তু এই অকাব্যিক অনুবাদে মন সায় দেয়নি অনুবাদকের, তিনি করেছেন ‘ কোথায় লাগে তার কাছে বৈদ্য হাকিম?’
সাহিত্য অকাদেমিতে   ওড়িয়া কবি রমাকান্ত রথের  কবিতা অনুবাদের কর্মশালায় অনুবাদ সম্পাদক ছিলেন মণীন্দ্র গুপ্ত। তাঁর কথাগুলো সমান প্রণিধান যোগ্য।
‘আমাদের একটা প্রারম্ভিক সমস্যা দেখা দিল। অনুবাদকরা লিখতে চান সাবলীল বাংলা, সহায়করাও বিশ্বস্ত থাকতে চান মূলের কাছে- অনুবাদকদের তাঁরা মূল থেকে একচুল নড়তে দেবেন না। তাহলে আমাদের প্রথমেই চিনে নেওয়া দরকার রমাকান্তের নিজস্ব ভাষাটিকে- সে কি প্রাচীনগন্ধী, না কি তাজা মুখের ভাষা? ধ্রুপদী না কি গীতল?….. আমরা ঠিক করলাম আমরা ভাবানুবাদ করব না, স্বচ্ছ স্বাভাবিক বাংলাকেও ছাড়ব না। এই টানাপড়েনের ফল ভালোই হয়েছিল।’
বানান
সমস্যা বানান নিয়েও। ‘ উর্দু বানান উচ্চারণ অনুযায়ী। কতকগুলি ধ্বনি আমাদের উচ্চারণে দেবনাগরী ও দেবনাগরী-জাত ভারতীয় অন্যান্য ভাষাগুলির উচ্চারণে নেই বলেই বর্ণমালাতেও নেই। কিন্তু উর্দুতে সেগুলি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উচ্চারিত বলে বর্ণমালাতেও স্থান পেয়েছে।  যেমন জ-Z এর মতো যেটির উচ্চারণ। ক, খ, গ ও ফ – আরবি-ফারসি থেকে আসা এই বর্ণগুলির বলিষ্ঠ কণ্ঠনালি থেকে বহির্গত উচ্চারণ দেবনাগরী ব র্ণ্মালার ক,খ,গ ও ফ থেকে স ম্পূর্ণ ভিন্ন।’
এইরকম একটা সমস্যা হয়েছিল অরুণাচল প্রদেশের আও ভাষা থেকে কিছু লোকগল্প অনুবাদের সময়। আও ভাষার কতকগুলো উচ্চারণ বাংলায় নেই যে।
কী অনুবাদ করব, কেন অনুবাদ করব?
সম্প্রতি মূল মৈথিলী থেকে বন্ধু কবি অজিত আজাদের কবিতা বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে দুটি একটি কবিতার ক্ষেত্রে এই সমস্যা হল। ‘চম্পা ঋতুস্নান করোনা’ শীর্ষক কবিতায় মেয়েদের ঋতুকালীন নানান বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। অসাধারণ প্রতিবাদী কবিতাটি শেষ হচ্ছে এইভাবে ‘চম্পা, তুমি সব অনুষ্ঠানে হেগেমুতে দাও’। লেখার মেজাজ ধরে রাখার জন্যে আমি মূলের কোন পরিবর্তন করিনি, কিন্তু কবিতাটি ফেসবুকে পোস্ট করে দেখলাম অনেকেই ঠিক হজম করতে পারলেন না, বাঙালি পাঠকের শালীনতার ধারণায় কোথায় যেন আঘাত করল।  আবার কোন তুলনায় অনগ্রসর সমাজের রচিত সাহিত্য বাংলায় অনুবাদের সময় প্রাসঙ্গিকতা মাথায় রাখতে হয়। বাঙালি সমাজ যা ২০০ বছর আগে ফেলে এসেছে, সেই বিষয়ে লেখার বাংলা অনুবাদ কতটা পাঠকপ্রিয় হবে তা ভাবতে হয় বইকি।

হারানো লিপির খোঁজে

একদিন ঘন বর্ষার দুপুরে রামলাল বাজারে নেমে রজনীকান্ত দাস রোড ধরে হাঁটতে শুরু করি। মৈথিলী ভাষার প্রাইমার পাওয়া যেতে পারে বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক গৌরী সেনের কাছে, এই আশায়। গৌরীদি আমার কোলের ওপর একটা বই ফেলে খেতে গেলেন। আমি চমকে উঠি দেখে। এ তো বাংলা! গৌরীদি এসে বলেন, না এ মৈথিলী লিপি, এর নাম তিরহুতিয়া। এখন অবশ্য এ লিপি উঠে গেছে, দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয় মৈথিলী, তার পেছনে হিন্দী ভাষার আগ্রাসন রাজনীতির চেনা গল্প। আবার মণিপুরি অভিধানের কাজ করতে গিয়ে দেখেছি নব্বই অতিক্রান্ত কুঞ্জমোহন সিং ইম্ফল থেকে ফোন করে বলছেন দ্রুত অভিধান ছেপে ফেলতে। কারণ মণিপুরি লিপি বাংলা থেকে আবার পুরনো মৈতৈ-তে ফেরানো হবে, তার আগে ছাপা না হলে এ অভিধানের কোন তাৎপর্জ থাকবে না। কী যে আকুতি ছিল তাঁর স্বরে!। লিপিবদলের রাজনীতিও কিন্তু অনুবাদকের আরেক দুশিন্তার কারণ।

ভারতবন্ধন

বোড়ো গল্প অনুবাদ কর্মশালার অভিজ্ঞতা লিখছেন লেখক সুব্রত মুখোপাধ্যায়
‘একটি আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে কেমন করে যে গোটা প্রকৃতি উঠে আসে সে কথা এই অনুবাদ কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকতে থাকতে বারবার মনে হয়েছে। … কেবলই মনে হয় কোথা থেকে কেবলই যেন অচিন পাহাড় ও উপত্যকার ডাক শুনতে পাচ্ছি’
এই ডাক শোনার লোভেই বোধহয়, ভারতীয় ভাষার অনুবাদকরা বারবার ছুটে বেড়ান কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, অরুণাচল থেকে আজমের।  পামুক, মার্কেজ, কুন্দেরা লোলুপ বাঙালি পাঠক, যাঁরা হাইপার মেট্রোপিয়ায় ভুগে হাতের কাছে অমৃতা প্রীতম, বিজয়দান দেথা বা নগেন শইকিয়া বা  বশীরকে দেখতেই পাননা, তাঁরা কোন একদিন ভারততীর্থের প্রসাদ গ্রহণ করবেন এই আশায়।