• Uncategorized
  • 0

আন্তর্জাতিক রক্তদাতা দিবস

লিখেছেন – মৃদুল শ্রীমানী

আজ ১৪ জুন আন্তর্জাতিক রক্তদাতা দিবস। ২০০৪ সাল থেকে প্রতি বৎসর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু এর উদ‍্যোগে আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্ব সহকারে এই দিনটি প্রতিপালিত হয়।
আজ রক্তের এ বি ও গ্রুপ যিনি চিহ্নিত করেছিলেন, এবং আর‌এইচ ফ‍্যাকটর ধারণা করেছিলেন, সেই কার্ল ল‍্যাণ্ডস্টেইনার ( ১৪.০৬.১৯৬৮ – ২৬.০৬.১৯৪৩) এর  জন্মদিন।
করোনা সংকটের প্রেক্ষাপটে ইমিউনিটি বা অনাক্রম‍্যতা শব্দটি নিয়ে আলোচনা অত‍্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ভাইরাস, ব‍্যাকটিরিয়া, ছত্রাক, ও প্রোটোজোয়া বা পরজীবী আদ‍্যপ্রাণীর আক্রমণে শরীরে নানাবিধ অসুখ হয়। ম‍্যালেরিয়া ও আমাশয়ের জন‍্য দায়ী পরজীবী আদ‍্যপ্রাণী। যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ রোগের জন্য দায়ী ব‍্যাকটিরিয়া। চুলকানি, দাদ, হাজা, খোস পাঁচড়া ইত্যাদি ছত্রাক সংক্রমণ থেকে হয়। টাইফয়েড হয় ব‍্যাকটিরিয়ার কারণে। এই যে নানাবিধ অসুখ, যার কারণ, এইসব ব‍্যাকটিরিয়া, আদ‍্যপ্রাণী, ছত্রাক ও ভা‌ইরাস, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মানুষের শরীরের সুনির্দিষ্ট প্রতিরক্ষা পদ্ধতি রয়েছে। তার সংঘবদ্ধ নাম এক কথায় রক্ত, ও বিশেষত‌ঃ রক্তের শ্বেতকণিকা।
মানুষের রক্তে শ্বেতকণিকা ছাড়াও অন‍্য দুই কণিকা হল লোহিত কণিকা আর অনুচক্রিকা। মানুষের শ্বেতকণিকাতে নিউক্লিয়াস রয়েছে। শ্বেতকণিকা একটি বড়ো দলের নাম। দলের সদস্যরা হল নিউট্রোফিল, ইওসিনোফিল, বেসোফিল, লিম্ফোসাইট, মনোসাইট, এইসব। শ্বেতকণিকার মধ‍্যে নিউট্রোফিল এর পরিমাণ বেশি, প্রায় ৬০ – ৭০%। এরা ব‍্যাকটিরিয়া আর ছত্রাকের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ইওসিনোফিল লড়ে পরজীবী আদ‍্যপ্রাণীর বিরুদ্ধে। বেসোফিল সামলায় অ্যালার্জিকে, আর মনোসাইট বাইরের এইসব শত্রুর মৃতদেহ সৎকার করে।
 রক্ত জিনিসটা মানুষের কাছে আদিমতম সময় থেকে পরিচিত। রক্ত যে ভারি মূল‍্যবান, তা রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়দের মধ‍্যে হৃদ‍্যতা দিয়ে মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে। আবার বয়স হলে, রোগে ভুগলে রক্তের জোর কমে যায় বলেও মানুষের ধারণা। রক্তকে বেশি কার্যকর করে তুলতে পুষ্টিকর ও পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারের কথাও মানুষ জানত। কিন্তু মানুষ ও প্রাণীর শরীরের ভিতরে রক্ত কি করে চলে, ও কার ঠেলায় রক্ত চলে সেটা বলে দিয়েছেন উইলিয়াম হার্ভে ( ১.০৪.১৫৭৮ – ০৩.০৬.১৬৫৭) । ১৬২৮ সালে হার্ভে সাহেবের ডি মতু করডিস নামে ব‌ইটি প্রকাশিত হয়। ওতে উনি শিরা ও ধমনীর মধ‍্যে রক্ত বাহিত হয় বলেছেন। আর হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের ভূমিকার কথাও বলেন।
রক্ত বিস্তর কাজ করে। রক্ত মানব শরীরের কোশে কোশে অকসিজেন পাঠায়, আরো পাঠায় পুষ্টিকর খাবার। রক্ত কোশের বিপাকজাত পদার্থ টেনে বের করে আনে। রক্ততঞ্চন ঘটিয়ে জীবন বাঁচায়। হরমোন বহে নিয়ে যায়। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। রক্ত না চলাচল করলে মৃত্যু ঘটে। রক্তকে ঠেলে ঠেলে পাঠায় হৃৎপিণ্ড। আর ফুসফুস রক্তে বেশি অকসিজেন সমৃদ্ধ বাতাস মেশায় ও কম অকসিজেন থাকা বাতাস বের করে নেয়। তো রক্ত এভাবেই মানব শরীরে সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্ণবয়স্ক স্বাভাবিক মানবশরীরে প্রায় পাঁচ লিটার রক্ত থাকে।
প্রতি মিনিটে হৃৎপিণ্ড প্রায় ওই পরিমাণ রক্ত পাম্প করে। হৃৎপিণ্ডের কাজ সম্বন্ধে মানুষের কিছু কিছু ধারণা গড়ে উঠেছিল প্রাচীন কালেই।
আপনার হাতটা মুঠো করে দেখুন। মোটামুটি ওটাই আপনার হৃৎপিণ্ডের সাইজ। মিনিটে সে বাহাত্তর বার পাম্প করে চলেছে।
 আরিস্ততল বলেছিলেন হৃৎপিণ্ড রক্ত তৈরি করে। তিনি ঠিক বলেন নি। কিন্তু প্লেটো ও হিপোক্রিটাস তুলনায় বেশি ঠিক বললেন। এরাসিসট্রাটোস হৃৎপিণ্ডকে একটা পাম্প বলে চেনালেন। শিরা আর ধমনীর রক্ত যে দেখতে ও গুণমানে আলাদা সেটা গ‍্যালেন জানতেন। তিনি বলেছিলেন হৃৎপিণ্ড শরীরের উষ্ণতম যন্ত্র। তবু উইলিয়াম হার্ভে সমস্তটুকু গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলেন।
এর পরে জার্মান বিজ্ঞানী অটো ফ্রাঙ্ক, ইংরেজ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট স্টার্লিং হৃৎপিণ্ডের কাজ নিয়ে বিশদ আলোকপাত করেন। সুনাও তাওয়ারার থেকে ধারণা নিয়ে হৃৎপিণ্ডের বৈদ্যুতিক সংবেদন বিষয়ে অবগত করেন আর্থার কীথ আর মার্টিন ফ্ল‍্যাশ। এই ধারণা থেকে ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম যন্ত্র তৈরি করে উইলিয়াম এনথোভেন ১৯২৪ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
রক্তের অভাব যে প্রাণীর মৃত্যু ঘটাতে পারে তা মানুষ জানত। ১৬৬৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে রিচার্ড লোয়ার একটি কুকুরের থেকে যথেষ্ট রক্ত বের করে নিয়ে তার শরীরে অন‍্য একটি সুস্থ সবল কুকুরের রক্ত প্রবেশ করান। দেখা যায় প্রথম কুকুরটি সুস্থ রয়েছে।
 রয়‍্যাল সোসাইটির রবার্ট বয়েলের অনুরোধে তিনি ১৬৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর এই রক্ত সঞ্চালন করার অভিজ্ঞতা নিয়ে পুস্তক প্রকাশ করেন। ব‌ইটির নাম, ফিলজফিক‍্যাল ট্রানজাকশন। এরপর প্রাণী শরীর থেকে মানুষের শরীরে রক্ত সঞ্চালন করার চেষ্টা করেন ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের চিকিৎসক ডাঃ জাঁ ব‍্যাপটিস্ট দেনিস। পনেরো বৎসরের এক কিশোরকে তিনি ভেড়ার রক্ত দেন। এই প্রথম মানব শরীরে রক্ত সঞ্চালন। তারিখটা ছিল জুন ১৫, ১৬৬৭। ছেলেটি বেঁচে গিয়েছিল । কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় বহু মৃত‍্যু লক্ষ্য করে ১৬৬৮ সালে রয়‍্যাল সোসাইটি এসব নিষিদ্ধ করেন। ১৬৭০ সালে খ্রীস্টান ধর্মবিশ্বাসের ভরকেন্দ্র ভ‍্যাটিক‍্যান এই পদ্ধতির নিন্দা করেন। মানুষের শরীরে মানুষের রক্ত প্রথম প্রবেশ করিয়ে ছিলেন একজন ব্রিটিশ ধাত্রীবিদ ডাঃ জেমস ব্লানডেল। সেটা ১৮১৮ সাল।
এই সূত্রে আমরা আবার কার্ল ল‍্যাণ্ডস্টেইনারকে স্মরণ করব। তিনি রক্ত নিয়ে গভীর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এ বি ও এই তিন প্রধান রক্ত গ্রুপ চিহ্নিত করেন। সেটা ১৯০০ সাল। রক্তের গ্রুপ চিহ্নিত হ‌ওয়াতে রক্ত সঞ্চালন কাজে বিপদ অনেক কমে যায়। এজন্য ১৯৩০ সালে তিনি চিকিৎসাবিদ‍্যায় নোবেলজয়ী হন‍। ১৯৩৭ সালে তিনি সহযোগী আলেকজান্ডার সলোমন উইনার এর সাথে মিলে আর‌এইচ ফ‍্যাকটর আবিষ্কার করে রক্তদানের পদ্ধতির আরো বিকাশ ঘটান।
১৯০৭ সালে নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে ডাক্তার রুবেন অটোবার্গ তাঁর পদ্ধতিতে রক্ত সঞ্চালন করে সাফল্য অর্জন করেন। সেই প্রথম।
প্রথম প্রথম মানুষের শরীর থেকে অন‍্য মানুষের শরীরে সরাসরি রক্ত সঞ্চালন করা হত। ১৯০৬ সালে শল‍্য চিকিৎসা অধ‍্যাপক জর্জ ওয়াশিংটন ক্রিল ক্লীভল‍্যাণ্ডের সেন্ট অ্যালেক্সিস হসপিটালে সরাসরি রক্ত সঞ্চালন করেন।
ক্রমে সরাসরি রক্ত না দিয়ে রক্ত জমিয়ে রেখে তারপর দেওয়া হয়। বেলজিয়ামের চিকিৎসা বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট হুসেন ১৯১৪ সালের ২৭ মার্চ তারিখে এভাবে  রক্ত সঞ্চালন করেন। আর্জেন্টিনার লুই আগোতে ও এই রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ওঁরা সোডিয়াম সাইট্রেট দিয়ে রক্ত সংরক্ষণ করেছিলেন। রক্ত সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার হ‌ওয়াতে ব্লাড ব‍্যাঙ্ক তৈরি করা গেল। ১৯১৭ সালে আমেরিকার অস‌ওয়াল্ড হোপ রবার্টসন প্রথম ব্লাড ব‍্যাঙ্ক স্থাপনা করেন। ব্রিটিশ রেডক্রসের পার্সি অলিভার ১৯২১ সালে রক্তদাতাদের সংগঠিত করেন। হাসপাতালে প্রথম ব্লাড ব‍্যাঙ্ক তৈরি হয় চিকাগোর কুক কাউণ্টি হাসপাতালে। করলেন বার্ণার্ড ফানটুস। সেটা ১৯৩৭ সাল। মনে রাখতে হবে এই ১৯৩৭ এই আর‌এইচ ফ‍্যাকটর এর ধারণা এসে গেছে। ১৯৪০এ এডুইন কোহন রক্তের বিভিন্ন উপাদান আলাদা করে দেখাতে সমর্থ হন। ১৯৪৬ সালে লণ্ডনে জাতীয় ব্লাড ট্রানসফিউশন সার্ভিস গড়ে ওঠে। বর্তমানে ইন্টার ন‍্যাশনাল সোসাইটি অফ ব্লাড ট্রানসফিউশন ছত্রিশটি ব্লাডগ্রুপ সিস্টেমকে স্বীকার করে। আর ৩৪৬ রকম অ্যাণ্টিজেনকে স্বীকার করে।
রক্তদান সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সকল সুস্থ নাগরিকের সক্রিয়তা চাই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।