• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় মাহফুজা হিলালী

রবীন্দ্রনাথের ‘দেবযানী’: দেবতার বিরুদ্ধে একা মানব

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(১৯৬১-১৯৪১) নাটক লিখেছিলেন ছােটো-বড়াে মিলিয়ে সাতাত্তর(৭৭)টি। নাটকগুলাের কাহিনি বিচিত্র, বিচিত্র তাদের আঙ্গিক। তার চেয়েও বিচিত্র নাটকগুলাের বিভিন্ন চরিত্র। এই চরিত্রগুলাে বিশ্লেষণ করলে তাদের স্পষ্ট কয়েকটি ভাগ করা যায়। যেমন, সাধারণ গতানুগতিক চরিত্র, স্বাধীনচেতা থেকে বিদ্রোহী চরিত্র, তত্ত্বপ্রধান একমুখী চরিত্র, মাতৃপ্রধান চরিত্র, ধর্মের প্রতি সম্যকভাবে সমর্পিত চরিত্র, লােভী চরিত্র এবং এগুলাের বাইরে আরাে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কয়েকটি চরিত্র। এ প্রবন্ধে আলােচনা করবাে ‘দেবযানী’ চরিত্র। মানুষ একক এবং স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র পরিলক্ষিত হয় তার স্বভাবে এবং কর্মে। স্বভাব এবং কর্ম বিশ্লেষণে শনাক্ত করা যায় এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের পার্থক্য। দেবযানীর স্বভাব এবং কর্ম বর্তমান প্রবন্ধের আলােচ্য বিষয়। এবং এর মাধ্যমে দেখাবার চেষ্টা করবাে তার স্বাতন্ত্র্য।
যুগে যুগে সমাজ নারীকে তার নিজস্ব অধিকার থেকে দূরে রেখেছে- কখনাে সৌন্দর্যের প্রতীক বানিয়ে, কখনাে প্রেমের প্রতিমা বানিয়ে, কখনাে কোমলমতি অবলা বলে। এই বেড়াজালের মধ্য থেকেই কোনাে কোনাে নারী নিজের অস্তিত্ববােধকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, নিজের মানব-সত্তা, আমিত্ব সংগ্রাম করেছে। তারা চেষ্টা করেছেন উপমা, প্রেম, সৌন্দর্যের নামে দাসীর দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন জীবনযাপন করতে। আবার কেউ স্বাধীনতার প্রত্যাশী হয়েছেন, কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি। তাদের এ সংগ্রাম যতাে কমই হােক সমাজে তাদের অবদান অবহেলা করার মতাে নয়। রবীন্দ্রনাথের নাটকে নারীর এই স্বাধীনচেতা মনােভাব এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিদ্রোহ প্রকাশ পেয়েছে নানা মাত্রায়।
বিদায়-অভিশাপ নাটকে দেবানী একমাত্র নারী চরিত্র। সহস্রবর্ষের সাধনায় আচার্যের কাছে বিদ্যা লাভ করে কচ স্বর্গে যাচ্ছে। এই সহস্র বছর কচ যে দেবযানীর প্রেমেও সিক্ত হয়েছে, সে কথা উল্লেখ করছে না কচ। কিন্তু দেবযানী স্বর্গের দেবতা নয় মর্ত্যের মানুষ। তাই সে ভালােবাসা ভুলতে পারে না। কচকে জিজ্ঞাসা করে মনের ক্ষুদ্র কোণে যা কুশের অঙ্কুরসম ‘আর কিছু কামনা আছে কি-না। এটাই এ নাটকের প্রেক্ষাপট। এই প্রেক্ষাপটে দেবযানী নিজের প্রতি কচের ভালােবাসার কথা শােনার অভিপ্রায়ে বার বার প্রশ্ন করে। কিন্তু কচ এর আশানুরূপ উত্তর দেয় না। বরং বলে :
আজি পূর্ণ কৃতার্থ জীবন। কোনাে ঠাই
মাের মাঝে কোনাে দৈন্য কোনাে শূন্য নাই।
এ কথা শুনে দেবযানী কষ্ট পেয়েছে। এবং কচকে ব্যঙ্গ করে অন্তর্জালা মিটিয়েছে। প্রথমে চেষ্টা ছিল কচের মুখ দিয়ে প্রেমের কথা প্রকাশ করতে। এ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সে বলে :
তুমি সুখী ত্রিজগৎ মাঝে। (২খ,পৃ.৩০১)।
স্বর্গের দেবতাদের আবেগ নেই, দুঃখ নেই। তাই তারা মর্তে এসে মানুষকে দুঃখ দিয়ে যায় নির্লিপ্তভাবে। কচ স্বর্গে উপস্থিত হলে, স্বর্গে যখন আনন্দধ্বনি উঠবে, মনােহর সুরে মঙ্গলশঙ্খ বাজবে, সুরাঙ্গনাগণ কচের মাথায় পুষ্প বর্ষণ করবে, তখন দেবযানীর হৃদয় ধরায় লুটিত হবে। এখানে ঘটবে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা। দেবযানী এই কষ্ট সহ্য করতে পারে না। তার অন্তর বিদীর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু মুখে ব্যঙ্গ করে বলে :
যথাসাধ্য পূজিয়াছি দরিদ্ৰকুটিরে
যাহা ছিল দিয়ে। তাই বলে স্বর্গসুখ
কোথা পাব। (২খ,পৃ.৩০২)।
অর্থাৎ দেবযানী সর্বস্ব দিয়ে পূজা করেছে। কিন্তু স্বর্গসুখ দিতে পারেনি। এমনকি সুরললনার কোনাে অনিন্দিত মুখও নেই এখানে। এই অপরাধের ক্ষমা চায় দেবযানী। ভালােবাসার মানুষকে এর চেয়ে বড়াে ব্যঙ্গ বাংলাসাহিত্যে আছে কি-না আমার জানা নেই। তবে দেবযানী চরিত্রের অন্যতম প্রধান দিক হলাে- দুঃখ-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সে ভেঙে পড়েনি, অভিমানে বাক্যহীন-নির্লিপ্ত থাকেনি কিংবা আত্মহননের পথ বেছে নেয়নি। নানা কৌশলে সে চেষ্টা করেছে কচকে ফিরিয়ে নিজের কাছে রাখতে। সুন্দরী অরণ্যভূমি, পাখির কূজন, তরুরাজি, বটতল, দুগ্ধদায়িনী গাভী, কলস্বনা স্রোতস্বিনী বেনুমতী – এরা যারা কচের সেবা করেছে তাদের কথা বলেছে কচের সামনে। এদের সবার ঋণ উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে স্বীকার করে কচ কিন্তু একবারও দেবযানীর কথা বলে । অবশেষে নিরুপায় হয়ে দেবানী নিজের কথা বলে। কারণ সে নিজের প্রেমকে ব্যর্থ হতে দিতে চায় না। সে বলে :
হায় বন্ধু, এ প্রবাসে
আরাে কোনাে সহচরী ছিল তব পাশে,
পরগৃহবাস দুঃখ ভুলাবার তরে।
যত্ন তার ছিল মনে রাত্রিদিন ধরে-(২খ,পৃ.৩০৪)
এ কথার পর কচ জানায় চিরদিনের জন্য সে নাম গাঁথা হয়েছে।
দেবযানী-ই তার পিতাকে বলে পিতার কাছে কচের বিদ্যা শেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাে। দৈত্যরা ঈর্ষাভরে কচকে বধ করেছে দেবযানী দয়া করে প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিলাে। এসব কারণে কচ দেবযানীকে কৃতজ্ঞতা জানায়। কৃতজ্ঞতার কথায় দেবযানীর কষ্ট আরাে বেড়ে যায়। প্রেম-সুখ নয়? কৃতজ্ঞতা! এ কথায় তার নিজেকে অপমানিত মনে হয়। কারণ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে প্রয়ােজনের সম্পর্ক, আর সুখের সঙ্গে মনের আবেগের সম্পর্ক। কোনাে উপায় না পেয়ে দেবযানী সরাসরিই কচকে স্বর্গে ফিরে যেতে নিষেধ করে। মর্ত্যলােকেই দুজনে অভিনব স্বর্গলােক রচনা করতে চায়। এতােদিনের গড়ে ওঠা প্রেম তার কাছে অনেক বড়াে। একে কিছুতেই হেলায় হারাতে চায় না দেবযানী। তার যুক্তি হলাে জগতে শুধু বিদ্যার জন্যই দুঃখ সহে না, রমণীর জন্যও মহাতপ সহ্য করে পুরুষ। সমালােচকের ভাষায়- “প্রেমস্পর্ধায় দেবযানী এমন মহীয়সী হইয়া উঠিয়াছে যে, সে নিজেকে সঞ্জীবনীবিদ্যার প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে কচের সম্মুখে উপস্থাপিত করিয়াছে।” কিন্তু কচ প্রেমকে সেভাবে কামনা করে না। এ কথা শুনেও দেবযানী ভেঙে পড়েনি। কচের কাছে কৃত কর্মের কৈফিয়ত চায়- কেন অধ্যায়নশালা ছেড়ে বন বনান্তর খুঁজে ফুলের মালা গেঁথে এনে দিতাে তাকে, প্রভাতে গ্রন্থপাঠ রেখে শিশিরসিক্ত কুসুমরাশিতে করতাে পূজা, অপরাহে জলসেকের জন্য তুলে দিতাে জল, পালন করতাে দেবযানীর মৃগশিশুটিকে, স্বর্গের সঙ্গীত শুনাতাে। প্রশ্ন করে- তবে কি এ সব করেছে শুধু দেবযানীকে বশ করে তার পিতার কাছে বিদ্যা শেখার জন্য? এ কথার পর কচ স্বীকার করেছে নিজের প্রেমের কথা। বলেছে :
চিরতৃষ্ণা লেগে থাকে দগ্ধ প্রাণে মম
সর্বকার্য-মাঝে- তবু চলে যেতে হবে।
সুখশূন্য সেই স্বর্গধামে। (২খ,পৃ.৩০৯)।
কর্তব্যের কাছে কচের প্রেম পরাজয় স্বীকার করেছে। এ কর্তব্য স্বর্গের দেবতাদের প্রতি। তবে এ শুধু কর্তব্যই নয় কচের প্রাণের সার্থকতাও বটে। দেবযানীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের মর্যাদা না দিলে সেটা প্রতারণা। কচ এই প্রতারণা করতে উদ্যত হয়েছে। এ সময় স্পষ্টভাষী দেবযানী পরিষ্কারভাবে বলেছে- যদি এ সম্পর্ক স্বীকার করে নীড় বাধতে না পারে, তবে গড়ে তােলাই উচিত হয় নি।
সে বলে :
তুমি চলে যাবে স্বর্গলােকে
সগৌরবে, আপনার কর্তব্যপুলকে

আমার এ প্রতিহত নিষ্ফল জীবনে
কী রহিল, কিসের গৌরব? (২খ,পৃ.৩০৯)
অবশেষে অপমানে-দুঃখে-যন্ত্রণায়- রাগে দেবযানী কচকে অভিশাপ দেয় :
যে বিদ্যার তরে
মােরে কর অবহেলা, সে বিদ্যা তােমার
সম্পূর্ণ হবে না বশ – তুমি শুধু তার
ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভােগ;
শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়ােগ। (২খ,পৃ.৩০৯)
যুক্তির দিক দিয়ে দেবযানী কোনাে ভুল করে নি। নিজের প্রাপ্য বুঝে চেয়েছে। যুগে যুগে দেবতারা নিজের প্রয়ােজনের সময় নারীদের সঙ্গ লাভ করে সুখী হয়েছেন। এরপর প্রয়ােজন ফুরিয়ে গেলে সেই নারীকেই দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেছেন নিজের কাজে। ফিরে দেখেননি মেয়েটির কী হলাে। কৃষ্ণও রাধাকে রেখে চলে গেছেন, অথচ একদিন রাধাকে পাওয়ার জন্য নিজেই উপযাজক হয়ে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। দেবতাদের সেই প্রতারণা প্রথার বিরুদ্ধে দেবযানী বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করেছে। দেবযানীর নারীজীবনের অভিনবত্ব এবং সার্থকতা এখানেই। দেবযানীর কাছে প্রেম মহৎ এবং দুর্লভ। সে বলেছে:
হায়।
বিদ্যাই দুর্লভ শুধু, প্রেম কি হেথায়
এতই সুলভ? (২খ,পৃ.৩০৭)
প্রেমের আবেগকে সে আড়াল করতে বা শেষ করতে চায় নি। অকপটে সরাসরিভাবে এর আবেদন জানিয়েছে। এক্ষেত্রে চরিত্রটি সর্বাঙ্গীণ আধুনিক। পুরাণযুগে দেবতার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নারীরা কষ্ট পেয়েছে, বর্তমান কালেও মেয়েরা ভাগ্যকে মেনে নেয় কোনাে রকম প্রতিবাদ ছাড়াই। কিন্তু দেবযানী দেবতার নির্ধারিত কর্তব্যকে অস্বীকার করে নিজের অধিকারের কথা বলেছে। এখানে তার স্বাধীনচেতা মনােভাব। সে বলেছে :
রমণীর মন।
সহস্রবর্ষেরই, সখা, সাধনার ধন। (২খ,পৃ.৩০৭)
এ অধিকার বােধ নিজের অস্তিত্ব, সম্মান, আমিত্ব প্রকাশের ঘােষণা। মেনে নেওয়ার যুগে মেনে না নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা এবং নিজের অধিকারের কথা বলা দুঃসাহসের। দেবযানী তা-ই করেছে। এখানেই সে বিদ্রোহী। এখানেই তার স্বাতন্ত্র্য। তাই দেবযানী চরিত্রটি স্বাধীনচেতা থেকে বিদ্রোহী’ গােত্রে স্থান করে নিয়েছে।
মহাভারতের কাহিনী প্রায় অবিকৃত রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ। অল্প কিছু জায়গায় পরিবর্তন করেছেন। পরিবর্তন করেছেন নিজের দর্শনের কারণে এবং নাটকীয়তা আনয়নের জন্যে। পরিবর্তনগুলাে হলাে- মহাভারতে রয়েছে কচ সরাসরি শুক্রাচার্যের কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে শিষ্য হতে চেয়েছে, আর নাটকে কন্যা দেবযানীর মাধ্যমে শুক্রাচার্যের কাছে পৌছেছে। কারণ, নাটকে কচের মনে শঙ্কা ছিলাে দানবের গুরু স্বর্গের ব্রাহ্মণকে ফিরিয়ে দিতে পারেন। দেবযানী পিতার কাছে কচের শিষ্যত্ব ভিক্ষা চেয়ে কচকে শিষ্য হতে সাহায্য করে। এছাড়া, মহাভারতে কচের দেবলােকে ফিরে যাওয়ার সময় দেবযানী কচকে অভিশাপ দিলে কচও দেবযানীকে অভিশাপ দিয়েছে। মহাভারতের কচ বলেছে :
আমি তােমাকে প্রতিশাপ প্রদান করিতেছি, তুমি যাহা অভিলাষ করিতেছ, তাহা নিষ্ফল হইবে এবং অন্য কোন ঋষিকুমারও তােমার পাণিগ্রহণ করিবেন না। আর তুমি আমাকে অভিসম্পাত করিলে যে, তােমার অধীত বিদ্যা সিদ্ধ হইবে না; ভাল, তাহা আমি স্বীকার করিলাম; কিন্তু আমি যাহাকে ঐ বিদ্যা অধ্যায়ন করাইব, সে তদ্বিষয়ে কৃতকার্য হইতে পারিবে।
এছাড়া মহাভারতে কচই বলে যে যদিও সে প্রয়ােগ করতে পারবে না কিন্তু শিখাতে পারবে। অন্যদিকে নাটকে দেবযানী নিজেই বলে:
শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়ােগ। (২খ,পৃ.৩০৯)
রবীন্দ্রনাথ কচকে দিয়ে প্রতিশাপের পরিবর্তে বর’ দেওয়ান। তাই রবীন্দ্রনাথের কচ মহান হয়েছে।
আমি বর দিনু, দেবী, তুমি সুখী হবে।।
ভুলে যাবে সর্বগ্লানি বিপুল গৌরবে। (২খ,পৃ.৩০৯)।
মহাভারতে দেবযানীর প্রতি কচের কোনাে প্রেমানুভব প্রকাশ পায় নি। নাটকে প্রেম বিদ্যমান। বিক্ষত প্রেমিকের মতােই সে বলে :
আর যাহা আছে তাহা প্রকাশের নয়
সখী। বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময়
বাহিরে তা কেমনে দেখাব। (২খ,পৃ.৩০৬)
মানুষের কাছে ‘দেবত্ব-বােধ’ বলতে যা বােঝায় রবীন্দ্রনাথ কচকে তাই সৃষ্টি করেছেন। তাই অভিশাপের পরিবর্তে বর দিয়েছেন। অন্যদিকে দেবযানী এক বিদ্রোহী মানুষ। সে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। সে প্রতারিত হতে চায় না।
কাব্যের তাৎপর্য প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ দেবযানী এবং কচকে দেহ এবং আত্মার রূপক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নিচের উদ্ধৃতিগুলােতে তা স্পষ্ট বােঝা যাবে-
১. জীব স্বর্গ হইতে এই সংসারাশ্রমে আসিয়াছে। সে এখানকার সুখদুঃখ বিপদ-সম্পদ হইতে শিক্ষা লাভ করে। যতদিন ছাত্র অবস্থায় থাকে ততদিন তাহাকে এই আশ্রমকন্যা দেহটার মন জোগাইয়া চলিতে হয়।
২. আমরা একবার করিয়া আপনাকে বাধি, আবার পরক্ষণেই সেই বন্ধন ছেদন করি। আমাদিগকে ভালােবাসিতেও হইবে এবং সে ভালােবাসা কাটিতেও হইবে- সংসারের এই মহত্তম দুঃখ, এবং এই মহৎ দুঃখের মধ্য দিয়াই আমাদিগকে অগ্রসর হইতে হয়।
তা যদি হয়, অর্থাৎ দেহ এবং আত্মার রূপক যদি হয়, তাহলেও আত্মার প্রতি দেহের এই অধিকারবােধ দেহের নিজস্ব অস্তিত্ববােধেরই পরিচায়ক। দেহকে ছাড়া আত্মা কি মানবাত্মা হতে পারে! নাটক সম্পর্কে প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায় বলেছেন, “কচ কামুকী দেবানীর অভিশাপ নীরবে বহন করিয়া “মহাসঞ্জীবনী বিদ্যা করে উপার্জন” দেবলােকে প্রত্যাগমন করিল। অর্থাৎ নারীর কামনার ইন্দন না হইয়া , সে আদর্শকে বড় করিয়া দেখিল। দেবযানীর ন্যায় সাধারণ নারীর পক্ষে তাহা অসহ্য।”৬ – এ সম্পর্কে বলা যায়, কচ আদর্শকে বড়াে করে দেখেছে ঠিকই, কিন্তু দেবযানীর সঙ্গে যে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তাকেও সে অস্বীকার করতে পারে না। কচ প্রথম থেকেই জানতাে যে তাকে ফিরে যেতে হবে দেবালয়ে। তাহলে কেন সে দেবযানীর সঙ্গে প্রেমময় সময় কাটালাে। এর অর্থ কি এই নয় যে, কচ নিজের প্রয়ােজনে স্বার্থপরের মতাে দেবযানীর প্রেম গ্রহণ করেছে, এবং প্রয়ােজন শেষ হলে সে আর দেবযানীর কথা চিন্তা না করে নিজের কর্তব্যে চলে গেছে। এ ক্ষেত্রে নিজের অধিকার পাওয়ার জন্য দেবযানীর যে চেষ্টা তাকে কামুকী বলা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং দেবযানী মানুষের মতাে মাথা উঁচু করে নিজের অধিকারের কথা বলেছে। প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়ের মতাে প্রায় একই কথা রণেন্দ্র নারায়ণ রায় বলেছেন- “নারীই শিকারী, পুরুষ শিকার। এই নাটকেও দেবযানী কচের অনুসরণকারিণী, কচকে চাতুরী ও ছলনায় শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত করে, অভিসম্পাত দেয়।”৭এ মন্তব্যও যুক্তিনিষ্ঠ বলে মনে করি না। কারণ আমরা জানি যে, দেবযানী কচের কাছে যায় নি, কচই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেবযানীকে অবলম্বন করেছে। অর্থাৎ কচই ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়েছে, দেবযানী নয়। আর শিকার শিকারী’র প্রশ্নে কচকেই শিকারীর ভূমিকায় দেখি বরয় দেবযানীই হয়েছে পুরুষের শিকার। নাটকের পরিপ্রেক্ষিতে সুকুমার সেনের মন্তব্য দেবযানীর যন্ত্রণাদগ্ধ মনকে শান্ত করে। তিনি মন্তব্য করেছেন, “নিষ্ফল প্রণয়ের শূন্য বেদনামাত্র নয়, প্রত্যাখ্যানের দুর্বিসহ লজ্জাই তাহার জীবনের শান্তি এবং সংসারের মর্যাদা নষ্ট করিয়া দিবে। সুতরাং কচকে সে ক্ষমা করিতে পারে না।”৮ প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, “দেবযানী প্রাচীনতম মডার্ন উওম্যান।””- সত্যিই দেবযানী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে মডার্ন উওম্যান’ হয়ে উঠেছেন। আজকের একবিংশ শতকের সমাজেও দেবযানী সমান আধুনিক। কারণ, নারীর দুর্বলচিত্তের আবেগ নয়, বরং নিজের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সে মানুষ। নারীর অধিকার মানুষের অধিকার- এটাই আধুনিকতা।
সমগ্র রবীন্দ্র-নাট্যে দেবযানীর মতাে চরিত্র একটিও নেই। কুমুদিনী অনেক প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি। ফিরে গেছে স্বামীর ঘরে। চিত্রাঙ্গদাও দেবযানীর মতাে বেপরােয়া নয়। অর্জুনকে সে দেবযানীর মতাে সরাসরি ব্যঙ্গ করে নি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কোমলভাবে নিজের অধিকারের কথা বলেছে। অবশ্য চিত্রাঙ্গদার শেষ পরিণতি রবীন্দ্রনাথ দেখান নি, শুধু তার নিজস্ব চাওয়ায়ই নাটক শেষ হয়েছে। সে চাওয়া বলিষ্ঠ কিন্তু দেবযানীর মতাে মরিয়া নয়। দেবযানী বাংলাসাহিত্যের অনন্য চরিত্র। অন্তরে সে প্রেমময়ী, অধিকার আদায়ে বলিষ্ঠ, সত্য উচ্চারণে অবিচল। সমালােচকরা অনেকেই দেবযানীর কঠোর সমালােচনা করেছেন। এতে বােঝা যায়, তারা গতানুগতিক নারী কনসেপ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। নারীর মেনে নেওয়া, নিজের কষ্টের কথা না বলা, অন্যের সুখে নিজে সুখী হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলাে তাকে অবলারূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, নারীও একজন মানুষ। মানুষের সমস্ত অধিকারই তার অধিকার। পুরুষপ্রতিষ্ঠিত ধারায় চলে সে সমাজের বাহবা পায় ঠিকই, কিন্তু নিজে থাকে দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত। দেবযানী চেষ্টা করেছে দুঃখে নিমজ্জিত না হয়ে সুখ অর্জন করতে। তবে সে সফল হতে পারে নি, কচকে আটকে রাখতে পারে নি নিজের কাছে। তাই সে কচকে অভিশাপ দিয়েছে। দেবযানীর এই সরব অভিশাপও সমালােচকরা মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা মনে করেছেন, নিরুপায় দেবযানী ভাগ্যকে মেনে নিয়ে মৌন থাকবে- তবেই তাে সে নারী! কিন্তু দেবযানী নীরব থাকতে পারে নি। তার অন্তরে যে কথা অঙ্কুরিত হয়েছে, তাকে সে প্রকাশ করেছে। এটা তার গতানুগতিক প্রথার বিরুদ্ধে দৃপ্ত বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা তাকে সাধারণ নারীর পর্যায় থেকে দৃঢ়চেতা-অস্তিত্বশীল মানুষের পর্যায়ে উন্নীত করেছে।
সব শেষে বলা সঙ্গত, নারীকে যারা অবলা হিসেবে বিবেচনা করতে চান তারা দেব্যানীকে পছন্দ করতে পারেননি। প্রতারিত দুঃখী দেবযানীকে তারা আরেকবার দুঃখ দিয়ে পিশাচী বলে উল্লেখ করেছেন। দেবযানীর যন্ত্রণাদগ্ধ মনকে তারা বুঝতে পারেননি, বা পারেন না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাই দেবযানীর মানুষ হয়ে ওঠাকে পছন্দ করে না। তাই দেবযানী দেবতা এবং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে থাকে। তাই দেবযানী শুধু নারী নয়, সে মানুষ। দেবতার বিরুদ্ধে একা এক মানুষ।
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
তথ্য-নির্দেশ
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্র রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, (সুলভ সংস্করণ), পৌষ ১৪১০, বিশ্বভারতী, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৩০১; এরপর বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী’ থেকে গৃহীত নাটকের উদ্ধৃতির পাশে শুধু খণ্ড সংখ্যা ও পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করা হবে।
২. প্রমথনাথ বিশী, রবীন্দ্র নাট্য প্রবাহ, ২০০৪, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলকাতা,পৃষ্ঠা-১৫
৩. কালী প্রসন্ন সিংহ (অনুদিত), মহাভারত, প্রথম খণ্ড, ২০১০, তুলি-কলম, কলকাতা, পৃষ্ঠা-১৩১
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পঞ্চভূত, রবীন্দ্র রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা-৯২৪
৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৯২৬
৬. প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী, প্রথম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৮১
৭. রণেন্দ্র নারায়ণ রায়, নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ, ১৯৯৩, এ মুখার্জী এ্যাণ্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা,
৮. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, চতুর্থ খণ্ড, ১৯৯৮, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, পৃষ্ঠা-২০৪।
৯. প্রমথনাথ বিশী, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩০৮
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।