• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় মৃদুল শ্রীমানী

আমার রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্য চেতনা নিয়ে সেই কবে থেকে আমার বোধের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছেন।
বড় হবার দিনগুলোতে একটু বোধ গড়ে উঠতেই মানবাধিকার নিয়ে ভাবনার ছোঁয়াচ পাই। মানবাধিকার বলতে ঠিক কি বোঝায় আমার কৈশোরের শেষ লগ্নে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন বেশ বলতে পারি, “ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে …”, বলতে পারি “জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর …”। তখন পড়ছি “লোকহিত”।
 ছোটবেলা থেকেই তো তাঁর কবিতা পাঠ করতে আমি অভ‍্যস্ত। আমাদের পল্লীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতা আবৃত্তি করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে আমি খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বাকি অংশ বলতে শুরু করি। কবিতাটির প্রথম পংক্তিটি ছিল “সোম মঙ্গল বুধ এরা সব আসে তাড়াতাড়ি, এদের ঘরে আছে বুঝি মস্ত হাওয়া গাড়ি?” বলতে বলতে রবিবারের কথা আসে। শিশুর মন নিয়ে কবি বলেন, “সে বুঝি মা তোমার মতো গরিব ঘরের মেয়ে?”
‘গরিব ঘরের মেয়ে’, এই কথাটা রবিবার এই আইডিয়ার সাথে লগ্ন করে দিতে পারাটা এক দুরন্ত ব‍্যাপার। কবির অতটুকু অনুরাগী ওই একটি কথায় টের পেয়ে যায় গরিবের ব‍্যথাটা ঠিক কি! আর, গরিবের মধ‍্যে যে মেয়েরা আরো হদ্দ গরিব, শোষিতের মধ‍্যেও চরমতম শোষিত, সর্বহারার মধ‍্যেও আরো সর্বহারা, ওই কথাটা ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস আমার কানে কানে বলেছিলেন আরো অনেক পরে। কিন্তু এঙ্গেলস এর সেই কথাটা প্রাণের পরে কয়ে দেবার কাজটা সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সেরে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমার তারুণ্যের দিনে “আফ্রিকা” কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে। ” আফ্রিকার উপর যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আস্ফালন আক্রমণের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানহারা মানবীর কথা বলেন, কেননা কবিকে খবর রাখতে হয়, যারা শাসন করে তারা শুধুমাত্র শাসিত অংশের নিরপরাধ মানুষের বুকে গুলিই ছোঁড়ে না, তাদের ঘরের মা বোনকে ধর্ষণ করায়। শক্তিমানের পক্ষে শাসিত জনগোষ্ঠীর মনোবল ভেঙে দেবার জন্য ধর্ষণ একটা প্রচণ্ড কার্যকর অস্ত্র। গণতন্ত্রের নাম জপতে জপতেও ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখে নারী মর্যাদা লুণ্ঠন করতে থাকে শাসক।
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তেই আমার সদ‍্যোতারুণ‍্যের দিনে ভগবানের উদ্দেশে কঠিন প্রশ্ন উঠে এল।
 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পরিশেষ’ কাব‍্যগ্রন্থের “প্রশ্ন” কবিতায় ভগবানকে প্রশ্ন করেছেন যারা পরিবেশ দূষণ করছে, সংস্কৃতিকে আক্রমণ করছে, বিচার ব‍্যবস্থাকে প্রহসনে পর্যবসিত করছে, তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে, অশেষ ক্ষমাশীল তিনি তাদেরকেও ক্ষমা করেছেন কি না। কিন্তু কবিতাটি আগাপাশতলা খুঁটিয়ে পড়লে বেশ বোঝা যায় কবি চান না, ভগবান ওদের ক্ষমা করুন। অথচ চালু অর্থে যারা ভক্ত, তারা জানেন ঈশ্বরের সকল কাজ মানুষের প্রশ্নের অতীত। এই চালু অভ‍্যাসটাকে আঘাত করেই কবি প্রশ্ন করছেন, “তুমি কি বেসেছ ভাল?” ভাবখানা যেন এই, তুমি যদি বেসেও থাকো, সে কাজটা ভালো করো নি। ঈশ্বরের দৈবী মাহাত্ম্যটাকেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন কবি, আর বললেন মানুষী যুক্তিবিচারের কাছে কৈফিয়ত দেবার দায় স্বয়ং ঈশ্বর পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে পারেন না। “ধর্মমোহ” কবিতায় কবি এমন কি নাস্তিকের গুণগান পর্যন্ত করেছেন।
 যখন বিজ্ঞান পড়ছি, তার সাথেই পড়ছি বিজ্ঞান সাধকদের উপর শাসকদের আক্রমণের কাহিনী, তখন ঈশ্বরের করুণাময় অস্তিত্বটা আমার কাছে চিরতরে চুরমার হয়ে গিয়েছে।
ওই যে দুই বিঘা জমি কবিতা পড়তে গিয়ে দেখি ঋণের মিথ্যা মামলা দায়ের করে জমিদার গরিব মানুষ উপেনের সাত পুরুষের ভিটে কেড়ে নিয়েছে। আদালত বড়লোকের পক্ষে ডিক্রি দিয়ে দেয়। উপেন কোর্টের কায়দা কেতায় নিজের বক্তব্য টুকুও পেশ করার সুযোগ পায় নি।
বিরাজমান ব‍্যবস্থায় কোর্ট কাছারি পুলিশ কার পক্ষে কাজ করে চিনিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
 আর সেই সাথে উপেনের প্রস্তুতিহীনতাকেও দেখান কলমের সূক্ষ্ম আঁচড়ে। উপেন নিজের বাস্তুভিটা হারিয়ে নিজেকে প্রবোধ দেয়, “তাই লিখি দিল বিশ্ব নিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।” কিন্তু নিজেকে ভুল বুঝিয়ে কঠোর বাস্তবকে ঠেকানো চলে না। কবি উপেনের মুখ দিয়ে বলেন “তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারি নে সেই দুই বিঘা জমি।” একেবারে শেষে হারানো বাস্তুভিটার টানে গ্রামে ফিরে এসেছে। দুটি পাকা আম, তার জন‍্য‌ই উপেনকে চোর বনতে হয়। আমাদের বিরাজমান আর্থ রাজনৈতিক ব‍্যবস্থাটিকে চেনান কবি। গরিবকে মুক্তি পেতে হলে ব‍্যবস্থাটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চিনতে হবে আর বৈজ্ঞানিক মানসিক গঠন নিয়ে জোট বাঁধতে হবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।