• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় শর্মিষ্ঠা

অন্তরে অন্তরে আছ তুমি

“আমি রূপে তোমায় ভোলাব না” গানটা কানে যেতে সিড অর্থাৎ সিদ্ধার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল স্টেজের দিকে। গায়িকাকে দেখেই কেমন একটা ইলেকট্রিক শক খেয়ে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়ার মতো অবস্থা। খান কুড়ি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ আনসিন অবস্থায় ফোনে থেকে গেল এই প্রথম।
কলেজ ফেস্টে গেস্ট আর্টিস্ট পারফর্ম করার আগে কলেজের ছেলেমেয়েদের পালা চলছে।
পাখি পাখি প্রিন্টের সুন্দর সিল্ক শাড়ি, আগেকার জমিদার বাড়ির গিন্নীদের মতো কুঁচি দেওয়া ব্লাউজ, একপায়ে নুপুর, একহাতে ব্রেসলেট, কাজলকালো চোখজোড়ার সাথে মানিয়ে সুন্দর ধারালো মুখ, খোলা চুল।মনে হচ্ছে সত্তরের দশকের কোন নায়িকাকে একটু উনিশ-বিশ করে সোজা স্টেজে তুলে দেওয়া হয়েছে।
“দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে”শেষ গান গেয়ে মেয়েটি বলল,”আমার জীবনে, মরনে,মননে, শয়নে, স্বপনে, জাগরনে রবীন্দ্রনাথ।রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে যারা জানেনা বা আকর্ষণ বোধ করে না তাদের আমি মানুষের স্তরে ফেলিনা”।
তারপর আশপাশের জিন্স, স্কার্ট, পালাজো ইত্যাদি পরিহিত রমনী ও পুরুষকুলকে স্তম্ভিত, চমকিত ও ভাবিত এবং সিডকে কম্পিত অবস্থায় রেখে অন্তর্হিত হল সে।
….
বাড়িতে ফিরে মা যেই না মা জিজ্ঞেস করল তাকে এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন রেগে আগুন হল সিড। পরে অনেক কসরত করতে হল মায়ের মান ভাঙাতে।হাজার হলেও সিডের বাবা নেই।ছেলেই সব।
মা তো ওর মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছে না।সেদিনের পর খোঁজখবর করে জেনেছে ওর নাম মানসী উপাধ‍্যায়।বেঙ্গলি অনার্স।ফার্স্ট ইয়ার।
এরি মধ্যে ওর পেছনে লম্বা লাইন।আর সিড রবীন্দ্রনাথে লবডঙ্কা।ইংরেজি স্কুলে পড়েছে।বাংলা ছিল থার্ড সাবজেক্ট।নমো নমো করে পাশ করেছে।আগে গর্বে ফুলত।এখন হাত কামড়াচ্ছে।এই বিদ‍্যে নিয়ে মানসীর মনের মানুষ হওয়া সম্ভব নয়।
ইচ্ছে করলেই সব হতে পারত।ওর বাবা নিজেই গান আর আবৃত্তি শেখাতেন।একরাশ লোকজনের আনাগোনা ছিল সারাদিন ধরে।সিদ্ধার্থ ধারেপাশে যায়নি কখনও।কবি কবি ভাবভঙ্গির ছেলেমেয়েগুলোকে অসহ‍্য লাগত।
অনেক রাত পর্যন্ত মানসীর কথা ভাবছিল।ঘর অন্ধকার।হঠাৎ মনে হল পাশে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।
ভয়ে কাঁটা হয়ে তাকিয়ে দেখে একটা পাঞ্জাবী।নিচের দিক নেই।পতপত করে হাওয়ায় উড়ছে।
আলো জ্বালতে যেতেই কেউ বলে উঠল,”আলো জ্বালাস না।আমি।তোকে দেখতে এলাম।পাঞ্জাবীটা প্রথমে পাঠিয়ে পরীক্ষা করছিলাম।এবার বডিটা আনব”।বাবার গলা।
পুটুং করে টর্চ দিয়ে বেডসাইড টেবিলে বাবার ফটোটা দেখল।বাবার পরা পাঞ্জাবী সত্যি সত্যি নেই।খালি গা।নিচটা মানে পাজামা পাঠিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেনি সেই ভালো।
আলো নেভাল।আবছা অন্ধকারে দেখল বডিসমেত খাটের পাশে বসল বাবা।
ও একটা কথা না বলে পারল না,”আচ্ছা বাবা এত খরচ করে শ্রাদ্ধ শান্তি করে কি হল তাহলে!এত পয়সা বাজে খরচ হয়েছে শুনলে মা খেপে যাবে কিন্তু!”
বাবা উত্তর দিল “তুই আর পুরুত মিলে মোট সাতচল্লিশটা মন্ত্র ভুল বলেছিলি”।
এরপর বাবা কথায় কথায় সিডের রাতজাগার কারনটা জেনে নিল ও আশ্বস্ত করল।
….
পরেরদিন সিড রবীন্দ্র রচনাবলি নামাল।বছরের পর বছর বইগুলো একে অপরের গায়ে ঠেসে থেকে ড‍্যাম্প ধরে গেছে।একে বাংলা তায় সাধুভাষা মাথা ঘুরতে লাগল।এক দু পাতা উদ্ধার করে বই বন্ধ করল।তারপর মায়ের আচারের পাশে রোদে দিয়ে এল। বাবার হারমোনিয়াম নিজের রুমে আনল।মা তো কান্ডকারখানা দেখে হাঁ।
রাতদুপুরে শুরু হল বাপ-ব‍্যাটার রবীন্দ্রচর্চা। গান প্লাস শুনে শুনে রবীন্দ্ররচনাবলী।’বেদ’-এর আরেক নাম ‘শ্রুতি’ মনে করিয়ে দিয়ে বাবা বলেছে চিন্তার কিছু নেই।
কদিন পর মানসীকে প্রেমপত্র দিল একটা ।বাবা রাতে বলে এসব মেসেজ টেসেজে চিঁড়ে ভিজবে না।কি লাইন কোট করতে হবে বলেও দিল।অনেক কষ্টে প্রানপন চেষ্টায় মোটামুটি হাতের লেখায় চিঠি শেষ করে “মানসী” থেকে জুড়ে দিল,
“শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী—
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে।”
মানসী হেসে বলল,”এরকম চিঠি ঢের পেয়েছি।পরের লাইনগুলো শোনাও তো দেখি।”
সিড প্রমাদ গুনল।ঠিক এই সময় ও এই বড় মাপের একটা হাঁ করল এবং ওর মনে হল ওর সমান বা বড় মাপের কিছু ও গিলে ফেলল। এরপরই গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বরে মানসীর চোখে চোখ রেখে বলে উঠল,
“বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার ‘পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না,……”
মানসী হাঁ।তবে পুরোপুরি ইমপ্রেসড্ কিনা বোঝা গেল না।অল্প হাসল একটু।
….
মাঝরাতে বাবার কাছে গানের ক্লাসে ওকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিল প্লাস সাবধান করে বলল,”আমার মধ্যে ঢুকলে আমার অজান্তে ওর সাথে কিছু বাড়াবাড়ি করবে না বলে দিলাম।”
মাঝরাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার ফলে পাড়াপড়শি খেপে লাল।মা তন্ত্রমন্ত্রের টিভি প্রোগ্রাম হজম করছে পাগলামির টোটকার আশায়।সবসময় কান্না কান্না মুখ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
সেদিকে অত্রিদেব ঝামেলা শুরু করছে।মানসীকে গলানোর তালে রবীন্দ্রনাথের মতো জোব্বা কাটিয়েছে।এই সেদিন পলাশ ফুলের মালা প্রেজেন্ট করেছে। “আজ জ‍্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে”শুনিয়ে কোথাও পালানোর হিন্টও দিয়েছে।
দুদিন বাদেই মানসীর জন্মদিন এল।অত্রি আগে থেকেই বুক করে মানসীকে লাঞ্চে নিয়ে গেল “টেস্ট অফ ঠাকুরবাড়ি” রেস্তোরাঁয়।যেখানে ধুতি-পাঞ্জাবী আর আটপৌরে শাড়ি পরিহিত ওয়েটাররা ঘুরে বেড়ায়।বিকেলের আগে মানসীর টিকিও পেলনা সিড।
মানসীকে দেখা মাত্র যথারীতি সিডের ভেতর বাবার প্রবেশ।একগোছা রজনীগন্ধার সাথে ধরিয়ে দিল ভেলভেটের ছোট একটা বক্স।শুনিয়ে দিল এতদিন ধরে প্র‍্যাকটিস করা গানটা,”তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা”।
মানসী হাসিমুখে দেখল বক্সের মধ্যে পুচকে একটা সোনালী নৌকো।তাতে আরো পুচকে একটা মাঝি।আর একটা সুন্দর কার্ডে লেখা,” মানসীর জন্যে “সোনার তরী”(ইটস্ রিয়েলি গোল্ড প্লেটেড)”।
বাবা বেরিয়ে যাওয়ার পর সিড দেখতে পেল মানসীর মুখে পুরোপুরি ইমপ্রেসড্ হওয়ার হাসিটা।
….
রাতে বাবা বলল ,”মেয়েদের সোনার প্রতি টানটা চিরন্তন।যে যেমনই হোক এই আকর্ষণ এড়ানো প্রায় অসম্ভব।”
সেই সাথে খবর দিল মা নাকি কালই ঘরে শান্তি যজ্ঞ করাচ্ছে।যে আসছে এবার ভুল মন্ত্রের চান্স নেই।
আর হয়তো বাবা আসতে পারবে না কোনদিন।তবে রবীন্দ্রনাথ পরপারে “মেক রবি ইওর হবি” বলে একটা গ্রুপ খুলেছেন।স্পেশাল রেকমেন্ডেশান থাকলে জীবিতদেরও মেম্বার করেন।বাবা ওকে অ্যাড করে দেবে কথা দিল।
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,. বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে….
কোথা থেকে গানটা ভেসে আসছে ভোরের বাতাসের সাথে।
রবীন্দ্রনাথের সাথে বাবাও সিডের বন্ধু হয়ে অন্তরে থেকে গেল সারাজীবনের জন্য।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।