“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
by
·
Published
· Updated
রবীন্দ্রসংগীত ও ব্যক্তিগত অনুভব
একটি গান কখন গান হয়ে ওঠে আর কখনই বা তা সংগীতের আত্মাকে পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র গানের খোলস রেখে যায়। সংগীত ও ছদ্মসংগীতের এই সীমান্তরেখাকে চিহ্নিত করতে হলে আমাদের রবীন্দ্রনাথের কাছে আসতে হবে। তাঁর গানের কাছে এসে বসতে হবে নিভৃতে। তাঁর সুরের সাথে মিলিয়ে নিতে জীবনের স্পন্দন। তাঁর গান কি শুধুমাত্র গীতবিতানের পাতায় ? যদি বলি তাঁর কবিতায়, তাঁর গল্পে তাঁর উপন্যাসের ভেতরেও রয়ে গেছে সংগীতের প্রবাহ তাহলেও বিন্দুমাত্র ভুল বলা হবে না। রবীন্দ্রনাথ চেতনে বা অবচেতনে সংগীতের ভেতরেই খুঁজেছেন তাঁর আশ্রয়। তাই তাঁর কবিতাও গীতিধর্মিতায় পরিপুষ্ট। তাঁর গীতিনাট্য এবং নৃত্যনাট্যে আমরা দেখতে পাই গানে ও নাটকে এবং গানে ও নৃত্যে মিলে তৈরি হয়েছে এক নতুন সৃষ্টির অভেদ রূপকল্প। সুর তাঁর গল্পকে সীমার মাঝে করে তুলেছে অসীম। যোগাযোগ, শেষের কবিতা এবং আরও অধিকাংশ উপন্যাসে গানের গুনগুনানি তিনি বুনে দিয়েছেন পাতায় পাতায় যা তাঁর উপন্যাসকে করেছে তাত্বিক নিরীক্ষাধর্মী এবং চিরস্থায়ী। গান রয়ে গেছে তাঁর ডায়েরীর পাতাতেও “ গান জিনিসটা নিছক সৃষ্টিশীল। ইন্দ্রধনু যেমন বৃষ্টি আর রৌদ্রের জাদু, আকাশের দুটো খামখেয়ালী মেজাজ দিয়ে গড়া তোরণ একটি অপূর্ব মুহূর্তকাল সেই তোরণের নীচে দিয়ে জয়যাত্রা করবে। মেজাজের এই রঙিন খেয়ালই হচ্ছে গীতিকাব্য ( পশ্চিম যাত্রীর ডায়েরী )
রবীন্দ্রনাথ সুরকেই বহন করেছেন তাঁর শিল্পে। তাঁর শিল্পীসত্তার আবহ জুড়ে বেজে উঠেছে সংগীতের মুর্ছনা। কখনও রূপে , কখনও বা অরূপে। আনন্দের ভেতর দিয়ে সঙ্গীত যেমন তার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক সেরকমভাবেই বেদনা নিংড়ে যা উঠে এসেছে তা গানেরই নির্যাস।রবীন্দ্রদর্শন শুধুমাত্র চোখের সামনে ঘটমান ক্ষুদ্র বর্তমানের প্রতিবিম্ব নয়, বিন্দুর মধ্যে তিনি অনন্তের ধ্বনিই শুনতে পেয়েছেন তাই তাঁর উপলব্ধি – “ সংসারে ক্ষুদ্র কালটাই সত্য হয়ে দেখা দেয়… চিরকালটা থাকে আড়ালে, গানে চিরকালটাই আসে সামনে, ক্ষুদ্র কালটা যায় তুচ্ছ হয়ে তাতেই মন মুক্তি পায়’ । যেহেতু রবীন্দ্রনাথ অনন্ত পথের পথিক তাই তিনি গানের ভেতর দিয়েই খুঁজেছেন রহস্যময় পৃথিবীর ইশারা -যা আছে কেবলমাত্র তারই বোঝা নিয়ে ঝগড়া চলে, যা নেই তারই আশা নিয়েই গান” যা নেই তা আসলে আগামীর ভেতর চিরকালের ভেতর বিলীন হয়ে আছে তাকে উপলব্ধি করা সবার সাধ্য নয়। সব গান তাই স্পর্শ করতেই পারবে না ইন্দ্রিয় অতিরিক্ত অনুভবের এই ছায়া। গানের শরীর থেকে খসে পড়বে জড়ত্বের এই খোলস। আর যা প্রকৃতপ্রস্তাবে গান হয়ে উঠবে তা অবশ্যই হয়ে উঠবে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। যা কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে আকুলিত করবে, শ্রোতার দিব্যকান আর দিব্যমনের সংযোগ ঘটাবে , জাগরিত করবে এবং শ্রোতা সারাজীবন বয়ে বেড়াবে অসীমকালের এই হিল্লোল –
“ যে গান কানে যায় না শোনা,
সে গান যেথায় নিত্য বাজে,
প্রাণের বীণা নিয়ে যাব
সেই অতলের সভামাঝে ।’’
অতলকে স্পর্শ করার জন্য তিনি অনেক কথাই বলেছেন আমাদের কানে কানে “ অনেক কথা বলেছিলাম কবে তোমার কানে কানে/কত নিশীথ-অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে” এই গোপন গানগুলিই তো ছড়িয়ে আছে তাঁর সামগ্রিক শিল্পের ভেতর। কাব্যকৃতির বা কথাশিল্পের অন্তর্বয়নে গ্রথিত হয়েছে গানের সারবস্তু। রবীন্দ্রনাথ নিজেও বলেছেন সংগীতের সঙ্গে বাণীর মিলনই তাঁর সাধনা। সুরের ভেতর দিয়ে কল্পভুবনের চিত্রকেই তিনি এঁকেছেন যার নৃত্যতরঙ্গিত দোলায় আমাদের সত্তা ডুবে যায় গভীর থেকে গভীরে।মায়ালোক আছন্ন করে রাখে আমাদের ভেতর আর বাইরের আকাশ। তিনি গানের ভেতর দিয়ে দেখেছেন পৃথিবীর চিরন্তন রূপ ও রস। এখানেই তাঁর তাঁর সিদ্ধি ও সার্থকতা।