তিনি, আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি
রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রথম আলাপ, যেদিন তার নাম শুনে ভেবেছিলাম, তিনিও তেত্রিশ কোটি দেব-দেবী দের মধ্যে এক ঠাকুর। রবি ঠাকুর। তাঁকে নিয়ে লিখতে গেলেই কলম, মৈনাক পর্বতের মতন হয়ে ওঠে, যাকে নাগপাশে জড়িয়ে মন্থন করেছিলেন দেবাসুরেরা। ছত্রি খাট গুলো যেমন চারটে ছত্রি ছাড়া অসম্পূর্ণ, রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আমরাও তাই। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনে দিনকরের মতন, যা একদিন মেঘে ঢেকে থাকলেই অস্বস্তি শুরু হয়। কি অদ্ভুত মিল আছে, রবীন্দ্রনাথ আর দিবাকরের। ভোর থেকে যেভাবে দিবাকর অল্প অল্প রশ্মি বিকাশে, ব্যাপ্তি ঘটায় একটু একটু করে, এবং দিনের মধ্য ভাগে, তেজময় হয়ে ওঠে, আমাদের জীবনে, রবীন্দ্রনাথ ও তাই। ছোট বয়স থেকে ধীরে ধীরে, একটু একটু করে আমাদের জীবন যাত্রায় মিশতে মিশতে, পুরোপুরি ভাবে জড়িয়ে যান, এবং কি অদ্ভুত সেই মিলন, যা তার ভাষাতেই বলা মানায়, “তোমার আমার মিলন হলে, সকলি যায় খুলে/ বিশ্ব সাগর ঢেউ খেলায়ে উঠে তখন দুলে”।
রবীন্দ্রনাথ একটি সর্বজনীন নাম। তিনি সকলের। তিনি বিশ্বের। কিন্তু বেশি অংশে তিনি একজনের ‘আমার’। তিনি একজন মানুষের খুব আপন আশ্রয়স্থল। বহুজন, বহুভাবে, বহুক্ষেত্রে তাকে উপলব্ধি করেছেন এবং করে চলেছেন। তাকে যতটাই জানা যায়, তিনি ততটাই অজানা রয়ে যান। তাঁর পরিব্যাপ্তিটা এতটাই যে তাকে এক একজন এক এক ভাবে ধরেছেন। এবং বিশ্বের সকল সত্যের সাথে, সকল সাহিত্যের সাথে, তিনি নিজের সাহিত্য কে মিলিয়ে দিয়েছেন, কি অপরূপ ভাবে। ইংরেজি সাহিত্যের মহাকবি, কিটস্ যে কথা দৃঢ় স্বরে বলে গেছেন, “বিউটি ইজ্ ট্রুথ; ট্রুথ বিউটি”, অর্থাৎ, সত্য মাত্রই সুন্দর, এবং সুন্দর মাত্রই সত্য, তা কি আপন করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “বিরাজ সত্য সুন্দর”। কি সুন্দর ঝংকার তোলে না এই ফ্রেজটা! এটাই রবীন্দ্রনাথ। এটাই তার এই সুবিশাল কর্মকান্ডের একটা ছোট্ট নিদর্শন। তিনি যতটা ছাতিম তলার শিশুদের, ততটাই বিশ্ব সাহিত্যের জটিল তত্ত্বের একটা আশানুরূপ মুখ। আবার তিনিই সেই নিমজ্জিত, যিনি উদার কন্ঠে বলছেন, “তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে?”, আবার তিনিই সেই প্রেমিক যে বলছে, “এসেছো প্রেম এসেছো আজ কি মহাসমারোহে”, আবার তিনিই সেই বিদ্রোহী যে বলছে, “দু বেলা মরার আগে মরবো না ভাই মরবো না”, আবার তিনিই সেই বিরহী, যে বলছে “তুমি যদি ভাসাও মরে, চাইনে পরিত্রাণ”।
রবীন্দ্রনাথ সেই অন্ধকারের আলো, যে আলো ঘরে ফিরতে সাহায্য করে। সেই বন্ধু, যে বন্ধু কখনও হাত ছাড়ে না। সেই শিক্ষক, যে জীবন ব্রতে শিক্ষা দেন। সেই পিতা, যে স্নেহের ডোরে বেঁধে রাখেন। সেই বৈবাহিক বন্ধনাবৃত মানুষ, যার সাথে নিজের সুখ দুঃখ ভাগ করা যায়, নির্দ্বিধায়। সেই প্রেমিক, যে অসাধারণ কাব্যগুনে মুগ্ধ করেছে চরাচর। সেই পরমাত্মার সাধক, যে নির্গুণ, আবার গুণময়। সেই অতিন্দ্রি়বাদী, যার কবিতা পড়ে, Yeats সাহেব বলেছিলেন, “translations from Rabindranath Tagore have stirred my blood as nothing has for years”। সেই দেশপ্রেমী, যে উগ্র-জাতীয়তাবাদকে এক লহমায় দূরে ঠেলতে পারেন, এবং নির্দ্বিধায় নাইটহুড ত্যাগ করতে পারেন। সেই শোকাহত পিতা, স্বামী, ভাই, সন্তানটি যে একের পর মৃত্যু সহ্য করে বলতে পারেন,
‘‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর/আজি তার তরে/ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে/এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়/মৃত্যুরে আমি ভালো বাসিব নিশ্চয়’’। সেই কবি, যে দৃপ্ত কণ্ঠে বলতে পারে, ” তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা”। সেই জমিদার, যে আকাশে মেঘ দেখলে লিখতে পারেন, “মেঘের ‘পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে”। সেই দার্শনিক যে বলতে পারেন, “তোমার আলোয় নাইকো ছায়া, আমার মাঝে পায় সে কায়া”। সেই অন্ধকারের উৎস সন্ধানী যে আলোর মোহনায় দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, “যত বাধা সব টুটে যায় যেন/প্রভু,তোমার টানে, তোমার টানে,তোমার টানে”। সেই গৃহস্থ মন, যে বলতে পারে, “ওলো সই, ওলো সই,/আমার ইচ্ছা করে তোদের মতন মনের কথা কই”। সেই হাল ভাঙা নাবিক যে ম্রিয়মান হয়ে কেঁদে ওঠে, “আমার সকল নিয়ে বসে আছি/সর্বনাশের আশায়/আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি/পথে যে জন ভাসায়”। সেই রোমান্টিক, যে বলতে পারে, “অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে সকল অঙ্গ ভরে”। সেই বাউল যে প্রশ্ন করতে পারে, “সখী, ভালোবাসা কারে কয়!/ সে কি কেবলই যাতনাময়/ সে কি কেবলই চোখের জল?/ সে কি কেবলই দুখের শ্বাস ?/ লোকে তবে করে /কী সুখেরই তরে /এমন দুখের আশ”।
রবীন্দ্রনাথ সেই তাপিত গ্রীষ্মের পরের “ইন্দ্রোলোকের অমৃত বাণীর বার্তা”। শরতের আকাশের সেই বালক, যার মাকে “পড়েনা মনে”। সেই শীতের রাতের কুহেলিকা, পরবর্তী সকাল যা স্নিগ্ধ। নবান্নের সেই কৃষক যে পৌষকে ভালোবাসে। সেই রাঙা বসন্ত যে বার বার রঙিন হওয়ার ডাক দিতে পারে। সেই চৈত্র, যার প্রেমিকের চোখে, শুধুই “সর্বনাশ”। সেই আর্শী বাহক যে ভরসা দেয়, “আমি থাকব, আমি বাঁচব, আমি চিরপথিক, মৃত্যুর পর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অন্তহীন প্রাণের বিকাশতীর্থে যাত্রা করব রৌদ্রে-বাদলে, দিনে-রাত্রে”। তিনিই “আমার প্রাণের আরাম/ মনের আনন্দ/ আত্মার শান্তি”।