• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় এম উমর ফারুক, বাংলাদেশ

বাংলা সাহিত্যের মুকুট রবী ঠাকুর

দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে নানা বিষয়ে বিবিধ আঙ্গিকে সাহিত্যচর্চা করলেও, রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবেই সমধিক পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের কালে যাঁরা কবিতা লিখেছেন, যাঁরা পরিচিতি পেয়েছেন রবীন্দ্রানুসারী কবি হিসেবে, তাঁদের পক্ষে অনিবার্য ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ এবং একই সঙ্গে অসম্ভব ছিলো রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ। বিশ শতকের প্রথম দুই দশকে বাঙালি কবির কাছে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিলো উপদ্রবের মতো। কিন্তু প্রলোভন দুর্দম হলেও রবীন্দ্রনাথের অনুকরণ তাঁদের পক্ষে ছিলো দুঃসাধ্য।
বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অন্য সকল সাহিত্য কর্মের মতই শ্রেষ্ঠত্ব্যের আবহ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা বার। তিনি ১৮৮৩ তে ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ এবং ১৮৮৭ তে ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসদ্বয় লেখার পর দীর্ঘদিন কোন উপন্যাসে হাত দেননি। ১৯০৬ তে বাস্তব নাগরিক জীবনের পটভূমি অবলম্বন করে, সামগ্রিক পালাবদল ঘটিয়েছেন ‘তাঁর চোখের বালি’ উপন্যাসের মাধ্যমে। তারপর পর্যায়ক্রমে ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬), ‘গোরা’ (১৯০৯), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯২৬), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘শেষের কবিত’ (১৯২৯), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৩), ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪) লিখে ব্যাপক সমালোচিত হন।
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প কনিষ্ঠতম সন্তান হিসাবে পরিচিত। পৃথিবীর অপরাপর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যে ছোটগল্পের ইতিহাসের সূত্রপাত বহু পূর্বেই হয়েছিলো। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে পাশ্চাত্য প্রভাবে যে আধুনিকতার সৃষ্টি হয় তার পরেই ছোটগল্পের জয়যাত্রা সূচিত হয়েছে এবং তাতে উৎকর্ষের নিয়ম শৃঙ্খলা সুস্পষ্ট ছিলনা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাতে উৎকর্ষের নিদর্শন সুস্পষ্ট করেন আপন মহিমায় মহিয়ান হয়ে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিতি গড়ে তোলেন। তাঁর প্রথম ছোটগল্প ‘ভিখারিণী’ ভারতী পত্রিকায় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৮৪-৮৫ তে ‘ঘাটের কথা’, ‘রাজপথের কথা’ ও ‘মুকুট’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯০ সালে ‘দেনাপাওনা’ গল্পটি ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ব্যাপক পাঠক সমালোচিত হয় এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক ছোটগল্প হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
বাংলার মানুষ আর প্রকৃতিতে তিনি বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ছোটগল্পে সে সব ছোট খাট মানুষের সুখদুঃখের কথাকেই নিতান্ত সহজ সরল ভাষায় আপন মনের সৌন্দর্য মিশিয়ে তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যয়কে লিখেছিলেন, ‘পোষ্টমাষ্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকতো। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। শ্রীদাসদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি, কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।’ তাঁর লিখিত গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘একরাত্রি’, ‘মহামায়া’, ‘সমাপ্তি’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘মাল্যদান’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘শাস্তি’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘মানভঞ্জন’, ‘দুরাশা’, ‘অধ্যাপক’, ‘নষ্টনীড়’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পাত্র ও পাত্রী’, ‘রবিবার’, ‘ব্যাবধান’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘পণরক্ষা’, ‘দিদি, ‘কর্মফল’, ‘দান প্রতিদান’, ‘দেনা পাওনা’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘হৈমন্তী’, ‘ছুটি’, ‘পুত্র যজ্ঞ’, ‘পোষ্ট মাষ্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘শুভা’, ‘অতিথি’, ‘আপদ’, ‘গুপ্তধন’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহার’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
উপন্যাস এবং ছোট গল্পের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠক নন্দিত হলেও সবচেয়ে বেশি সম্মানিত হয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। তিনি ‘ছিন্নপত্রাবণীতে’ লিখেছেন, ‘আমার বুদ্ধিতে যতটা আসে তাতে তো বোধহয় কবিতাতেই আমার সকলের চেয়ে বেশি অধিকার।’ মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ্য ‘বনফুল’ প্রকাশিত হলে তখনকার সাহিত্য সমাজ রবীন্দ্রনাথকে সাদরে গ্রহণ করে। তারপর তিনি অনেক কাব্যগ্রন্থ্য প্রকাশ করেছেন এবং সমান সম্মান পেয়েছেন। ১৯১০-এর আগষ্টের মাঝামাঝি তার কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ্য ‘গীতাঞ্জলি (বাংলা) প্রকাশিত হয়। অন্য সকল গ্রন্থের মত এটিও ব্যাপক সাড়া আনে। কিন্তু ১৯১২ সালে ১ নভেম্বর ইংরেজী গীতাঞ্জলি বা সং আফারিংস লিখে বিশ্ব সাহিত্যের আকাশে বিশ্বকবি হিসাবে জ্বলে উঠেন এবং ১৯৩০ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে সাহিত্যে প্রথম নোবেল প্রাইজ আনেন। এটি আমাদের জন্য অতন্ত গৌরবের ব্যাপার। তাইতো কবি নির্ভয়ে নিজ কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘আমার একটি মাত্র পরিচয় আছে, সে আমি কবি মাত্র।’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিক গীতকবিতার ধারাটি প্রবর্তন করেন বিহারী লাল চক্রবর্তি। তিনি ছিলেন গীতকবিতার বেলায় ভোরের পাখির মত। তাঁর অস্ফুট বাণীতে গীতকবিতার সূচনার ইঙ্গিত ফুটে উঠেছিলো সত্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই বাংলা সাহিত্যের এই ধারাটি বিশেষভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে। রবীন্দ্রনাথ ব্যাক্তিগত আবেগ-অনুভূতিগুলোকে সর্বকালের সর্ব মানবের মর্মস্পর্শি করে অনবদ্য কাব্যরূপ পরিগ্রহ করেছেন। তাঁর জীবন এবং সাহিত্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রমথ বিশীর বলেন, ‘আভিজাত্য নিংসঙ্গ বাল্যকাল ও মহর্ষিভবনের রহযরনরঃরড়হ আরও একটা কারণ থাকা সম্ভব। ঠাকুর বংশ পীরালী, মহর্ষির সন্তানগণ ব্রাহ্ম; এই দুই কারণ মিলে বৃহৎ হিন্দু সমাজ থেকে আলাদা করে রেখেছিলো। এই নিংসঙ্গতার কারনে তার না-কথা সাহিত্যে অপূর্ব মূর্তি লাভ করেছে।’
বাংলা নাটকের ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের পূর্বেই বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে রীতিনীতির বন্ধন সঠিক ও মজবুত ছিলো। তবুও তিনি পূর্ববর্তী ধারার বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নাট্য সৃষ্টিতে সফলতা অর্জন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- ‘বাল্মীকির প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’, ‘মায়ার খেলা’, ‘রুদ্রচন্দ্র’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘বিসর্জন’, ‘চিত্রঙ্গদা’, ‘মালিনী’, ‘ডাকঘর’, ‘কালেও যাত্রা’, ‘,মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’, ‘ফাল্গুনী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালজয়ী একটি নাম, বিশ্ব সাহিত্যের জগতে একটি বিরাট বিস্ময়। তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলা সাহিত্য সকল দিক দিয়ে নবযৌবনা হয়ে বিশ্বের দরবারে স্বগৌরবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে উঠেছেন সকল দেশের, সকল কালের মানুষের আদর্শ ও চেতনা শুদ্ধির প্রতিরূপ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।