• Uncategorized
  • 0

“আমি ও রবীন্দ্রনাথ” বিশেষ সংখ্যায় সম্বুদ্ধ সান্যাল

আমার রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রস্মরণে যদি আমাকে দুটো কথা লিখতে হয়, তবে আমি তার লেখা, আলোচনা, মতাদর্শ, কর্ম, স্বভাব প্রভৃতি বিষয়ে যাব না। আমার থেকে অনেক বড় বড় পর্যালোচকরা শতাধিক বছর ধরে এই আলোচনায় সমৃদ্ধ করেছেন। যদি কিছু বলার থাকে, তবে সেই ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথকে আমি কীভাবে উপলব্ধি করেছি, এবং সেই পথে আজও উপলব্ধি করতে পারি, তারই কিছু নিজমত পোষণ করব। সহজপাঠের পথ পেরিয়ে ছোটবেলাটার অনেকটাই তাঁর সাহচর্য পরিপূর্ণ ছিল। তারই কিছু অংশ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
প্রাইমারিতে সহজপাঠের সঙ্গে সবার মতোই আমিও পরিচিত হয়েছিলাম। সেখানকার নানা ছড়া, গল্প পড়লেও রবীন্দ্রনাথ যে আসলে কে, তা উপলব্ধির বয়েস তখনও তৈরি হয়নি। আমাদের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে সহজপাঠের দুইটি ভাগই পড়ানো হয়, সেটুকুতে আর পরবর্তীতে অন্যান্য বইতে কিছুটা রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছিলাম। অস্বীকার করব না যে রবীন্দ্রদর্শন ধরণের বিকাশ বা ভালোবাসা তখনও তৈরি হয়নি।
বাড়ির পাশেই একটা লাইব্রেরি আছে আমাদের, অনেক ছোটরে থেকেই সেখানে যাতায়াত। মূলত সুকুমার রায়, উপেন্দ্রকিশোর, লীলা মজুমদার, সত্যজিত রায়, ঠাকুমার ঝুলি, শুকতারা, আনন্দমেলা প্রভৃতি নিয়েই সময় কাটত সেখানে। রবীন্দ্রনাথ মানে তখনও যা বুঝি যে তিনি অনেক বড় বিষয়। তার চেয়েও বেশি যেন একটা ভীতি কাজ করত যে উনি পাঠ্য বইয়ের লেখা লেখেন, এবং তাঁর থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই বাঞ্ছনীয়। কে জানে, তাঁর লেখা পড়লেই সবাই যদি নম্বর কাটতে দৌড়য়।
পঞ্চম শ্রেণির পর উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে তিনটি অ্যাডমিশন টেস্ট দিই, একটি রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে, আর দুইটি বিশ্বভারতী পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রে। এর মধ্যে শিক্ষাসত্রে ভর্তি হতে হল। বাড়ির থেকে কেউই হস্টেলে রাখার পক্ষপাতী ছিল না, কারণটা ছিল চঞ্চলমতি স্বভাব, নজরের আড়ালে কখন কী করে ফেলি তাই নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকত আত্মীয়রা। শান্তিনিকেতনে পিসির বাড়ি, সুতরাং পিসি নিজের কাছে রাখবে বলে শিক্ষাসত্রই শ্রেয় মনে হল সবার। নইলে অন্য দুই জায়গাতেই হস্টেলে থেকে পড়তে হবে। সুতরাং ভর্তি করা হল শিক্ষাসত্রে।
তখনও রবীন্দ্রনাথ কে জানি না। শান্তিনিকেতনে যাওয়ার আগে বাবা একদিন অফিসফেরতা রবীন্দ্রনাথের জীবনীমূলক বই কিনে আনল, যা ছোটদের জন্য লেখা। উৎসাহবশে পড়েও ফেললাম, কারণ যার তৈরি স্কুলে পড়তে যেতে হচ্ছে, তাঁকে জানাটাও কর্তব্য। বড়জ্যেঠু গল্পের ছলে নানাভাবে বুঝিয়ে দিলেন তাঁকে, পড়ার বই বাদে আরও নানা কবিতা, গল্পও শোনালেন বসে বসে। গল্প শুনতে ছোটবেলার থেকেই বেশ ভালো লাগত, তাই সেগুলো মন দিয়ে শুনতে শুনতে ধারণা এল তিনি তাহলে পড়ার বইয়ের বাইরেও কিছু লেখেন। যিনি পড়ার বইয়ের বাইরে কিছু লিখতে পারেন, তিনি আজও প্রিয় লেখকদের মধ্যে পড়েন নিশ্চয়ই।
বইটায় উল্লিখিত তাঁর সম্পূর্ণ জীবনী কয়েকদিনের মধ্যেই মুখস্থ হয়ে গেল। এখনও মনে আছে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থেকে পড়তে না চাওয়াই সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল তাঁর প্রতি। বেশ একটা রোমাঞ্চকর মানুষ মনে হয়েছিল প্রথম আলাপেই। এমনিতেই স্কুলটুলে যেতে ইচ্ছে করত না বিশেষ। সুতরাং এমন মানুষকে কারই না ভালো লাগবে?
এর কয়েকদিন পরেই প্রবেশ করলাম সেই অবাধ স্বাধীনতার জগতে। অনেকেই জানবেন যে শিক্ষাসত্রে কিন্তু বিশ্বভারতীর প্রথাগত শিক্ষা দেওয়া হয় না। বাড়ির লোকেদের একটু সংশয়ও ছিল এই নিয়ে। তবুও তারা মেনে নিয়েছিল যে একাদশ শ্রেণীতে ফিরলে তখন পিসির বাড়ির থেকেই উত্তরশিক্ষায় পড়তে পারব জেনে। আমার মনে তখন রবীন্দ্রনাথের স্কুল পালানো বিষয় খেলা করছে। তার উপর শিক্ষাসত্র তৈরি করা হয়েছিল বোলপুরের আশেপাশের গ্রামগুলোর শিক্ষার উন্নতিতে। সুতরাং সেখানে নানা গ্রামের ছেলেরাই বেশি পড়তে আসত। তাদের যেন বড়ই সাবলীল লাগত আমার। মধ্যে মধ্যে পাঠভবনের ছেলেদের সঙ্গেও আলাপ হত। কিন্তু তারা বড়ই চশমাআঁটা গম্ভীর ধরণের। কেমন যেন শহরকেন্দ্রিক, খোলাখুলি মিশতে পারে না। আমি মফস্বলের ছেলে, তাদের সঙ্গে মানিয়ে নিতেও অসুবিধা হত তাই। কিন্তু শিক্ষাসত্রে একেবারে গ্রাম্য ছেলেমেয়েদের কাছে পাওয়ায় ঠিক যেন নিজের এলাকাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
মূলত শিক্ষাসত্র তৈরি হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথের কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে। পড়ানোও হত যেগুলো ঠিক পাঠ্যপুস্তক নয়। অবনীন্দ্রনাথের গল্পের বই যেমন নালক, শকুন্তলা, রাজকাহিনি প্রভৃতি, অপরদিকে মালগুড়ি ডে’জ-এর লেখক আর.কে.নারায়ণের হিন্দিতে লেখা গল্পের বইগুলো। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান বইগুলোও যেন কেমন সব গল্পের বইয়ের মতো লেখা বিশ্বভারতীরই কোনও না কোনও শিক্ষকের দ্বারা। সঙ্গে হাতের কাজ, কবিতাপাঠ, গদ্যরচনা— এইসব বিষয়গুলি অবশ্য পাঠভবনের সঙ্গে অমিল ছিল না। বিশ্বভারতীতেই প্রথম জানলাম খেলাধুলাও একটা ক্লাসের মধ্যে পড়ে। শিক্ষাপ্রণালীগুলো রবীন্দ্রনাথের মস্তিষ্কপ্রসূত হলেও তা প্রয়োগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ।
পরে বড় হয়ে ভেবে দেখেছি একই শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্গত হওয়া সত্বেও রবীন্দ্রনাথ কীভাবে ছোটদের মানসিকতা বুঝতেন। পাঠভবনেও স্বাধীন শিক্ষা দেওয়া হলেও তিনি জানতেন যে শহরকেন্দ্রিক ও গ্রাম্য শিক্ষার ফারাক। তাই খানিক লাগাম আটকে রেখেছিলেন পাঠভবনে, কিন্তু সম্পূর্ণ উন্মুক্ত গ্রাম্য পরিবেশে ঠিক প্রাকৃতিক শিক্ষার স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষাসত্রকে। দায়িত্বও দিয়েছিলেন তেমনি দুইজন মানুষকে, যারা শিশুমন ও হাতের কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। কারণ শিক্ষাসত্রের দর্শনই হল শুধুমাত্র পাঠগত শিক্ষায় নয়, গ্রামের কুমোর, কামার, মৃৎশিল্পী, ছুতোর প্রভৃতি জীবিকার মানুষদের ছেলেরা, যারা স্বভাবগতভাবেই এওসবের মধ্যে থাকে, তাদের প্রথাগত দর্শনে যেন খামতি না পড়ে। বরং আমরাই দুই-একজন যেন তাদের মধ্যে খাপছাড়া ছিলাম, যারা দশটা-চারটে স্কুল ছাড়া কিছুই বুঝতাম না।
কয়েকদিন পরেই অবশ্য আমার চরিত্রদোষ ঘটল। তখনও মনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের স্কুলে না যাওয়ার ইচ্ছা যেন প্রকট হয়ে উঠল বড়। কারণ হল কিছু বন্ধু জুটে যাওয়া, যারা আমাকে নিয়ে নতুন নতুন নানা জিনিস দেখাতে ভালোবাসত। যেমন আমি প্রথম মাটির হাঁড়ি বানানো দেখি সুরুল গ্রামে। একটা চাকার উপর কীভাবে হাঁড়ি গড়ে উঠছে তা অবাক হয়ে দেখায় আমার এক বন্ধু আর এক বান্ধবীর সে কী হাসি। এরপর আরও কিছু বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ওসব দেখতে শুরু হল স্কুল পালানো। শিক্ষাসত্রের একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল, যা পাঠভবনের ছিল না। স্কুল চলাকালীন সে কেউ যেকোনও সেকশনে গিয়ে পছন্দমতো ক্লাস করতে পারতাম আমরা। যেমন কারোর যদি নিজের সেকশনে বাংলা ক্লাস বাদ দিয়ে অন্য সেকশনে জীবনবিজ্ঞান ক্লাস করার ইচ্ছে জাগে, সে তা করতে পারে। আর ক্লাসের ধরণও ছিল আলাদা। ওখানে তো স্যার, ম্যাডাম বলা হয় না, সবাই দাদা-দিদি। তো হয়ত ইতিহাসের সৌমেনদার ক্লাস আছে আর আমরা সবাই এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছি মাঠের ভিতর। হঠাৎ সৌমেনদা সেখানে হাজির। সবাইকে ডেকে নিয়ে বললেন আরও যারা যেখানে আছে ধরে আনতে, ওই মাঠের মধ্যেই ইতিহাসের ক্লাস হবে। অবশ্য নিজেদের ক্লাসের জন্য বরাদ্দ নুড়িবিছানো চত্বরও বরাদ্দ ছিল যদিও, শুধু যে যে বিষয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের দরকার পড়তে পারে, সেইসব বিষয়েই ওখানে ক্লাস করানো হত। এই ছিল শিক্ষাসত্রের শিক্ষাব্যবস্থা। সেই উদয়ন পণ্ডিতের টোলের কথা মনে পড়ছে তো? হ্যাঁ, আমরা এইভাবেই ক্লাস করতাম।
তবে ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি ও কাঠের কাজের জায়গায় ছিল অবাধ প্রবেশ। যার যখন ইচ্ছে এইসব জায়গায় যতক্ষণ খুশি সময় কাটাতে পারতাম। দাদা-দিদিরা যদি জানতে পারত কেউ ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে আছে, তারা আপত্তি করত না। আমার কাঠের কাজ বেশ ভালো লাগত, খুব ভালোই শিখে নিয়েছিলাম তা। এতটাই ভালো যে এই সুব্যবস্থা থাকা সত্বেও সারাদিন কাঠের কাজের ঘরে সময় কাটানোর জন্য গার্জেন কলও হয়েছিল। বোধহয় এমন নিয়ম না মানা দেশেও নিয়ম ভাঙার জন্য কতিপয় ছেলের মধ্যে আমার নামও থাকবে।
এরপর এক বছর পেরোতে রেজাল্ট বিসর্জন দিয়ে সেভেনে উঠলাম। খানিক বড় হতেই বড় বড় কিছু বন্ধুও জুটল। ক্লাস সেভেনে হাতের সামনে পেলাম সুপ্রিয়দার ছেলে সুদৃপ্তদাকে। জানলাম যে তিনি হলেন ঠাকুর বংশের উত্তরাধিকারী। অবশ্য তার আগে রথীন্দ্রকন্যা নন্দিনী লালা’র সম্পর্কে জেনেছিলাম পিসীর বাড়ির পাশেই তাঁর বাড়ি হওয়ার দরুণ। তবে তিনি ছিলেন রথীন্দ্রনাথের দত্তককন্যা। সেদিক থেকে সুদৃপ্তদাকে কাছে পাওয়ায় এক স্বপ্নের জগৎ যেন খুলে গেল আমার সামনে। রতনপল্লী নিবাসী হওয়ার দরুণ প্রতিদিন বিকেলে সুপ্রিয়দার বাড়িতে খেলার আসরেও তিনি সঙ্গ দিতেন নিয়মিত। একটা রাজদূত মোটরসাইকেলে তিনি যখন যেতেন, ওই রকম দশাসই দেহসমেত সুদৃপ্তদা আমাদের কাছে বড়ই প্রিয় ছিলেন।
রবীন্দ্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ হওয়ার শুরু সুদৃপ্তদার হাত ধরেই। তাঁর কাছে যেকোনও বিষয়েই প্রশ্ন করা যেত। সুপ্রিয়দাও বড় বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতেন যদিও, কিন্তু কর্মব্যস্ততার জন্য সবসময় তাঁকে পাওয়া যেত না। পাঠভবনের রাশভারী অধ্যক্ষ হিসেবে বরং একটু ভয়ই লাগত। সুদৃপ্তদাই দেখালেন পড়ার বাইরে প্রকৃতির জগৎ। নানারকম তথ্যে সমৃদ্ধ করে তিনি নিয়মিত জানতে চাইতেন আমরা নতুন নতুন কী দেখেছি। ছোটবেলায় স্বভাবতই অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে থাকার জন্য নতুনের দর্শন শুরু হল। কখনও বাড়িতে না জানিয়ে কোপাইয়ের ঘাট, ক্যানেল, জনবিরল প্রান্তিক, পলাশের লাল, কুমোরপাড়ার গরুর গাড়ির সঙ্গে সমৃদ্ধ হতে শুরু করলাম। সুদৃপ্তদা জানাতেন বা রবীন্দ্রনাথ যে যে জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন, সেখানে যাওয়া শুরু করলাম নিয়মিত। ক’দিন বাদেই পিসি ধরে ফেলল ব্যাপারটা। বাড়িতে না জানিয়ে একা একা ঘুরে বেড়ানোর জন্য শুরু হল প্রবল বকাবকি। সর্বক্ষণ নজরে রাখার জন্য উপায় না দেখে কিছু বন্ধুর প্ররোচনায় শুরু হল স্কুল পালানো। স্কুল পালিয়ে সাঁওতাল গ্রাম, সুরুল গ্রাম, কোপাই গ্রাম, নদী, লোকাল বাস— সমস্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হতে শুরু করল। পিসি জানে আমি স্কুলে যাই, স্কুলের দাদারা জানে আমি হয় লাইব্রেরিতে বা কাঠের ঘরে, সুদৃপ্তদা জানে বিকেলে ঘুরে বেড়াই, কেউ জানে না স্কুল পালাই। স্কুল পালানো শেষ অবধি আমার হবিই রয়ে গিয়েছিল যতদিন পড়াশোনা করেছি। এর মতো অ্যাডভেঞ্চারের বীজ রবীন্দ্রনাথই প্রোথিত করেন রক্তে, তা অনস্বীকার্য। রসদ জুটেছিল অবনীন্দ্রনাথের লেখা সেই স্বপ্নের জগৎগুলো থেকে। কখনও আমি বুড়ো আংলা, কখনও নালক, কখনও রাজকাহিনির রাজপুত রাজা প্রভৃতি।
এর মধ্যে আরও মাথা বিগড়েছিল রবীন্দ্রভবনের কিউরেটরদের দ্বারা। স্কুলফেরতা মিউজিয়ামে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আমার। এতটাই যে রক্ষীদের আর কিউরেটরের কল্যাণে আমার কারোর কাছে অনুমতি নিতে হত না। জানার আগ্রহ যার প্রবল, তাদের মানুষ ভালোবাসতে বাধ্য হয়, সেই প্রথম প্রমাণ পাই। সেই ছোটবেলাতেই রবীন্দ্রনাথের পাওয়া আসল নোবেল পর্যন্ত স্বহস্তে ধরে দেখেছি আমি। কিউরেটরদাদার নাম কখনই জানিনি। কিন্তু সেই আমাকে পুরো মিউজিয়াম ঘুরিয়ে নিয়ে দেখাত। রবীন্দ্রনাথ কোত্থেকে তরোয়ালগুলো পেয়েছিলেন একদিন জেনে প্রশ্ন করলাম তিনি কী যুদ্ধও করেছিলেন নাকি। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগত তার জুতোগুলো দেখে, কত বড় পা ছিল তার, তা আজও ভাবি। সঙ্গে মুসুর ডালের উপর আঁকা রবীন্দ্রচিত্র, শেষবারের মতো কলকাতায় আসা ট্রেনের বগির ছোট্ট সংস্করণ, গুরুদেবের হাম্বার গাড়ি, বড়ই প্রিয় আমার সেই মিউজিয়াম।
তখনও রবীন্দ্রসাহিত্যে প্রবেশ করিনি। ছোটদের জন্য গল্পের বই ও ছড়া বাদে আর কিছুই পড়া হয়নি। এই স্কুল পালানোও একদিন গেল ধরা পড়ে। শুরু হল কঠোর শাসন। ততদিনে একা একা ঘুরে শ্রীনিকেতনের আশেপাশের গ্রাম, সব মুখস্থ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে বন্ধুরাও যেত আমার সঙ্গে। এগুলো অন্য কেউ তৈরি করেনি, রবীন্দ্রনাথ আসলে কে, তাও জানি না। শুধু তিনি যা যা করতেন, তার গল্প শুনতাম, আর নিজেই করার চেষ্টা করতাম। ক্লাস সেভেনে এর জন্য রেজাল্ট খারাপ হতে, এবং বাড়িতে ঠাকুমা আমার চিন্তায় অসুস্থ হতে একদিন সবাই রাগের মাথায় বলে বসল ওখানে আর রাখবে না। আমিও রাজি হয়ে গেলাম কারণ বাড়ির জন্য, বাদকুল্লার বন্ধুদের ছেড়ে থাকতে বড়ই কষ্ট হত। দুটো জীবন ছিল ওখানে, এক প্রবল স্বাধীনতার বাইরের জগৎ, দুই প্রবল পরাধীনতার বাড়ির জগৎ। দুটোতে ঠিক খাপ খাইয়ে উঠতে পারতাম না। পরে ভেবে দেখেছি, এই চিন্তাও তৈরি করেছিলেন যিনি, তাঁর নামই রবীন্দ্রনাথ। যিনি শুধু সাহিত্যসম্রাট নন, শিশুমনের অধীশ্বর। শিশুদের নাড়িনক্ষত্র তাঁর জানা ছিল।
পরে বাড়িতে ফিরে এসে স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আরও মানিয়ে নিতে পারলাম না প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে। রেজাল্ট যে খারাপ হত, তা নয়। কিন্তু চার দেওয়ালের মধ্যে থাকা শিক্ষায় কিছুতেই মন বসত না। স্কুলের থেকে গৃহশিক্ষায় নিবিষ্ট হওয়ার জন্যে ফলাফলে উতরে যেতাম যদিও, কিন্তু স্কুলে ছিল প্রবল বিদ্রোহ। যেন মাষ্টারদেরই শিখিয়ে দিতে উদ্যত হয়ে পড়তাম শিক্ষা কাকে বলে জানাতে। কপালে জুটত নানাধরণের শাস্তি, রাস্টিকেট, বাবার প্রহার প্রভৃতি। সে এত ধরণের শাস্তি সেই আমলে এই ক্ষীণকায় সহ্য করেছে যে একটা আস্ত বই লিখে ফেলা যায়। পরে অনেক ভেবেছি স্কুলের সেই দিনগুলিকে নিয়ে। আক্ষেপ নয়, বরং আজও ভালো লাগে রবীন্দ্রনাথের তৈরি এই জীবনযাপনে। তাঁর সাহিত্যের বাইরেও একতা বড় জগৎ নিজের যাপনের সঙ্গে জড়িত। সেদিন সুদৃপ্তদা যদি রবীন্দ্রনাথ কে, তা না জানাতেন, তবে হয়ত কোনও এক খাঁচায় আটকে থাকা পাখির মতোই তৈরি হয়ে যেতাম আজ। কোনও বিশ্বভারতী গড়ার লক্ষ্য নেই, শুধু আছে একটা দর্শন, যার রাস্তা রবীন্দ্রনাথ, আর পাথেয় অবনীন্দ্রনাথ। তবে হয়ত রবীন্দ্রনাথ আমি হতে চাইনি। নইলে বিদ্রোহচারণে এত ধরণের শাস্তির সম্মুখীন তাঁকে কখনও হতে হয়েছিল বলে আমার কাছে তথ্য নেই।
অনেক কথা হল আজ, কিছুটা লেখার জায়গায় আর বাঁধ মানতে পারলাম না। মনের কথাই লিখে বসলাম তত্ত্ব বাদ রেখে। অনেকের মতো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অত পড়াশোনাও আমার নেই। হয়ত এই দর্শন বাংলা সাহিত্যের কোনও কাজেও আসবে না। তবু নিজে মনে করি, যে যা ইচ্ছে তাইয়ের জগৎ তিনি তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তার এক ক্ষুদ্রতম শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে যখন দেখি, সত্যিই এক আশ্চর্য প্রশান্তি আসে। বিশ্বভারতীর দুই বছর যেন জীবনের যাবতীয় পাঠ তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে কে কী হতে পারত বা পেরেছে, কখনই তা আমার বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করিনি। শুধু চলার পথটা যিনি তৈরি করেছিলেন, তার পথেই চলতে চেষ্টা করেছি, এবং ভবিষ্যতেও করতে চাই। এইটুকুই…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।