• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক উপন্যাসে সপ্তর্ষি মণ্ডল (পর্ব – ১)

অজ্ঞাত

( সত্য ঘটনা অবলম্বনে কল্পিত উপন্যাস )

১।।
ভোর পাঁচটা । সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো সন্দীপন । ক্লান্তি আজ শরীরকে গ্রাস করেছে তার । তবু নূতন উৎসাহে সে ক্লান্তি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলছে , কিছুটা হলেও । কাঁধের ওপর যা ঝুলছে ; তা নয় নয় করে কিলো বিশেক হবেই । এত বাঁধা বিপত্তি সকালের এই ঊষা লগ্ন প্রকট করেছে ছেলেটির এই সকাল জুড়ে , তবু মনের কোনো এক কোণায় প্রার্থনাচারিত হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে মনের এক কামনা ,
“ ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু” ।
নব আনন্দে ; বাঙলা ছেড়ে সুদুরে যাত্রা শুরু হয়েছিল গত পরশু ; সতেরই জানুয়ারি । রাজধানিতে বসে সন্দীপনের মনে পড়ে যাচ্ছিল বাড়ির দিনগুলো ; বন্ধু আর তাদের সাথে দেবা দার দোকানে কাটানো সন্ধ্যেগুলো ; যেগুলোতে ছিল নিকোটিনের আসক্তি । এখানে অবশ্য সেসব কিছুই নেই ; শুধুই ছুটে চলা আর ব্যাস্ততা । সে জানে সে আজ সবকিছু ছেড়ে চলেছে বহুদুরে ; বহুদুরে চলেছে তার বাবার শেষ স্মৃতিগুলো ফেলে রেখে ; আর ফেলে রেখে তার পুরনো চাকরি ; পুরাতন স্বপ্ন দেখা সেই অধ্যায়গুলো ।
বদলই জীবনের মূল – সেকথা সন্দীপন বেশ ভালভাবেই জানতো আর জানতো বলেই তার বন্ধু সমরেসের মতো সেও এস এস সি পরীক্ষার স্বপ্ন দেখত । দীর্ঘ আঠ বছর ধরে এই নিয়েই তো এতো সংগ্রাম । তবে দুজনেই বারবার একই জায়গায় গিয়ে আটকে পড়ছিল ; সেটি হল মেন্স পরীক্ষা । একদিন তো এই নিয়ে সমরেস বেশ আক্ষেপ করেই বলেছিল ,
— দেখ বন্ধু , পরীক্ষার প্রথম পর্যায় পার করা এখন আমাদের কাছে জল ভাত হয়ে গেছে । কিন্তু দ্বিতীয় ধাপ , খুবই কঠিন হয়ে উঠছে । এই গতিতে পরীক্ষা পাস করলে আমাদের আর চাকরি পেতে হবে না ।
এরই মধ্যে একদিন সুখবর ধেয়ে এলো তাদের কাছে । মিষ্টির প্যাকেট হাতে সন্দীপনকে আসতে দেখে সমরেসের মধ্যে আনন্দের মাত্রাটা আরও তীব্রতর হলো । বন্ধুকে বুকে টেনে নিয়ে সে বলে উঠলো ,
— অবশেষে একটা হেল্লা হলো তাহলে । শুভেচ্ছা আজ দুজনের জন্য । আর তার থেকেও বড় খবর দুজনের কর্মক্ষেত্র একই , ব্যাঙ্ক । একসাথে স্কুল ও কলেজ জীবন শেষ করে কর্মক্ষেত্র একই হবে এর থেকে আনন্দের আর কিছু হতে পারে না ।
কিন্তু পরক্ষণেই উল্টো দিক থেকে যে উত্তর ধেয়ে এলো তা সত্যিই সমরেসের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল । সন্দীপন বন্ধুর বুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বলে উঠলো ,
— আমি ব্যাঙ্ক জয়েন করছি না । আমি নিউ ইন্ডিয়া জয়েন করবো । ওর মাইনে বেশি ।
বন্ধুর এই সিদ্ধান্ত অবশ্য সমরেশ সেদিন মোটেও মেনে নিতে পারে নি । তাই তো বেশ চিৎকার করেই সন্দীপনকে সে বলে উঠলো ,
— কী পাগলামো এসব ! ভুলিস না আমাদের লক্ষ এস এস সি আর সেটা আজ নয় কাল আমরা পাবোই । তখন ৬ লক্ষ টাকা চাকরি ছাড়তে দিবি তুই ! মাথা খারাপ হয়েছে তোর !
সমরেসের কথায় মুচকি হেসে সন্দীপন সেদিন বলেছিল ,
— ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতে দেখবো । আগে এস এস সি পাস করি তো , তারপর ….
বন্ধুর কথায় রীতিমতো হতাশ হয়ে সমরেশ বলে ,
—- তোর অবশ্য বাবার অনেক টাকা কিন্তু আমার সেসব নেই । তুই বড় লোক মানুষ । যা তাহলে তোর পথেই এগো । তবে একদিন আমার কথাগুলো মনে পড়বে । সেদিন বিচার করে দেখিস , এই বন্ধুটা তোর ক্ষতি চায় নি রে ।
সন্দীপন অবশ্য বুঝতে পারে নি সে যুগে রেলের সামান্য পদে চাকুরিরত এক সাধারণ কর্মচারীর কাছে সত্যিই কি অনেক টাকা আসতে পারে । আর থাকলেও তার বাবা তাকে সেসব দেবে কেন তাও চাকরি ছাড়ার জন্য ! সে শুধু এই ভেবে চাকরিটা করতে চায় যে , এই চাকরিতে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ আছে আর ভারতে শহরগুলো ছাড়া এর পোস্টিং হয় না । অবশ্য সমরেশ তার সিদ্ধান্তের সমর্থন না করলেও অনেকেই তার সিদ্ধান্তের পাশে এসে দাঁড়ায় ।
এসব ভাবতে ভাবতেই রাত নেমে আসে । রাজধানীর বাতিগুলো নিভে আসে ধীরে ধীরে নৈশ ভোজনের পর । বাইরে চেনা প্রকৃতি পিছিয়ে চলেছে আর ভিতরে নতুনের সন্ধানে এগিয়ে চলেছে সে । আজ বাবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে তার , মাঝরাতে । বাবা থাকলে তাকে নিশ্চই একলা ছাড়তো না । অবশ্য এসব কি বাবা বুঝতো কিছু , নিজেই নিজের মনে বলে চলেছে সন্দীপন । এলজাইমারের প্রভাবে বর্তমানটা ভুলেই গেছিলো । ছেলে বউ কাউকেই চিনতে পারতো না শেষদিকে । তারপর একদিন চলে গেল । সেদিন আবার বিজয়া । কত ঝামেলা করে বাবার নিথর শরীরটা নিয়ে এসেছিল ওরা সেদিন । সন্দীপন চোখ বন্ধ করে সে সব দেখতে পাচ্ছে আজ । কষ্ট , যন্ত্রনা , নিজের আত্মীয় , প্রতিবেশি — মানুষ চিনেছিলো সে সেদিন । এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের কোন ভিজে যায় আর ওদিকে ভোরের কুয়াশায় ভিজে যায় প্রকৃতি ; আজ দুটোই সমার্থক । নীচে ঝুকে প্রশ্ন করে সে একবার,
—- কাহা পৌছা ?
দুবার জিজ্ঞাসা করলে উত্তর আসে ,
— সাত ঘন্টা লেট হ্যায় গাড়ি । দিল্লি পৌঁছতে তিন হো জায়গা ।
উত্তরটা শোনা মাত্রই তিন তলা থেকে নিচে নেমে ছুটে যায় সে বাইরের দিকে । তারপর বাইরের দরজাটা একঝলক খুলে যা দেখলো সে তা তার কল্পনার অতীত । বাইরের সব রং গ্রাস করেছে সাদা । দূর অবধি এই ঘন সাদা ছাড়া কিছুই নজরে আসে না । হতাশ হয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সন্দীপন , তারপর নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিতে মনে মনেই বলে ওঠে ; এই ঘন কুয়াশায় লেট হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় । তবে রাজধানী যখন ঠিক কিছুটা লেট মেক আপ করে নেবে ।
সময় এগিয়ে চলেছে যত , ততই টেনশন বেড়ে চলেছে । প্রতি ঘন্টার হাত ধরে লেটটাও কম বেশির অদ্ভুত খেলা খেলছে । এরই মধ্যে বিপদ হলো টুনডলা স্টেশনে । গাড়িটি ওখানে প্রায় আধ ঘন্টা দাঁড়িয়ে যখন , তখন হঠাৎ মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো সন্দীপনের । মায়ের ফোন , আর তাই জলদি ফোনটা ধরতে হলো তাকে ,
—- হ্যালো মা ।
—- কত দুর পৌছালি বাবা ।
—-মা , ট্রেন লেট থাকায় এখনও অনেকটা পথ বাকি । বুঝতেই পারছো …. সকালের কুয়াশা … হ্যালো … ট্রেন …. উফ কি জ্বালা রে ভাই …. কিছুই শোনা যায় না ।
এদিকে যখন মায়ের সাথে ছেলেটি ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত , ঠিক তখনই বগির মধ্যে একটা প্রবল চিৎকার ও শীঘ্রই একটা ঝামেলা সৃষ্টি হয়ে গেল । কথাকাটাকাটির মধ্যে বেশ বিরক্ত হয়ে সন্দীপন ফোনটি কেটে দিলো । মা অবশ্য এক দুবার চেষ্টা করলো ফোন করার , কিন্তু বারবার ফোন কেটে দেওয়ায় সে সকল চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়ে গেল । এক বুক চিন্তা নিয়ে মা ঘরের কাজ করতে চলে গেল ।
দূর থেকে এগিয়ে আসা , আস্তে থেকে ধীরে ধীরে জোর হতে থাকা আওয়াজে কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে এসেছে । কত ঘন্টা দেরিতে তারা এসেছে এসব হিসাবের সময় আজ কারুর নেই , সন্দীপনেরও একই হাল । এখন তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ভোপাল যাওয়ার কোন গাড়ি আছে এখন । অবশ্য সমস্ত রিসার্ভেশন সে করে এনেছিল নিজের সঙ্গে , কিন্তু ভাগ্য …. ঘড়িতে এখন বিকেল ৬ টা আর যে ট্রেন তাকে ভোপাল নিয়ে যেত সেটি বিকেল ৪টের সময় নতুন দিল্লি ছেড়ে চলে গেছে । ট্রেনের মধ্যে বসে বসেই ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করেছিল সে তবে লাভ হয়নি , কারন দোকান বন্ধ ।
ভিড় থেকে একটু সরে এসে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো ছেলেটি । পেটিএম খুলে কিছু ট্রেনের রিসার্ভেশন খুঁজে দেখলো সে । শেষমেষ দিল্লি নিজামউদ্দিন ব্যাঙ্গালোর রাজধানী এক্সপ্রেসে একটা সিট বুক হওয়াতে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে । ট্রেন ছাড়বে রাত ১১: ৩০ ।
ভিড় কাটিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বাইরে এসে দাড়ালো সন্দীপন । পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মা কে ফোন লাগালো সে এবার । ট্রেনে ঝামেলার কারনে মা কে আর ফোন করার সুযোগ পায়নি সে সেরকম । এতক্ষনে কিছুটা হলেও ফাঁকা হওয়া গেছে । ফোনটা দুবার তিনবার বেজে উঠতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো সেই চেনা আওয়াজ ,
— হ্যাঁ বাবু বল । কোথায় আছিস এখন ? সারাদিনে এই মনে পড়লো বুঝি মা কে তোর ?
ছেলে চুপচাপ মায়ের কথা শুনে যাচ্ছিল । এবার সিগারেটের কাউন্টারটা শেষ করে বলে উঠলো সে ,
—- মা , মা , এই মাত্র দিল্লী পৌছালাম । সকালে কুয়াশার জন্য ট্রেন দেরি করতে শুরু করে আর দেখতেই পাচ্ছ এতক্ষনে দিল্লি এসে পৌঁছেছে সে আজ । হিসাব মত প্রায় ৬ কি ৭ ঘন্টা লেট । যাই হোক , আমি ব্যাঙ্গালোর রাজধানীতে সিট পেয়েছি । নিজামউদ্দিন থেকে ট্রেন রাতে । কাল ভোর বেলায় ভোপাল নামিয়ে দেবে ।
—- দুগ্গা দুগ্গা । সাবধানে যেও আর এই বুড়িটার কথা মনে করে ফোন করে দিও । তুমি ওদিকে ফুর্তি করছো আর এদিকে আমি যে কত টেনশনে থাকি বুঝবে না তো । সারাদিনে দুপুর বেলা একটা ফোন করেছি , তাও উনি নয় , আমিই করেছি । লাড সাহেবের সময় নেই কথা বলার । পেছন থেকে এত ক্যাঙর ম্যাঙর হচ্ছে যে কোন কিছু শোনা গেলে হয় । চলন্ত ট্রেনেই পার্টি শুরু হয়ে গেছে যেন ।
সন্দীপন মায়ের কথা শুনেছিলো আর সমানে মুচকি মুচকি হেসে চলেছিল আর তারপর মায়ের কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে উত্তর দিলো সে ,
—- পার্টি নয় মা । ঝামেলা হচ্ছিল আমাদের কেবিনে । আসলে কি জানোতো আজ ট্রেন লেট করেছে সে ইস্যু আলাদা কিন্তু রাজধানীর খাবার , এসি , বিদ্যুৎ — সব পরিষেবা এত জঘন্য ছিল যে যাত্রীদের আওয়াজ তোলাটা সত্যিই প্রয়োজন ছিল। রাজধানী , শতাব্দীর মতো ট্রেনে এত এত টাকা ভাড়া দিয়েও মানুষ যাতায়াত করে শুধুমাত্র পরিষেবার জন্য আর যদি আই আর সি টি সি থেকে সেই পরিষেবা ঠিক মতো না পাওয়া যায় তাহলে আন্দোলন তো হবেই । এত দূরের গাড়ি চলছে অথচ ব্রেক ভ্যান জেনারেটর নেই ট্রেনে । স্টেশনে দাঁড়ালেই চার্জ ও অন্যান্য ইলেকট্রিক্যাল বস্তু কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল । খাবারের কোয়ালিটি ভালো তো ছিলই না , উপরন্তু সেগুলো ঠান্ডা পরিবেশন করা হচ্ছিল । এসব কতক্ষন সহ্য করা যায় বলো । যাই হোক , এখন ফোন রাখছি আমি । আমাকে আবার নিজামউদ্দিন বেরোতে হবে । তুমি সাবধানে থেকো মা ।
এই বলে সন্দীপন ফোনটা কেটে দিয়ে একটা সিগারেট ধরালো এবার । ওপাশে মা দুগ্গা দুগ্গা বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিজের কাজে ।
প্রায় কুড়ি কেজি ভার দুকাঁধে ঝুলছে । ভোরে আলো আবছা হয়ে ফুটেছে এখন । লোকজনের ভিড় আসেপাশে বেশ উল্লেখযোগ্য । ব্যাঙ্গালোর রাজধানী থেকে ভোপাল স্টেশনে নামা ছেলেটি একপা একপা করে এগিয়ে চললো ওভার ব্রিজের দিকে । সব কিছু নতুন হলেও এক আলাদা আনন্দ তার গোটা চোখ মুখ জুড়ে ঝরে পড়ছে । সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালো সে । ডিভিশনাল একাউন্টেন্ট পদে এস এস সি পাস করা সন্দীপনের পোস্টিং এই মধ্য প্রদেশে । সেই জন্যই তার এই আগমন । ইচ্ছে আছে আজই এজি ভোপালে গিয়ে জয়েনিং প্রসিডিওরগুলো শেষ করে নেওয়ার । তবে এই মুহূর্তে সে চিন্তা মোটেও তার কাছে মুখ্য নয় । এই মুহূর্তে চিন্তা তার এক জায়গায় এসেই আটকা পড়ছে বারবার । তবে মুখে সে সব কিছুই প্রকাশ হতে না দিয়েই এক মুখ হাসি নিয়ে নিজেই নিজেকে উৎসাহ দিচ্ছে সে বারবার
—- গুড মর্নিং ভোপাল ।
২।।
— সাহাব কহা জায়েঙ্গে ?
বেশ উদগ্রীব স্বরে স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি অটো প্রশ্ন করলো সন্দীপনকে । কাঁধ থেকে ঝোলা তিনটে নামিয়ে রেখে ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বের করে সবে এক ঢোক জল খেয়েছে সে , হঠাৎ এই প্রশ্নে একপ্রকার ঘাবড়ে গিয়ে বিষম খেয়ে উঠলো সে । দেখা মাত্রই ড্রাইভারটি তৎক্ষনাৎ অটো থেকে নেমে এসে তার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে একই প্রশ্ন করলো আবার ,
— সাহাব কহা জায়েঙ্গে ?
সন্দীপন মুখের মধ্যে ঢেলে দেওয়া জল গিলতে গিলতে উত্তর দিলো ,
—- সস্তা হোটেল কহা মিলেগা ইহা ?
—- কিতনে দিন কে লিয়ে চাহিয়া সাহাব ?
অটো ড্রাইভারটি সন্দীপনকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করায় , সে একটু মাথা চুলকোতে চুলকোতে উত্তর দিলো ,
—- উহ তো নেহি পতা । অভি নৌকরি কে লিয়ে আয়া হু । উসকা পোস্টিং কহা হোগা কেয়া পতা । সব মিলাকর কুছ নেহি কহ সকতে । অভি হোটেল লে চলো , ফির অফিস যাকে পতা করতে হ্যায় । বাদ মে কিসি বয়জ হোস্টেল …
ততক্ষনে অটো চালকটি গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেছে । আপাতত মহারানা প্রতাপ নগর ; ফেস ২ তে দৈনিক ৭০০ টাকার বিনিময়ে একটি হোটেল পাওয়া গেলেও , খরচটা বেশ চিন্তায় রাখলো সন্দীপনকে । বাড়ি থেকে তেমন কোন টাকা আনে নি ; এই মুহূর্তে মাইনেও হবে না আর আগের চাকরিটা জোর জুলুম করে ছেড়ে আসার ফলে ওখানেও স্যালারি বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দিয়েছে কোম্পানি । এসব মিলিয়ে চিন্তার স্রোত কুড়ে কুড়ে খেয়ে চলেছে তাকে । আবার বাবার রেখে যাওয়া সামান্য টাকা আর পেনশন মায়ের একমাত্র সম্বল । তাই সেখান থেকেও কিছু চাইতে পারছে না সে । বাড়িতে ফোন করলে তাই এসব এড়িয়ে যাচ্ছে সুনিপুণভাবে সন্দীপন দত্ত ।
অফিসের প্রথম দিন আজ । হোটেলের কামড়ায় বসে বসে দরকারি কাগজগুলো গুছিয়ে নিলো সে । তারপর আস্তে করে মোবাইলে বাড়ির নাম্বার ডায়েল করলো । দুটো রিং হতে না হতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো ,
— হ্যালো । বাবাই । কোথায় এখন ?
—- মা । আমি ভোপাল পৌঁছে গেছি । আপাতত একটা হোটেলে আছি । এখন অফিস বেড়োবো তাই ফোন করেছিলাম জানাতে , উত্তর দিলো সন্দীপন ।
—- সাবধানে যাস বাবু । আর কোন টাকাপয়সার দরকার হলে আগে ভাগে বলে রাখিস । আমি ব্যাংকে জমা করে দেবো , কেমন ।
সত্যি কথা হজম করে নেওয়া সত্যি খুব কষ্টের । সন্দীপনের আজ টাকার সত্যিই প্রয়োজন কিন্তু একজন একলা বিধবা মাকে এই নিয়ে চাপ দেওয়া উচিত নয় । এই অদ্ভুত দোলাচলের মধ্যেই সে ফোনটা কেটে দিলো এবং রুমের দরজায় তালা ঝুলিয়ে হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লো । এবার লক্ষ একাউন্টেন্ট জেনারেল অফিস , আরেরা হিলস । অন্যদিকে কয়েক যোজন দূরে একলা সেই বৃদ্ধা মা একা ফোনটা তার বিছানায় রেখে দুগ্গা দুগ্গা বলতে বলতে ভেতরের ঘরে চলে গেলো , বিশ্রাম করতে ।
অরেরা হিলস , সহজ কথায় ভোপালের অফিস পাড়া । রিজার্ভ ব্যাংকের ঠিক পিছনে যে বাড়িটি সেটিই একাউন্টেন্ট জেনারেল অফিস । ঘড়িতে তখন সকাল ১১:৩০ । যদিও হোটেল থেকে দশটার মধ্যে বেড়িয়ে পড়েছিল সন্দীপন আর অফিস তার হোটেল থেকে বেশি দূর নয় ; তবু অটো জায়গাটি ঠিক করে চিনতে না পারার জন্য একটু দেরি-ই হয়ে গেলো তার পৌঁছাতে । অডিট আর একাউন্টস দুটি অফিস পাশাপাশি থাকায় , সেখানে ডাব্লু এম ১ সেকশন খুঁজে নিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাকে । সব মিলিয়ে এই ১১:৩০ ।
সেকশনের সামনে যাওয়ার আগে সন্দীপন নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলো । সমস্ত ডকুমেন্টস ঠিক করে সাজিয়ে সে এসে উপস্থিত হলো দরজার সামনে , তারপর বেশ নিচু গলায় বললো ,
—- মে আই কাম ইন স্যার ?
দরজার পাশেই একজন মোটা ভদ্রলোক বসে আছেন । মাথায় হালকা টাক , দাড়ি নেই তবে মোটা একটা গোঁফ আছে । সবাই তাকে গুপ্তা জি বলে ডাকছে । তার পাশের চেয়ারটি ফাঁকা আর তৃতীয় কেদারায় এএও মুলানি জির পাশে বসে আছে নরোত্তম । উল্টো দিকে দুজন ম্যাডাম এবং একজন লোক বসে । তাদের আকার আকৃতি ঠিক করে সে অনুধাবন করতে পারতো , তার আগেই গুপ্তা জি নিজস্ব কায়দায় ডাক দিলেন তাকে ,
—– আ জাও । বোলো । কেএয়া কাআম হ্যায় ।
সন্দীপন এক মুখ হাসি নিয়ে উত্তর দিলো ,
—- উও স্যার জয়ন করনে কে লিয়ে আয়া থা ।
মুখের দিকে না তাকিয়ে খাতায় কিছু একটা লিখতে লিখতে গুপ্তা জি প্রশ্ন করলো আবার ,
— নাম !
—- সন্দীপন দত্ত ।
উত্তর দিলো সন্দীপন ।
এবার বেশ উৎসাহ নিয়ে হাসি মুখে মুখ তুলে তাকালেন তিনি । প্রথমে সন্দীপন ভেবেছিলো যে তাকে হয়তো চিনতে পেরেছেন গুপ্তা জি , কারন জয়েনিং আগে এক দু বার তার সাথে ফোনে কথা হয়েছিল সন্দীপনের , কিন্তু তার পরের মুহূর্তেই সে আবিষ্কার করলো যে একটি কালো সালোয়ার পরা মেয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে । গুপ্তা জি তার দিকেই তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ,
—- নাম ?
মেয়েটি আস্তে করে নিচু গলায় উত্তর দিলো ,
—- নিশা চৌবে ।
গুপ্তা কিছুক্ষন আবার ওর দিকে তাকিয়ে থেকে , মাথাটা নিচে খাতার দিকে নামিয়ে নিলেন । হাতের কলমটা কিছুক্ষন একই অবস্থায় ধরে রাখার পর , মুখটা তুলে নিশা ও আমার দিকে এক এক করে ফিরে তাকালেন এবং বললেন ,
—- ডকুমেন্টস ইহা জমা করো । আপন সাইন করেঙ্গে তব মুলানি স্যার কে পাস দে দেনা ।
সন্দীপন ব্যাগ থেকে ডকুমেন্টস বের করে গুছিয়ে নিতে নিতেই পিছন থেকে নিশা ডকুমেন্টস জমা করে দিল । সন্দীপনও জলদি করে নিজের সমস্ত ডকুমেন্টস জমা করলো টেবিলের ওপর ।
এরপর কিছুক্ষনের অপেক্ষা করে নিশাকে মুলানি স্যারের কাছে ছাড়পত্র দিলেও আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন ,
—- সব কুছ কহা হয় ? আসলি চিজ তো দিয়েই নেহি । আপন নেহি ভেজ সকতা ইসে আগে ।
সন্দীপন এই শোনা মাত্রই তার চোখ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে এলো । চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে টেবিলের সামনে । তার মাথায় একটাই জিনিস ঘুরছে তখন শুধু ,
আসলি চিজ কেয়া হ্যায় !! ডকুমেন্টস !! রিসওয়াত !! য়া কুছ ঔর !!
—— স্যার ! কোনসি চিজ নেহি হেয় ইহাপর ।
গলার স্বর নামিয়ে প্রশ্নটা গুপ্তা জির দিকে ছুড়ে দিতেই , তিনি বড় বড় চোখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো , যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে ,
—– তুমহারা এড্রেস ভেরিফিকেশন কহা হ্যায় ? এড্রেস ভেরিফিকেশন মাঙ্গা গেয়া থা কি নেহি !
নিশারও ততক্ষনে সমস্ত কাজ শেষ হয়ে গেছে এবং অন্যদিকে ইতিমধ্যে দরজার বাইরে অপেক্ষমান নতুন জয়েনিং এর বাকিরা । গুপ্তা জির গম্ভীর স্বরে চিৎকার শুনে তারাও বেশ হতচকিত হয়ে গেছে । এদিকে সন্দীপনের চোখের সামনে পরিষ্কার ভেসে উঠছে সেই দিনটা ।
সকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল । তারই মধ্যে সে বাইক নিয়ে রূপনারায়নপুর থেকে রওনা দিল আসানসোল জেলা হাসপাতালে মেডিক্যাল টেস্ট করতে । যেহেতু ভোপাল এর এই অফিস মেডিক্যাল করিয়ে আনার ছাড়পত্র দিয়েছিল যে কোন জেলা হাসপাতাল থেকে , তাই এই সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় নি । মেডিক্যালের সমস্ত ছাড়পত্র পেতে পেতে দুপুর হয়ে গেল । ঘড়িতে তখন ০১:১০ । বৃষ্টিটাও একটু কম হয়েছে । তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো সাব ডিভিশন অফিস হয়ে বাড়ি ফিরবে । যদি বলে কয়ে রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেটটা জোগাড় করা যায় ।
এস ডি ও স্যার তখন মিটিংয়ে ব্যস্ত । সন্দীপনকে তাই বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো । এস ডি ও স্যারের পার্সোনাল এসিটেন্ট দুপুর দুটোয় এসে উপস্থিত হলে , সে আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে হাজির হলো চেম্বারের দরজার সামনে । আস্তে করে ভেতরে মাথা ঝুকিয়ে সে অনুমতি নিলো এবং তারপর ধীরে ধীরে ভিতরে উপস্থিত হলো ।
—– বলুন , কি সেবা করতে পারি ।
ভদ্রলোক ছেলেটির দিকে না তাকিয়ে , নিজের টেবিল গোছাতে গোছাতে বললো । সন্দীপন কয়েক মিনিট চুপ করে থাকলো , তারপর আস্তে করে জয়েনিং এর চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো ,
—– একটা রেসিডেন্সিয়াল চাই তিন দিনের মধ্যে ।
ভদ্রলোক এবার মুখ তুলে বড় বড় চোখ করে তাকালো সন্দীপনের দিকে , তারপর ঘাড় নেড়ে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো । এদিকে সন্দীপন কোন উত্তর না পেয়ে আবার একবার শান্ত গলায় একই প্রশ্ন করতেই , সেই সরকারি ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বলে উঠলো ,
—— হবে না । আগে দেখো ।
সন্দীপনের কাছে তার উত্তর একটি অপমান মনে হলেও সে শান্ত গলায় আবার একবার স্যার বলতেই ; সরকারি সেই কর্মচারী সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে , তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বললো ,
—— বললাম তো হবে না । ফর্ম ভরুন । পুলিশ ভেরিফাই করুক । তারপর পাবেন । অন্তত ১ মাস ।
—— দেখুন । পুলিশ ভেরিফিকেশন আমার হবেই । সরকারি চাকরিতে সব জায়গায় হয়েই থাকে । কিন্তু এই রেসিডেন্সিয়ালটা ওরা আলাদা করে চেয়েছে তাই….
সন্দীপনের কথা শেষ না হতেই , এস ডি ও অফিসের সেই সরকারি লোকটি রীতিমতো জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এসে চিৎকার করে বললো ,
—– গেট লস্ট । সরকারি চাকরির নিয়ম শেখাতে এসেছেন উনি , আমাকে শেখাবে সরকারি চাকরি । গেট লস্ট । নিয়মের বাইরে আমি কিছু করতে পারবো না । আর যদি তাও লাগে , যারা চাইছে তাদের বাড়িতে এনে , রেখে নিজের বাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে যান । হয়ে যাবে ভেরিফিকেশন ।
সন্দীপন এতক্ষন ধৈর্য্য ধরে সব সহ্য করছিল । তবে এবারের কথাগুলো আর হজম হলো না তার । রীতিমতো চিৎকার করে সেও বলে উঠলো ,
—- এই যে শুনুন , আপনি কতটা জানেন সেটা আমি জানি না আর জানতেও চাই না । এটা ভারত সরকারের নিয়োগ পত্র , যেটা আমার হাতে গতকাল এসেছে । আমাকে আগামী তিন কি চার দিনের মধ্যে জয়েন করতে যেতে হবে আর ভারত সরকার এই সার্টিফিকেট যখন চেয়েছেন তখন এটি নিশ্চই পাওয়া সম্ভব । এখন কিভাবে সেটা সম্ভব সেটা আপনি জানবেন । না জানলে স্যারের কাছে যেতে দিন , যা বলার উনাকেই বলবো । দেখি , কি করে একটা রেসিডেন্সিয়াল দিতে আপনাদের ১ মাস , ২ মাস ; আবার কারুর কারুর ৩ মাস লেগে যায় । শালা আপনারা যা পারছেন তাই করে চলেছেন । স্যার কোথায় বসেন এবার সেটা বলুন তো ভালোয় ভালোয় ।
সরকারি সেই বেতনভোগী কর্মচারী তো চুপ । মুখে কোন রা নেই আর ; এদিকে প্রবল চিৎকারে বাইরে সাধারণ মানুষের ভিড় জমে গেছে রীতিমতো , কেউ কেউ আবার বলছে ,
—– এত দিনে ঠিক লোকের পাল্লায় পড়েছে ব্যানার্জি বাবু । খুব যা তা করতো । ঠিক বলেছে ছেলেটি ।
একজনকে তো এও বলতে শোনা গেল ,
—— ছেলেটির ধৈর্য্য আছে । আমি হলে তো কষিয়ে দিতাম দু গালে । শালা ঘুষখোর সব ।
সন্দীপন মৃদু হেসে ভদ্রলোকের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হুংকার দিয়ে বললো আবার ,
—– শুনছেন তো । জনগন আপনাদের নিয়ে কি বলছে । এখন বলুন , উনাদের হাতে এই কেসটা তুলে দেবো । শালা , একটা মার বাইরে পড়বে না , বুঝেছেন ।
এস ডি ও র সেই পার্সোনাল এসিস্টেন্ট ভয়ে ধীর স্বরে বসতে বললো তাকে । তারপর আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে বললো ,
—– দেখুন , নিয়ম বলে একটা জিনিস আছে । আমরা কিসের ভিত্তিতে আপনাকে রেসিডেন্সিয়াল দেবো বলুন । বিডিও স্যার যদি সার্টিফাই করে দেন , তাহলে আমরা দিয়ে দেবো ।
চেয়ার ছেড়ে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সন্দীপন বললো ,
—– এই কথাটা ভালো ভাবেই বললেই হতো । তা নয় অপমান করে গেলেন সকাল থেকে । শুনুন মশাই , এখানে কেউ অপমানিত হতে আসে নি । ভবিষ্যতে সেদিক খেয়াল থাকে যেন ।
এরপর সন্দীপন দুবার বিডিও স্যারের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছিল , তবে দেখা মেলেনি । অবশেষে ফোন করে সে গুপ্তা জিকে সব জানায় । গুপ্তা জি তাকে ওই সার্টিফিকেট ছাড়াই চলে আসার অনুমতি দেন । আজ সেকশনে দাঁড়িয়ে একথাগুলোই সে পুনরায় মনে করিয়ে দিলো ।
৩।।
অফিস ক্যান্টিন । চেয়ারে বসে কেউ চা , কেউ কফি , কেউ দুধ , আবার কেউ দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত । সুবিশাল এই হলের বামদিক চাপা কোনায় কিছু জন চেয়ারে গোল করে বসে আছে । প্রথমে হালকা মোটা , গায়ে কি সব লাল সাদা দাগ , সন্দীপন । পাশে রোগা মত একটি ছেলে , উচ্চতা ৫ ফুটের মতো ; নাম রজত । তার পাশে নিশা । তার পাশে রোগা , লম্বা একটি ছেলে ; নাম রজত । তার ডানদিকে ছোটখাট একটি ছেলে , নাম আরিফ । পাশে লম্বা দুজন , যথাক্রমে অজিত ও অঙ্কিত ।
—– আজ কি চায় দাদা কে নাম ।
নিশা একথা বলে উঠতেই সকলের দৃষ্টি একসাথে এসে জড়ো হলো সন্দীপনের দিকে । তারপর এক সাথে সকলে মিলে বলে উঠলো ,
—— দাদা , টিম ভোপাল মে আপকা সোয়াগত হয় ।
সন্দীপন এতক্ষন ধরে চুপচাপ বসে ছিল । সকলের এই অভ্যর্থনা তাকে বেশ পজিটিভ করে তুলেছে । সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে ক্যান্টিন বয় কে হাঁক দিয়ে বললো ,
—- ভাইয়া , সবকে লিয়ে চায় আউর গরম সমোসে ।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল । বাড়ির থেকে এত দূরে বসে থাকলেও সকলের ভালোবাসা সন্দীপনকে সব ভুলিয়ে রেখেছিল । আজকাল তো মা কে ও ফোন করতে ভুলে যায় সে । তবে ওই একটা চিন্তা তাকে বেশ ভোগাচ্ছিল , ঠিকানা , টাকা । একদিকে যখন সে প্রতিটি দিন কাটাচ্ছে হিসাবের মধ্যে , ঠিক তখনই একটি ইমেল তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে এই কদিনে । অফিসের ক্যান্টিনে বেশি দেখা যায় না আর , দেখা গেলেও চুপচাপ বসে থাকে । এমন নয় যে বিষয়টি কলিগদের নজর এড়িয়ে গেছে , তবু তারা সাহস করে জিজ্ঞাসা করে নি । এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল , কিন্তু সোমবার সন্দীপনের সাথে যা ঘটে গেল , তা তার সমস্যা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল । সোমবার বিকেলে হোটেলে পৌঁছালে হোটেল এর রিসেপশনে তাকে জানানো হয় ,
—– স্যার , আপ বহত দিনো সে ইহা পর হয় , ভাড়া ভি মিল রহা হয় ; ইসলিয়ে কহনে মে খারাব লগ রহা হয় । লেকিন কহনা পড়েগা স্যার ….. স্যার , কাল শাম তক আপকো হোটেল ছোরনা পড়েগা । পুলিশ আয়া থা , কহ কে গয়া হয় ।
খবরটা শোনা মাত্রই সন্দীপনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো । মঙ্গলবার সকাল থেকেই কোন পাত্তা নেই তার । থাকবে কি করে ! এক বেলার মধ্যে একটা নতুন ঠিকানা খুঁজতে হবে । তারই ব্যস্ততা গ্রাস করেছে আজ । রাস্তায় একটি অটো ভাড়া করে শহরের সস্তা হোটেল ঘুরে বেরিয়েছে সে , সব খুলে বলেছে তাদের । কিন্তু কোন রুম ফাঁকা থাকলে তো ! এরই মধ্যে কয়েকদফা মোবাইলটা বেজে উঠলো , কিছু ফোনকল কেটে দিলো সে আর কিছু কেটে গেলো রিং হতে হতে । সমস্যা হলো ফোন যে করেছিলো সে হলো সন্দীপনের মা । ফলে ছেলের খবর না পেয়ে , রীতিমতো চিন্তিত ও অস্থির হয়ে সে ছুটলো বাড়ির পাশে , সমরেসের বাড়িতে , তার মা লাবণ্যের বাড়িতে । সন্দীপনের মা কে রীতিমতো হাঁপাতে হাঁপাতে গেট খুলতে দেখে লাবণ্য দত্ত বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো । মনে মনে নানা উৎকণ্ঠার কথা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে এসে বললো ,
—- কী হয়েছে ? সব ঠিক আছে তো ? সন্দীপনের কী খবর ? এত হাঁফাচ্ছেন কেন দিদি ? ভেতরে আসুন ।
—- ছেলেটার ….
এটুকু বলেই শাড়ির আঁচলে ভিজে দুচোঁখ মুছে ঘরের ভেতরে এসে দাড়ালো সন্দীপনের মা , ভারতী ।
লাবণ্যের বুঝতে একটুও বাকি রইল না যে সন্দীপনের কিছু একটা হয়েছে কিন্তু ঠিক কী হয়েছে তা জানার জন্য ভারতীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন ,
—– ছেলেটার কী হয়েছে ? সে ভালো আছে তো ।
—- সেটাই তো জানি না । আজ সকাল থেকে প্রায় পাঁচ থেকে ছ বার ফোন করলাম , কিন্তু ধরলো না । বেশ কয়েক বার কেটে দিলো । বুঝতে পারছি না , ও কোন বিপদে পড়লো না তো !
কাঁদো কাঁদো গলায় ভারতী বললো ।
—– সব ঠিক হবে । নিশ্চয়ই ব্যস্ত আছে ।
এটুকু বলেই সমরেসের মা , প্রতিবেশীকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো বটে কিন্তু নিজেকে নিজেই শান্ত রাখতে পারলো না এবং ঠাকুর ঠাকুর করে প্রণাম করতে লাগলো বারবার ।
তখন বেলা বারোটা । ক্লান্ত হয়ে ঘেমে নেয়ে সন্দীপন এসে হাজির হলো অফিসের সামনে । বাইরে লোক বলতে ওই মালি আর দারোয়ান । এদের পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতেই তার দেখা নরোত্তমের সাথে । এত দেরি করে অফিস আসতে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলো সে । বললো ,
—- কেয়া জি । ইতনা দেরি । তবিয়ত তো ঠিক হয় না ।
এরই মধ্যে পিছন থেকে এসে উপস্থিত আরও দুটি ছেলে ; ২৫ কি ২৬ বয়স হবে । নরোত্তমকে দেখতে পেয়ে তার দিকেই এগিয়ে গিয়ে বললো ,
— কেয়া নরোত্তম । কিসকা তবিয়ত খরাব হয় ?
—- উওহ দাদা আজ লেট আয়ে তো উসি লিয়ে হাল চাল পুছ রহা থা । কহি তবিয়ত তো খরাব নেহি হুই উনকি । ওয়েসে দাদা সে মুলাকাত হুয়া কি নেহি ?
নরোত্তম উত্তর দিলো । এরই মধ্যে সেকশন থেকে তার খোঁজ করায় সে এইটুকু বলেই স্থানত্যাগ করলো । সন্দীপন-ও গুটি গুটি পায়ে তাকে অনুসরণ করলো । বাকি দুজন লিফটের দিকে এগিয়ে গেলো ।
ক্যান্টিন এর ফাঁকা ঘর । কোনায় একলা কেদারায় বসে সন্দীপন । মোবাইলে হালকা চালে গান চলছে বটে , কিন্তু মন সে দিকে নেই তার । কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সে । এরই মধ্যে মোবাইলটা বেজে উঠলে অবচেতন মন তার খানিকটা চেতনায় ফিরে আসে । ফোনটা রিসিভ করলো সে এবার ,
—- কি রে , সকাল থেকে ফোন ধরছিস না । কি হয়েছে তোর !
সমরেসের সেই চেনা গলা ভেসে এলো ওপাশ থেকে ।
সন্দীপন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো । যেন গুছিয়ে নিচ্ছে নিজেকে , কি বলবে সে , তারপর উত্তর দেয় ,
—- ঠিকানা খুজছিলাম । যে হোটেলে ছিলাম সেখানে পুলিশ এসে বলে গেছে , কাউকে বেশি দিন রাখা যাবে না । তাই ….
—- তোর ডকুমেন্টস দেখাস নি ! তুই কেন এসেছিস , কি জন্য …. এসব বলিস নি ওদের ।
সমরেস বেশ অবাক হয়ে উত্তর দেয় ।
সন্দীপনের আজ কথা বলার একটুও ইচ্ছে নেই । তবু বন্ধুকে সে সব বুঝতে না দিয়ে বলে চললো ,
—- ওরা মানতে চাই নি । আর তাই আজ বিকেলে হোটেল ছেড়ে দিতে হবে ।
—– তা কিছু ব্যবস্থা হলো তোর ?
সমরেস জানতে চায় ।
সন্দীপন নিজের খেয়ালেই বলে চললো ,
—- হয়েছে । তবে খুব ভালো কিছু নয় । একটা বয়েজ হোস্টেলে …. সিঙ্গেল রুম , ছয় হাজার টাকা । তুই ফোনটা রাখ । মা ফোন করছে ।
এই বলে সে , সমরেসের ফোন কেটে দিয়ে , দ্বিতীয় কলটি রিসিভ করলো এবার । আজ ক্লান্ত ছেলেটি , খেয়াল করে নি ফোনটি কার । সকাল সকাল হোটেল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল একটুকরো আস্থানার খোঁজে । অচেনা এই দেশে , অচেনা মানুষগুলো তাকে সাহায্য করবে কেন ! কতটুকু জানে তার সম্বন্ধে ! এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সে হোটেল থেকে বেড়িয়ে এসে দাঁড়ায় বড় রাস্তার সামনে । কোথায় যাবে , কি বলবে কিছু জানা নেই তার । এরই মধ্যে কোথা থেকে এক অটো ওয়ালা এসে উপস্থিত হলো তার সামনে । বেশ চিন্তিত দেখে জিজ্ঞাসা করলো ,
—- সাহাব , কেয়া বাত হয় ।
সন্দীপন তখন কোন কিছুই বিস্তারে বলতে পারে নি , শুধু বলেছিল ,
—- ভাড়ে পে ইহা কোই রুম মিলেগা ? কোই হোস্টেল ওয়াগেরা ।
অটো ওয়ালা কিন্তু না বলে নি । অটোর পিছনে বসিয়ে এম পি নগর ও অরেরা হিলস সংলগ্ন বয়জ হোষ্টেলগুলি একের পর এক দেখাতে শুরু করে । কোথাও ঘর পছন্দ হয় না তো কোথাও তাকে থাকতে দেবে না বলে সরাসরি জানিয়ে দেওয়া হয় । অটোর পিছনে বসে সন্দীপন ছুটে বেড়াচ্ছে শহরের এ কোনা থেকে অন্য কোনা । খিদেতে পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে আর বাইরে দৌড়াচ্ছে সে । থামছে , নামছে , কিছু সময় কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু । একটা সময় সে ধরেই নিয়েছিল যে কোন সুরাহা হবে না আর । ঠিক সেই মুহূর্তে তারা এসে উপস্থিত হল ১২ নম্বর বাজারের কাছে । এখানে একটি ফ্ল্যাট আছে , ওয়ান বি এইচ কে ; ডান দিকের একটি সরু গলির ভিতরে । সন্দীপন গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সেই দিকে ।
তার কাছে উপায় যে কিছুই নেই , রাজি হওয়া ছাড়া । মাসিক ভাড়া ৬০০০ টাকা , ইলেক্ট্রিসিটি আলাদা । যখন থাকার ব্যবস্থা ফাইনাল হয় তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোর ঘর ছুঁই ছুঁই । তাই সেই অটো করেই সে সোজা উপস্থিত হয় অফিসে ঘেমে স্নান করে । এর মধ্যে মায়ের এক গাদা নম্বর আজ কল লিস্টে এসে জমা হয়েছে , কিন্তু সে সময় হয়নি তার ঘুরিয়ে কল করার । আর এখন ফোন বেজে উঠতে সন্দীপন কোন কিছু না দেখেই ধারণা করে নেয় যে , এ কল নিশ্চই তার মায়েরই করা । ফোনটা ধরেই হ্যালো বলতে না বলতেই ওপাশ থেকে এক চেনা কিন্তু অপ্রত্যাশিত গলা ভেসে এলো তার কানে ।
—– হ্যালো । সন্দীপ জী । ড্রয়ার খুল্লা হ্যায় কেয়া ?
৪।।
বাংলা ছেড়েছে আজ হপ্তা খানেক হয়ে গেছে । এর মধ্যে মা আর সমরেস ছাড়া সেভাবে অন্য কারুর সাথে কথা হয় নি সন্দীপনের । আজ এই চেনা কন্ঠস্বর শুনে একটা আলাদা আনন্দ চোখে মুখে ভরে উঠল তার , তবে তার পাশাপাশি পুরোনো কোম্পানির কোন চাল হতে পারে তাকে খুঁজে বের করার এই ভেবে সে কিছুটা সাবধান হয়ে গেল । পরক্ষনেই মনে জেগে উঠলো সেই বিখ্যাত কবিতার লাইনগুলোর কথা —
” সাবধানিরা বাঁধ বাঁধে সব , আমরা ভাঙি কুল ” ….
এই কুল ভাঙার স্বপ্ন নিয়ে প্রবল উদ্যমে সে উত্তর দিলো ,
—- কে বলছেন ?
ওপাশ থেকে কিছুর হাসির ধ্বনি শোনা গেল এবার আর তারপর তারই মাঝখান থেকে সেই চেনা কন্ঠ বলে উঠলো আবার ,
—– আমাদের ভুলে গেলেন অফিসার ! নতুন চাকরিতে ঢুকে ঢুকেই , মাল কামাতে শুরু করেই পুরোনো লোকেদের ভুলে গেলে অফিসার ।
বেশ চিনতে পারছিলো সে , এ নিউ ইন্ডিয়া থেকে স্নেহাশীষ চক্রবর্তী ফোন করেছে তাকে , কিন্তু কেন এটা বোঝা হয় নি এখনো । তার ভাবনাগুলো এখনো জানে না , এটা নরম্যাল কল নাকি স্পেশাল কিছু । তাই সে সাবধানতা আরো খানিকটা বাড়িয়ে উত্তর দিলো এবার ,
—— স্নেহাশিষ দা হঠাৎ ! এত দিনে মনে পড়লো আমায় ?
ওপাশ থেকে সেই চেনা পরিচিত হাসি হেসে স্নেহাশিষ উত্তর দিলো ,
—— ঠিক তা নয় । সময় পাই না । আজ একটা বিশেষ কারনে ফোন করতে হলো । দেখো পরি কি বলবে তোমায় ।
সন্দীপন কিছু বলতো তার আগেই পরিতোষের গলা ভেসে এলো ওপাশ থেকে ,
—– কেমন আছো ? কোথায় আছো ?
উত্তর দেবে কি দেবে না , দিলে ঠিক কি বলা উচিত হবে এসব আজ বেশ ভাবাচ্ছে আর সবার ওপরে ভাবাচ্ছে যে স্নেহাশিষ দা র বিশেষ কারণটি কি !
—- ভালো আছি পরি দা । তোমরা কেমন আছো ?
হাসির স্বরে উত্তর দিলো সে । এই মুহূর্তে সে বিন্দুমাত্র চায় না যে , তার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বিন্দু মাত্র আন্দাজ করুক নিউ ইন্ডিয়ার কেউই । তবে সব তো তার ইচ্ছামতো হয় না বা হতে পারে না । ভবিষ্যত মানুষের চোখে সেভাবে সবসময় ধরা দেয় না আর দেয় না বলেই বিশ্বাস নামক বস্তুটি পৃথিবীতে আজও জীবিত আছে । সেই বিশ্বাসের ওপর বিশ্বাস রেখেই সে বলে চললো আবার ,
—- এই তো দুদিন হলো ভোপাল পৌঁছেছি ।
এটুকু বলেই চেতনার গোড়ায় কে যেন নাড়া দেয় একবার । অজ্ঞানতার অন্ধকার কাটিয়ে জ্ঞানে ফিরলে মানুষ বেশ বুঝতে পারে কী সর্বনাশ সে করে ফেলেছে অথবা করতে চলেছে । এই একই অবস্থা তারও এবং সে তড়িঘড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওঠে ,
—— তবে এখনও জয়েন করিনি ।
—– সেকি ! এখনো জয়েন করোনি ।
অপরদিক থেকে পরিদার উৎকণ্ঠা যুক্ত গলা ভেসে আসে । সে স্বর বলে চলে ,
—– তাহলে চলছে কি করে তোমার !
—– এই চলে যাচ্ছে ।
বেশ হতাশ হয়েই উত্তর দেয় সন্দীপন ।
—– তোমাদের কথা বলো । পরেশ দা , বাঘ দা , সর্বাশিষ দা , ম্যানেজার কেমন আছেন ? অফিসের খবর কি ?
দীর্ঘ বক্তব্য তার দীর্ঘতর হতে থাকে আরও , এই আশায় , যদি ফোন কেটে দেয় ব্যস্ত লোকটা । সে বলে চললো আরও ,
—- এজেন্টদের খবর কি ? ব্যবসা কেমন চলছে ? মাইনে হয়ে গেছে পরি দা ।
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে হোঁচট খায় সে । কোথাও না কোথাও সত্যের মুখোমুখি হতেই হয় সকলকে আর সেখানেই হোঁচট খেতে হয় সকলকে বারবার । সন্দীপনও এর ব্যতিক্রম নয় ।
জবাব ফেরত এলো যখন , তখন সন্দীপনের মুখ শুকনো । হয়তো কান্নাও দানা বেঁধেছিলো চোখে , তবে সকলের সামনে প্রকাশ পায় নি আর । পরিতোষ যা বললো তা দুশ্চিন্তার মেঘ টুকু আরও ঘন করে দিলো সন্দীপনের আকাশে ।
ফোনটা বন্ধ করে দিলো সে এবার । ভাবনার গভীর সাগর তলে ডুব দিচ্ছে আজ , যদিও সে বেশ জানে এখানে কোন মুক্ত সে পাবে না আজ । ভেবে পাচ্ছে না , কোম্পানি এত টাও মারাত্মক হতে পারে । তবু মোবাইলে মেল খুলে সে নিশ্চিত হতে চাইলো একবার । পরিষ্কার ভাষায় মেল করা হয়েছে দুটো — প্রথমটি মুম্বাই হেড অফিস থেকে আর পরেরটি কলকাতা রিজিওনাল অফিস থেকে । দুজনের বক্তব্য একই , যার সারমর্ম করলে এই দাঁড়ায় যে , যেহেতু সে কোম্পানিকে না জানিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে ; তাই তার বর্তমান মাইনে দেওয়া হবে না । এর সাথে আরও জানানো হয়েছে যে , শ্রী সন্দীপনকে কোম্পানির এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ১৯ মাসের মাইনে অর্থাৎ ৯ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেরত দিতে হবে এবং এর অনাদায়ে তার বিরুদ্ধে কোম্পানি আইনি ব্যবস্থা নেবে ।
১০ লক্ষ টাকা ! ১০ লক্ষ টাকা ! এই একই কথা মনের মধ্যে সে বলে চলেছে অনবরত । একটা গভীর চাপ গ্রাস করেছে তাকে আর হবে নাই বা কেন ! এত টাকা জোগাড় করে মধ্যবিত্ত ঘরে চাড্ডিখানি কথা নয় । কি হবে এবার !!
৫।।
ভাবনার স্রোতের গভীরে হারিয়ে গিয়ে ভেসে যায় সকলেই । এ যেন এক গভীর খাদের মত , যার কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন তলিয়ে যায় অনেক গভীরে । বাঁচার চেষ্টা করে নিশ্চই , কিন্তু বাকিটা থাকে ঈশ্বরের সহায় , যদি কোন বুদ্ধি এসে ধরা দেয় মগজে । সন্দীপনের অবস্থাও আজ ঠিক তাই , ছটফট করে চলেছে ভেতরে ভেতরে আর বাইরে সমস্ত কাজ দিব্যি করে চলেছে ; ঠিক যতটা না করলে নয় । মায়ের ফোন সময়মতো ধরছে , খোঁজ খবর নিচ্ছে সকলের ; এই কদিনে সমরেসের সাথেও কথা হয়েছে প্রায় প্রতিদিন , রাত জেগে আড্ডা দিয়েছে বাল্য বন্ধু শুভর সাথে । শুধু অফিসের ওই কয়েকটা ঘন্টা তার কাছে দায় মনে হচ্ছে । ক্যান্টিনে বসে বসে মনে ভেসে উঠছে একটাই কথা —
১০ লক্ষ টাকা ! ১০ লক্ষ টাকা ! এই একই কথা মনের মধ্যে সে বলে চলেছে অনবরত । একটা গভীর চাপ গ্রাস করেছে তাকে আর হবে নাই বা কেন ! এত টাকা জোগাড় করে মধ্যবিত্ত ঘরে চাড্ডিখানি কথা নয় । কি হবে এবার !!
এমনি একদিন , বুধবার ক্যান্টিনে একলা বসে একা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল সে , সেই দুটি ছেলে যাদের সেকশনের সামনে সেদিন সে দেখেছিল , এসে ঢুকলো ক্যান্টিনের ভেতর । সন্দীপনকে একা বসে থাকতে দেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো তার দিকে , এবং একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললো ,
—– হায় , মের নাম সৌরভ , সৌরভ শর্মা ।
দ্বিতীয় জন ছেলেটিও সটান লম্বা করে হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো ,
—— ম্যায় , রাজীব , রাজীব ইয়াদভ ।
সন্দীপনের আজ পরিচয় করার একটুও ইচ্ছে নেই কারুর সাথে । পরিচয় তো দূরের , কথা বলার ইচ্ছে নেই তার । তবু হাসি মুখে হাত মিলিয়ে বললো ,
—- সন্দীপন , সন্দীপন দত্ত ।
উত্তর শেষ হতে না হতেই রাজীব বেশ ইয়ার্কির ছলেই বলে উঠলো ,
—- বাঙ্গালী বাবু …
সন্দীপন আজ আর সহ্য করার অবস্থায় নেই । একদিকে মাথায় চাপ আর অন্য দিকে এদের ইয়ার্কি , ফাজলামি ; দুঃসহ মনে হচ্ছিল তার কাছে । চেয়ার ছেড়ে উঠে বেড়িয়ে যেতে চাইলো সে আর ঠিক সেই মুহূর্তে পিছন থেকে ভেসে এলো সৌরভের শ্লেষাত্মক কন্ঠ ,
—- আরে দাদা । রুঠ কে কহা চল দিয়ে । আজাইয়ে , মছলি খিলাউনগা ।
সন্দীপনের থেকে এসব সহ্য হচ্ছিল না আর । পেছন দিকে পিছিয়ে এলো সে । চোখ মুখ তার লাল । ঝড়ের ঠিক আগের মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সকলে । চিৎকার করে বলে উঠলো সে ,
—- হা ম্যায় হু বাঙ্গালী । হা ম্যায় খাতা হু মাছ ভাত । তো ….
ইতিমধ্যেই বাকি কলিগরাও এসে উপস্থিত হয়েছে । সন্দীপনের ওই রূপ দেখে তারা থ । কেউ নড়ছে না , কেউ কিছু বলছে না ; শুধু সন্দীপন বলে চলেছে আজ ,
—- হাম বাঙ্গালী তুমহারে জাইসা কিপটা নেহি হেয় । হমে খানা দিখাতা হ্যায় । শালা বাঙালী খানা , ফুটবল ঔর রাজনীতি মে তুম সব সে আগে হ্যায় । ঔর আগে কিউ হ্যায় পতা হ্যায় না , বুদ্ধি কে বাজাহ সে আউর বুদ্ধি আতা হয় মাছ ভাত সে । এক বাঙালী তুম সব পে ইউহি রাজ কর সকতা হ্যায় । সমঝে …
এই বলে সে কোন দিকে না তাকিয়ে গট গট করে ক্যান্টিন ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো । নিশা ও বাকিরা ধীরে ধীরে ভেতরে এসে প্রবেশ করলো এবার । সম্পূর্ণ ঘটনায় তারা বেশ অবাক ।
—- দাদা কো আচানক কেয়া হুয়া ?
অজিত জানতে চাইলো । বাকিরাও একই প্রশ্ন ছুড়ে দিলে রাজীব সেখান থেকে উঠে চলে গেল । সৌরভও উঠে যাচ্ছিল তবে সকলে মিলে তাকে জেরা করতে থাকায় সে যেতে যেতে বলে যায় ,
—– দেখো মিত্রো বাঙ্গালী হোতে এয়সেহি । মজাক করনা উনকো আতা কহা হ্যায় ।
তার কথাগুলো অজিতের ঠিক লাগলো না , তবে কলিগ বলে প্রতিবাদ করতেও পারলো না সে ; শুধু মাথা নেড়ে গেল পেন্ডুলামের মতো আর ওদিকে সৌরভও ক্যান্টিন ছেড়ে বিদায় নিলো সেই সুযোগে ।
৬।।
মাথায় হাজার চিন্তার স্রোত বইছে । বাড়ি ছেড়ে একলা এত দূরে পড়ে থাকা , অন্য দিকে কোম্পানির চাপ ; প্রায় দশ হাজার টাকা । পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা তার । নিস্তব্ধ রাতে ব্যালকনিতে বেশিক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে । এরই মাঝে চোখের সামনে পুরোনো বন্ধুর মুখটা ভেসে উঠছে বারবার , শুভর গতকালের ফোনটা খুব একটা সুখকর ছিল না ; ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা কান্নার আওয়াজ আর শুভ ও তোতনের কথাগুলো বড় কানে বাজছে তার ,
—– অরিজিৎ চৌবে , আর নেই । জীবনের কাছে হার মেনে নিয়েছে সে । কুইট….
ভীষন অবাক হয়েছিল সন্দীপন কথাটা শুনে । সে জানতে চেয়ে বলে ,
—- হঠাৎ ! কি হয়েছিল যে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হলো ।
ভেজা ভেজা গলায় উত্তর দেয় তোতন ,
—– বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মা , দিদিকে রেলের চাকরিটা দিয়ে দিয়েছিল । আর সেই চাকরির সুযোগ নিয়ে ওর দিদি বিয়ে করে ওর মা আর ভাইকে ঘর থেকে বের করে দেয় । অরিজিৎ এর কোথাও কিছু হচ্ছিল না । পেনশনের টাকাগুলো ওদের কাছে অকর্মের ঢেঁকি মনে হতে লাগলো । অরিজিৎ বহু বার মিটমাটের চেষ্টা করে , ফল কিছুই হয়নি । দিনদিন সাইকো হয়ে যাচ্ছিলো সে । বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল । কাল রাহুল ফোন করে জানায় ….
বাকি কিছু বলার আগেই কান্নায় ভেসে যায় দুজনে । আজ সন্দীপনের এসব মনে হচ্ছিল আর সে ভেবেছিলো যে তারও তো বাবা নেই …. বাবার ভূমিকা কত বড় সে আবার একবার উপলব্ধ করছিলো আজ । এভাবে অনেক সময় কেটে গেলে তার মনে হয় , মন ভালো করা উচিত । আর তাই ফেসবুকটা খুলে বসলো সে আবার । আজকাল একমাত্র এখানেই যে শান্তি পায় সে …
ফেসবুকের দপ্তরে সন্দীপন এখন এক ডেলি কাস্টমার । এখানেই সে ভবিষ্যৎ আঁকে তার কবিতার মধ্যে দিয়ে । কবিতাই এখন তার সব , এ সবে কারুর কোন প্রবেশাধিকার নেই । সময়টা ওই মে জুন মাস । কবিতার দুনিয়ায় সদ্য পরিচিত নাম তখন সন্দীপন । এমনই এক সন্ধ্যায় একটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করতে গিয়ে মিনিট দু এক থামলো সে । কি অপরূপ দেখতে তাকে !! বোধহয় একেই বলে লাভ এট ফার্স্ট সাইট । দেরি না করে প্রোফাইলটা একবার খুলে দেখল সে । ঠিক যেটা চেয়েছিল , সেটা যে খুঁজে পেয়েছে সেটা তার মুখ চোখ থেকে স্পষ্ট । নাম ; সত্যবতী , সিঙ্গেল, ফেসবুক বলছে , তার বয়স ২২+ । মনের মত কাউকে পেলে বন্ধুত্ব না করে কি থাকা যায় আর যদি কেসটা হয় লাভ এট প্রথম দেখা তাহলে দেরি না করাই ভালো । সুতরাং , শুভ কাজে দেরি করে কি লাভ ! তড়িঘড়ি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে পা রাখলো সন্দীপন এবার । রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে নিলো সে ঠিকই কিন্তু সমস্যা একটাই , মেয়েটিকে কিকরে বোঝাবে সে যে সন্দীপন ইস ইন লাভ উইথ হার । নিজের লাজুক স্বভাবের জন্য মেয়েদের সাথে খোলামেলা ভাবে সে মিশতেও পারে না । আর তাই ভয় হচ্ছে বেশ আজ , যদি সত্যবতী অন্য কারুর হয়ে যায় । পাগলের মত হন্যে হয়ে সন্দীপন পথ খুঁজে চলছিল দিনরাত , কয়েকবার ভেবেওছিল সে , মনের সব কথা বলে দেবে সত্যবতীকে । কিন্তু লাজুক স্বভাব তার , সে সাহস দেয়নি তাকে ।
এমন এক পরিস্থিতিতে তার একমাত্র অস্ত্র হল কবিতা । এই জায়গাটা সন্দীপনের খুব স্ট্রং । গোপনে কবিতার মধ্যে দিয়ে সে ঠিক করলো মেয়েটাকে মনের কথা বোঝাবে । তারপর ….
শুরু হল একের পর এক প্রেমের সিরিজ আর প্রেমের কবিতা । কিন্তু কোন কিছুই কাজ দিচ্ছে না তার । এদিকে পুজো কাছে এসে যাচ্ছে । কিছুই মাথায় আসছে না । সুতরাং , ভাগ্যই ভরসা । ভাগ্যের ওপর সব ছেড়ে দিয়ে সন্দীপন নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।
পরদিন সকালে মেল চেক করতে গিয়ে সন্দীপন যা দেখলো তাতে সে বেশ অবাক । কোম্পানির প্রাপ্ত এগ্রিমেন্ট যত তাড়াতাড়ি সম্ভব না মেটালে কোম্পানি তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে —- এই হলো মেলের সারমর্ম । যেটুকু আনন্দ তার মনে জন্ম নিয়েছিল এই কদিনে , আজ যেন হট করেই তারা মারা গেল একসঙ্গে । তাই তো সন্ধ্যা নেমে গেলো সন্দীপনের ঠিকানা ফেসবুক না হয়ে , একটি বারে স্থানান্তরিত হলো । মা ফোন করেছিল এর মাঝে প্রতিদিনের মতোই কিন্তু সে জানায় ,
—– মা । কাজ আছে । খুব চাপ । রাত হবে ফিরতে । কাল কথা বলবো । বাই।
মায়ের মন তো , ছেলের কথাগুলো কেমন কেমন মনে হলেও , বিস্বাস করে নিলো । পরদিন সকাল হতে না হতেই তাই যথারীতি মোবাইলের ঘন্টা বেজে উঠলো তার । আধঘুম চোখ কচলাতে কচলাতে মোবাইলটা হাতে তুলে নিল সে । আগের দিন একটু বেশিই খেয়ে নিয়েছিল , তাই ঘুমটাও আজ একটু বেশিই গভীর হয়ে গেছে । তবু আধ চোখেও সে দিব্বি টের পাচ্ছিল যে মা ফোন করেছে তাকে । অনেক দিন পর প্রাণ খুলে কথা বললো সে । সে জানে বাড়ি বিক্রি ছাড়া তার কোন পথ নেই এই বিশাল অঙ্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার । কত দিন লুকিয়ে রাখবে সে । অগত্যা সে সাহস করে মাকে সব খুলে বললো আজ ,
—-বাড়িটা বিক্রি করতেই হবে । তবে চিন্তা কোরো না । আমি তো চাকরি করছিই , কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে নেবো ।
বৃদ্ধা বিধবা মহিলাটি বেশ বুঝতে পারছে , ছেলের ওপর ঘনিয়ে আসা আসন্ন বিপদটা । তাই সেরাম কিছুই বলতে চায় না । নিস্তব্ধ নীরবতা তার সন্দীপনকে আরও আঘাত হেনে দেয় , দুশ্চিন্তা বাড়ায় , ধরমরিয়ে উঠে বসে চিৎকার করে ওঠে সে মোবাইলের এপাস থেকে ,
—- মা । ও মা । কি হলো মা । ঠিক আছো তো ? কি গো কথা বলছো না যে !
উত্তর আসে না কোন । ছেলের গলা ধরে আসছে । মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন অন্ধকার হয়ে আসছে । চারপাশের নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে তাকে । সে আধো গলায় চিৎকার করে ওঠে আবার ,
—– আ… ও আ । আ…. মা…..
একটা শান্ত গলা ভেসে ওঠে এবার ,
—- আমি ঠিক আছি বাবা । তুই খেয়াল রাখিস নিজের । এখন রাখি , কেমন ।
ছেলে বেশ বুঝতে পারছে যে কোন কিছুই ঠিক নেই বিধবার মনে । যতই হোক বাড়িটাই স্বামীর শেষ সম্বল । আর অন্যদিকে ছেলের ওপর ঘনিয়ে আসা বিপদ । মা হয়ে সেটুকু প্রতিহত করতে না পারলে কি লাভ তার মাতৃত্বের । সন্দীপন তাই ফোন কেটে , মা কে যেতে দিলো আজ । গেরুয়া না পড়েও সন্যাসী হওয়া যায় , সন্দীপন আজ যেন তার বলিষ্ঠ উদাহরণ । মা , বন্ধু , প্রেমিকা সব ভুলে সে আজ একক ।
সেদিন ১৪ই আগস্ট । ভোপাল স্টেশনে বড় ঘড়িটায় তখন সন্ধ্যে ছ’টা বাজছে । সন্দীপন পিঠে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ওভার ব্রিজের ওপরে । একদিনের ছুটিতে বাড়ি ফেরার অনুমতি এজি অফিস থেকে আগে ভাগেই নিয়ে রেখেছিল । গত সন্ধ্যায় মা কে ফোন করে জানিয়েও দেয় । মা অবশ্য একটু রাগই করেছিল প্রথমে , বলেছিলো ,
—– এক দিনের জন্য আসার কি দরকার ছিল ! এতগুলো টাকা খরচ করার কোন মানে হয় !
কিন্তু মায়ের মন তো , ছেলেকে আটকায় নি পরে আর । ট্রেন ঠিক ৭:১০ এ ৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাড়ালো । স্লিপার বগি প্রায় ফাঁকা । সন্দীপন ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে নিজের সিটে এসে বসলো । সাইড লোয়ার ব্যার্থ , সিট নম্বর ১৫ ।

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।