• Uncategorized
  • 0

উৎসব সংখ্যায় ছোটগল্প – সুধাংশু চক্রবর্তী

কাশফুল নিয়ে সেলফি 

বিতান মুগ্ধ চোখে দেখছিলো ছুটন্ত মোটরগাড়ির জানালার পাশ দিয়ে দ্রুত পিছনে সরে যেতে থাকা দৃশ্যাবলী। ও এখন কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে কলকাতার দিকে ছুটছে । যাবে সোদপুরে মাসির বাড়িতে । সহসা পথের ধারেই গজিয়ে ওঠা গোছাগোছা কাশফুল দেখে লোভ সামলাতে না পেরে ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত চলে এলো কাশফুলগুলোর কাছে । এসে এক হাতে কাশফুলের গুচ্ছ ধরে স্মার্টফোনে তুলে নিলো নিজের হাসিখুশি মুখের গুটিকতক ছবি । গাড়িতে বসে ফেসবুক খুলে সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা পোস্ট করলো নিজের ওয়ালে ।
সোদপুরে মাসির বাড়িতে ঢোকার পরই মাসুতুতো বোন জাহ্ণবী চেপে ধরলো ওকে, অমন সেলফিসের মতো কাশফুল নিয়ে খুব যে বাহারি সেলফি পোস্ট করেছো তুমি । ও বিতানদা, কোথায় দর্শন পেলে অমন সুন্দর কাশফুলের ? দু-চারটা আনলেই তো পারতে আমার জন্যে । আমিও সেলফি তুলতাম । হি হি হি ।
মাসি শুনে হাসতে হাসতে বললেন, এই হলো তোদের এক রোগ ।  হুজুগে মেতে ওঠায় জুড়ি নেই তোদের ।
তুমি মা বড্ড সেকেলে রয়ে গেলে । এটা চমকের যুগ । যে যত বেশি চমক দিতে পারবে বন্ধুরা তাকে ততই বাহবা দেবে । জাহ্নবী তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো ।
নিকুচি করেছে তোদের বাহবা কুড়োনোর । আমরা বাপু বাহবা কুড়োতে না চেয়েও অনেক চমক দেখিয়েছি এই জীবনে । তোরা ভাবতেও পারবি না । এই কাশফুল নিয়েই একবার বিশাল এক চমক, তোদের ভাষায় অবশ্য, দিয়েছিলাম আমি ।
কি রকম, কি রকম ? বিতান অবাক গলায় শুধোলো ।
মাসি একমুখ হাসি দিয়ে জবাব দিলেন, ও বাবা, ছেলে যে গল্প শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে ! আগে জামা কাপড় ছাড় । চোখেমুখে জল দিয়ে ধাতস্ত হয়ে চা-জলখাবার খা । তারপর না হয় শান্তিতে বসে…
বিতান কথার মাঝখানেই আবদারের সুরে বলে, আহা, বলো না মাসি তোমার ওই চমকের গপ্পো । গপ্পোটা না শোনা ইস্তক আমি যে  স্বস্তি পাচ্ছি না ।
ও মা বলো না গো, কী এমন  চমৎকার কাণ্ড ঘটিয়েছিলে কাশফুল নিয়ে । জাহ্নবীও অনুনয় করে বলে ।
তোদের জ্বালায় আমার কাজকর্ম যে মাথায় উঠলো । ঠিক আছে বলছি । শোন তাহলে ।
মাসি সামান্য বিরতি দিয়ে সবে গল্প বলতে যাচ্ছেন মেসো তখনই অফিস থেকে ফিরে এলেন । বিতানকে দেখে এক গাল হেসে বললেন, আরে,  বিতানবাবু যে ! কি খবর ? কখন এলে ? নতুন চাকরি পেয়েছো শুনেছি । আজ অফিসে যাওনি তুমি ? নাকি এখন থেকেই অফিস কামাই করতে শুরু করেছো ? ও হ্যাঁ, মণিময়দা কেমন আছেন ? বড়দির হাঁটুর ব্যথা কমেছে ? নাকি এখনো ফিজিও করাতে হচ্ছে ? এই বয়সে কেন যে তাড়াহুড়ো করে বসে চাপতে গিয়েছিলেন কে জানে !
একসাথে এতগুলো প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার দরুন বিতান খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে জবাব দিলো, ওরে বাবা, একসাথে এতোগুলো প্রশ্ন করে বসলে মেসো !  কোন প্রশ্নের জবাব আগে দিই বলো তো ?
শুনে মেসো হাসতে হাসতে বললেন, তুমি বরং উত্তরগুলো রেডি করো আমি ততক্ষণে ঘরের পোশাকে হয়ে আসছি ।
মেসো ভিতরে চলে যাবার পর মাসি বললেন, এই রে, উনি এসে গিয়েছেন । আমিও উঠি । এই বিতান, যা তো বাবা, চোখেমুখে জল দিয়ে ঘরের পোশাকে হয়ে আয় । আমি গিয়ে চা-জলখাবার নিয়ে আসি ওনার এবং তোর জন্য ।
সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে । বিতান ওর জন্য বরাদ্দ করা ঘরের বিছানায় শুয়ে স্মার্টফোনে ডুবে আছে । জাহ্নবী কোথায় যেন গিয়েছিলো । ফিরে এসে সোজা হামলে পড়লো বিতানের ওপর, ও বিতানদা, এই দ্যাখো কাকে ধরে এনেছি । আমার বান্ধবী রূপাঞ্জনা । কাশফুলের সেলফিটা দেখেই তোমার প্রেমে পড়েছে গো । হি হি হি । তোমার খোঁজখবর নিচ্ছিলো । হি হি হি । ওকে তাই ধরেবেঁধে নিয়ে এলাম তোমার কাছে ।
বিতান লজ্জায় পড়ে গেল । রূপাঞ্জনার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না । মাসি এসে ওকে বাঁচিয়ে দিলেন । মেয়েকে দেখে বললেন, এই যে, তোরাও আছিস এই ঘরে ! ভালোই হলো । কই রে বিতান, ঘটনাটা শুনিয়েই দিই তোদের, কী বলিস ?
বিতান আড়চোখে রূপাঞ্জনাকে দেখতে দেখতে হেসে বলে, তুমি একদম আমার মনের কথা বলেছো মাসি । নাও শুরু করো ।
জাহ্নবী বিতানকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে রূপাঞ্জনাকে বলে, এই রূপা, তুই এখানে বোস । আমি আর মা বসছি মেঝের ওপর ।
জাহ্নবী শুধু বললো না কাজেও করে দেখালো । রূপাঞ্জনাকে হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো বিতানের পাশে । বিতান এবার ভালো করে দেখলো ওকে । ছিপছিপে চেহারার রূপাঞ্জনাকে সাদা পোশাকে দেখে দেখে কেন জানে না বিতানের মনে হলো জাহ্নবী যেন টাটকা কাশফুলের গুচ্ছ এনে বসিয়ে দিলো ওর পাশে । ও তাই না-বলে থাকতে পারলো না, ওরে জাহ্নবী, তোর বান্ধবী যে একগোছা কাশফুল রে ! সাদায় সাদা হয়ে আছে ।
শুনে রূপাঞ্জনা এমনভাবে ঝুঁকে বসলো যেন বাতাসের তোড়ে কাশফুলের ঝাড় নুয়ে পড়লো মাটিতে ।  মাসি লজ্জার হাত থেকে উদ্ধার করলেন রূপাঞ্জনাকে, এই বিতান, মেয়েটাকে খামোখা লজায় ফেলছিস কেন ?
জাহ্নবী খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বলে, কি রে রূপাঞ্জনা একটা সেলফি হবে নাকি ?
বিতান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই মেসো এই ঘরে ঢুকে এসে মাসিকে বললেন, আমি একটু আড্ডা দিয়ে আসি বন্ধুদের সঙ্গে । তোমরা গপ্পো করো । সাড়ে নয়টার মধ্যে চলে আসবো ।
মেসো বেরিয়ে যাবার পরই বিতান তাগাদা দেয় মাসিকে, ও মাসি, শুরু করো তোমার সেই চমক জাগানো কাশফুল কাহিনী ।
মাসি মৃদু হেসে বলতে শুরু করলেন, আমি তখন কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্রী । দুর্গাপূজার আর বেশী দেরী নেই । দিন চারেক পরই মহালয়া । নতুন জামা কাপড় কেনার জন্য রোজই বেরোচ্ছি মায়ের সঙ্গে । তেমনই একটা দিনে রাস্তায় এক পথচারীর হাতে এক গোছা কাশফুল দেখে খুব ইচ্ছে হলো কাশফুল তুলে আনি । কিন্তু সমস্যা একটা ছিলো । আমাদের এদিকে কাশফুল কোথায় ? ইচ্ছেটা বন্ধুদের কাছে প্রকাশ করামাত্র ওরাও লাফিয়ে উঠলো । নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর স্থির হলো কোলাঘাট স্টেশনে নেমে পায়ে হেঁটে চলে যাবো কাশফুলের বনে । তোরাও দেখেছিস নিশ্চয়ই এই সময়ে ওখানে মাঠের পর মাঠ ভরে থাকে কাশফুলে ?
জবাবে বিতান বলে, ওদিকের খবর নেই আমার কাছে । তবে আজ যখন কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আসছিলাম তখন দেখেছি জায়গায় জায়গায় কাশফুল ফুটে আছে । যদি কখনো ওদিকে যাও…
ওকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে জাহ্নবী বলে ওঠে, তুমি চুপ করবে বিতানদা ?  ও মা, বলো না তারপর কী হলো ?
মাসি আবার বলতে শুরু করলেন, আমরা পাঁচ বন্ধু মিলে ভোরের পাশকুড়া লোকালে চেপে বসলাম । ওই সকালে ট্রেন প্রায় ফাঁকাই ছিলো । ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে এক দল যুবক উঠে এলো আমাদের কামরায় । গুনেগেথে দেখি ওরাও পাঁচজন । ওই বয়সে যা হয় আর কি । আমাদের মধ্যে চাপা ফিসফিসানি শুরু হলো ছেলেগুলোকে নিয়ে । ওরাও দেখলাম নিজেদের মধ্যে কিসব যেন বলাবলি করছে আমাদের দিকে তাকিয়ে । যাই হোক, কোলাঘাট স্টেশনে নেমে দেখি ওই যুবকেরাও নেমে এসেছে ট্রেন থেকে । আমরা হাঁটছি কাশবনের দিকে, ওরাও পিছনে পিছনে হাঁটছে । সামান্য ভয় পেলেও সেটা প্রকাশ না করে ঢুকে গেলাম কাশফুলের বনে । যুবকেরাও এসে ঢুকলো সেখানে । ওদের পাত্তা না দিয়ে বান্ধবীদের ডেকে বললাম, এই যাহ্, ক্যামেরাই আনা হয়নি ! একটা ক্যামেরা থাকলে ভালো হতো । ছবি তুলতে পারতাম কাশফুল নিয়ে ।
যাহ্, ক্যামেরাই নিয়ে যাওনি তোমরা ! অমন সুন্দর একটা সুযোগ হাতছাড়া করতে হলো তোমাদের । জাহ্নবী হতাশ গলায় বলে ।
সেই আশাও অপূর্ণ থাকেনি রে মা । আমাদের প্রত্যেকেরই একটা করে ছবি তোলা হয়েছিলো কাশফুল নিয়ে । শুধু তখন তখন জানতে পারিনি । জেনেছিলাম তারও কিছুদিন পর ।
বিতান উৎসুক হয়ে শুধোয়, ক্যামেরা নেই অথচ ছবি তোলা হলো ! তারমানে ?
জাহ্নবীও ভারী অবাক হলো, এসব কী বলছো মা ! কে তুলেছিলো তোমার ছবি ?
মাসি হাসতে হাসতে বললেন, কে আবার ? তোর বাবা । শুধু আমার নয় ওই পাঁচ জন যুবকই যে যার পছন্দের মেয়ের ছবি তুলে নিয়েছিলো । আমরা জানতেও পারিনি । জেনেছিলাম দূর্গাপুজোর অষ্টমীর দিন । আমাদের প্রত্যেকের হাতে ছবি তুলে দিয়ে ওরা যে প্রেম নিবেদন করেছিলো সেই রাত্রে । বিশ্বাস না হয় একবার খোঁজ নিয়ে দেখিস তোর ওই মালা, বুলা, তাপসী আর তিন্নি মাসির কাছে । আমাদের পুরোনো পারিবারিক এ্যালবামটাও একবার ঘেঁটে দেখতে পারিস । পেয়ে যাবি আমার সেই কাশফুল নিয়ে ছবি । এই রে, আমি যাই । খাবারদাবারগুলো গরম করতে হবে । তোরা গল্প কর । রূপা, তুইও খেয়ে যাস মা ।
মাসি চলে যাবার পর বিতান প্রায় ফিসফিস করে জাহ্নবীকে বলে, এই জাহ্নবী, রূপাঞ্জনাকে সঙ্গে নিয়ে কোথায় যাওয়া যায় রে ? কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ? নাকি কোলাঘাট ?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।