“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় শম্পা সাহা

রতন দাদু

অনেকখন থেকেই একটা টকটক শব্দ শুনতে পাচ্ছে সৌমিক, প্রথমে ভাবলো মনের ভুল কিন্তু শব্দটা এতো ঘনঘন হতে লাগল যে ও আর বিষয়টা এড়িয়ে যেতে পারলো না। ভালো করে খেয়াল করে দেখলো যে শব্দটা বা দিকের জানালা থেকে আসছে, যে দিকটা নিম গাছ, ঐ দিকটার জানালায় কে যেন টোকা দিচ্ছে। একে শীতের রাত তার উপর এখন রাত ও অনেক, প্রায় দুটো তো হবেই, এসময় সৌমিকের কোনোমতেই জেগে থাকার কথা নয় কিন্তু সামনে টেস্ট পরীক্ষা, না পড়ে উপায় কি? তার উপর আবার সাইন্স,। তাই অগত্যা মা, বাবা, দিদি যখন নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে তখন বেচারা সৌমিক টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বিছানায় বসে পড়া মুখস্থ করছে। পড়তে পড়তে বেশ ঝিমুনি মত এসেছিল কিন্তু এই টোকার আওয়াজে ওর সমগ্ৰ স্নায়ু টানটান হয়ে উঠল। বার কয়েক খেয়াল করে বুঝলো যে মনের ভুল নয় সত্যিই কেউ জানালায় টোকা দিচ্ছে। প্রথমে একটু ইতস্ততঃ করলো, চোর নয়তো? হতে পারে। এই তো গত সপ্তাহে শীতের রাতে, লোকজনের গভীর ঘুমের সুযোগ নিয়ে বিজয় নগরে বেশ বড় দুটো চুরি হয়ে গেছে, কিন্তু চোর কি আর এরকম জানালায় টোকা মেরে ডেকে চুরি করবে? চোর নয়। তাহলে কি কারো কোনো বিপদ হলো? তাহলে তো ফোন ই করতে পারতো? কিন্তু এভাবে ডাকছে কেন? সৌমিক একবার ভাবলো মাকে ডাকে, কিন্তু ও এখন বড় হয়েছে, উচ্চমাধ্যমিক দেবে, এখনো যদি রাতে এসব কারণে মাকে ডাকে তাহলে দিদির ঠাট্টার জ্বালায় আর টেকা যাবে না। যখন সৌমিক বিছানায় বসে এসব ভাবছে, ততক্ষণে শব্দ আরো জোর আরো ঘন হচ্ছে। সৌমিক আর থাকতে পারলো না,খাট থেকে নেমে কম্বল গায়ে জড়িয়ে এগিয়ে গেল জানালার দিকে। জানালাটা আস্তে আস্তে খোলার চেষ্টা করলো, কারণ জোরে খুললে যদি পাশের ঘরে মা টের পেয়ে যায়। এমনিতে ই জানালাটা খোলার সময় যা ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ করে! খুব সাবধানে জানালাটা খোলায় পাল্লাটা একবার মাত্র ক্যাঁচ আর্তনাদ করে থেমে গেলো। জানালাটা খোলা মাত্র ই হঠাৎ একটা দমকা হিম শীতল বাতাস দুম করে ঘরের মধ্যে ঢুকে ওর হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিলো, কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে সৌমিক বুঝতে পারল ওর দাঁতে ঠকঠক আওয়াজ শুরু হয়েছে। ঘন কুয়াশার জন্য কিছু ভালো দেখা যাচ্ছে না, ভালো ভাবে ঠাহর করে দেখলো একটা অস্পষ্ট মুখ, রতন দাদু না? হ্যাঁ, রতন দাদুই তো? এতো রাতে রতন দাদু এখানে কি করছে? সৌমিক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল “দাদু, কি হয়েছে? এতো রাতে তুমি এখানে কেন?” বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “বাবা, দেখনা তোর ঠাকুমা কেমন যেন করছে? ”   “কেন, কি হয়েছে ঠাকুমার? ” কৌতুহলী গলায় সৌমিক প্রশ্ন করে, দাদু কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “দেখ না বাবা, বোধহয় শরীরটা খুব খারাপ করছে, আমি বুড়ো মানুষ, কি করবো বুঝতে পারছি না, একটু আমার সঙ্গে যাবি?” সৌমিক মন্ত্রমুগ্ধের মত রতন দাদুর কথায় বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো, এমনকি বাড়ির কাউকে ডাকতে বা টর্চ টা নিতেও ভুলে গেলো। গায়ে শোবার কম্বলটাই চাপিয়ে চলল রতন দাদুর পেছন পেছন। এমনিতে সৌমিক খুব শীতকাতুরে, মোজা ,টুপি , মাফলার, সোয়েটার, জ্যাকেট ছাড়া বের হয় না, আর এমনি কি শীতের সময় তো ও নড়তে চড়তেই  চায় না, আর ভীতু বলতেও ওর মতো ওর বয়সী কেউ নেই, তাই দিদি সারাক্ষণ ওকে ভীতুর  ডিম বলে খেপায়,সেই সৌমিক রাত দুটোর সময় রতন দাদুর পিছনে হেঁটে চলেছে, ওর সব ভয়, সব শীত যেন ভোজবাজির মতো উধাও।এমন কি বের হবার মা বাবা কে ডকার কথাও ওর একবার মনে হল না! দাদুর হাতে ধরা টর্চের ক্ষীণ আলো অনুসরণ করে ও এগোতে লাগলো।
বেশ খানিকটা এগিয়ে রতন দাদুর বাড়ি, ওদের বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক তো হবেই। ওদের বাড়ির সামনের পিচ রাস্তা পার হয়ে গার্লস স্কুলের দিকে যে সরু গলিটা
নেমেছে, ওই গলিটার বাঁশ বাগান টা বাঁয়ে রেখে গোটা চারেক বাড়ি পরে রতন দাদুর বাড়ি। পুরো রাস্তাটা সৌমিক নিশিতে পাওয়ার মত চলতে লাগল, রাস্তায় কুয়াশা একেবারে চাপ হয়ে রয়েছে, এতটাই ঘন যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না, আর দেখা যাবেই বা কি করে? আলো তো নেই, কুয়াশার কারণে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো যেন মনে হচ্ছে কোন এক রহস্যময় জগৎ থেকে নেমে আসছে। পিচ রাস্তা পার হয়ে যখন ওরা গলিতে পড়লো, চারিদিকে নিকষকালো  অন্ধকার, এই গলিটায় কোনো ল্যাম্পপোস্ট ও নেই, আর রাতের বেলা সব বাড়ির আলোও বন্ধ, সামনের ঐ সরু আলোর রেখা অনুসরণ করে এগোতে এগোতে সৌমিকের হঠাৎ ই ভীষণ গরম লাগতে শুরু করলো, ও প্রায় ঘামতে শুরু করে, গায়ের কম্বলটা একটু আলগা করল সৌমিক। বাঁশ বাগানের পাশ থেকে যাবার সময় শিশিরের স্পষ্ট টুপটাপ শব্দ এক অপ্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যেন। অবশেষে ওরা এসে পৌঁছোলো  রতন দাদুর বাড়ির কাছে। একটা মাত্র পাকা ঘর, টালির চাল, বুড়োবুড়ি দুজনেই থাকে, একমাত্র ছেলে বিয়ে করে বর্ধমান না কোথায় একটা যেন থাকে। তাই  বৃদ্ধ বৃদ্ধার সহায় বলতে পাড়ার লোকেরা। সৌমিকের বাবাকে রতন দাদু খুব স্নেহ করেন, সেই কারণে ওদের বাড়ির সাথেও বেশ ভালো সম্পর্ক, তাই বিপদে আপদে রতন দাদু সৌমিক কে ডাকবে এতে আর আশ্চর্য কি?
   দাওয়াতে উঠে দেখলো যে দরজাটা হাট্ করে খোলা। এতো শীতে দাদু দরজা খুলে রেখে গেছে! সৌমিক অবাক হলো, আবার ভাবলো হয়তো তাড়াহুড়োয় খেয়াল নেই। তাড়াতাড়ি ভেতরে ঢুকে দেখলো লাল লো পাওয়ারের বাল্বের আলোয়, ভেতর ভালো দেখা যায় না, তাছাড়া, এতক্ষণ ঘর খোলা থাকায় যেন উঠোনের সব কুয়াশা এসে ঘরের মধ্যে ঢুকেছে। ঠাকুমা নেতিয়ে পড়ে আছে আর মাঝে মাঝে জোরে জোরে শ্বাস নিতে চেষ্টা করছে, ফলে বুকের মধ্যে থেকে কেমন একটা ঘরঘর  আওয়াজ উঠে আসছে। সৌমিক কাছে গিয়ে বসে ঠাকুমা কে জিজ্ঞাসা করে, “কি হয়েছে ঠাকুমা?কি কষ্ট হচ্ছে? ” ঠাকুমা স্পষ্ট কিছু বলতে পারে না শুধু বহু কষ্টে বুকের উপর হাত টা বোলায়। সৌমিক বুঝতে পারে ঠাকুমার বুকে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, এখন কি  করবে ও, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না, জল খাওয়াবে না কি ? হঠাৎই ওর চোখে পড়ে খাটের মাথার কাছে রাখা ছোট ফোনটার দিকে, সৌমিক তাড়াতাড়ি ফোনটা তুলে বাবার নাম্বার টা ডায়াল করে, দুবার রিং হতেই সৌমিত্র বাবু ফোনটা ধরেন। তারপর আধঘণ্টার মধ্যে ঠাকুমাকে কাছের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করা হলো। ডাক্তার বাবু জানালেন সিভিয়ার একটা অ্যাটাক হয়েছে, আর বেশি দেরী হলে সমস্যা হতে পারতো।
   ঠাকুমা কে হাসপাতালে ভর্তি করে বের হয়ে সৌমিত্র বাবু সৌমিক কে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাকিমা যে অসুস্থ তুই জানলি কি করে? ” সত্যিই তো? এতো ব্যস্ততার মধ্যে  কারো বিষয়টা মাথায় ছিলো না। সৌমিক বলল, ” আরে আমি জানবো কি করে? রতন দাদু ই তো আমাকে ডেকে নিয়ে এলো।”  “রতন কাকা!” সৌমিত্র বাবু আর সঙ্গের লোকেরা অবাক হয়ে গেলো! ” কি বলছিস? রতন কাকা ডেকে আনলো কি রে, রতন কাকা তো কবে মারা গেছে! ” তাই তো! সৌমিকের এতক্ষণ বিষয়টা তো খেয়াল ই ছিলো না, রতন দাদু তো গত বছর কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন মারা গেছে, ওর ভালো মনে আছে, তাই ওদের পাড়ার কার্তিক পূজা সেবার ধুমধাম করে হয় নি, সেই টাকায় গরীব রতন দাদুর শ্রাদ্ধ শান্তি হয়। আর রতন দাদুকে ও খুব ভালো বাসতো তাই সব ই ওর ভালো মনে আছে।তাহলে? তাহলে কে ডেকে আনল? কে ওকে টর্চের আলো দেখিয়ে এতোটা রাস্তা নিয়ে এলো? তবে কি? হঠাৎই একটা প্রচন্ড হিম ঠান্ডা স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল, হঠাৎই ই সৌমিকের চোখের সামনে সব দুলে উঠল, তারপর ওর  আর কিছু মনে নেই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।