“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

ভূতকাহিনি 

প্রায়ই কাউকে না কাউকে ভূতে ধরত আমাদের গাঁয়ে। সেই খবরটা হু হু করে রটে যেত দূর থেকে দুরান্তরে। তত(ণে কপালে মস্ত লাল ফোঁটা-কাটা, ঝাঁকড়া-চুলাে, ভাটার মতাে জ্বলতে থাকা ওঝা এসে পোঁছত সেই ভূত তাড়াতে। আর সেই বাড়ির সামনে তখন অজস্র দর্শনার্থীর ভিড়।। | যাকে ভূতে ধরেছে, সে তাে থাকে ঘরের ভিতর, ওঝাও তার ঘাড় থেকে ভূত তাড়াবে বলে সেই ঘরে অন্তরীণ হয়, সুতরাং বাইরে থেকে ওঝার তড়পানি, অজস্র গালিগালাজ, সেই সঙ্গে বেত বা ঝাঁটা দিয়ে পিটুনির শব্দ, সবই সেই অদৃশ্য ভূতের উদ্দেশে, তা ছাড়া আর কিছু দৃশ্যমান হয় না।
বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ভয়ে হিম হয়ে সেই আতঙ্ক অনুভব করে ফিরে আসতে হয় বাড়িতে।
কিন্তু সেদিন তার ব্যত্যয় ঘটল। ফিরছিলাম স্কুল থেকে, হঠাৎ দেখি এক জেলেবাড়ির সামনে খুব ভিড়। তাে আমিও ভিড় দেখে দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে বােঝার চেষ্টা করি কী কারণে ভিড়! গ্রামেগঞ্জে জীবন চলে রয়েবসে, হঠাৎ কোনও উত্তেজনার কারণ ঘটলে সবাই ছুটে আসে কী ঘটেছে! সেই ঘটনা নিয়ে দুদশদিন আলােচনা-রটনা চলবে যতদিন না নতুন কোনও ঘটনার আবিভাব ঘটে।
সেদিন শুনলাম জেলেবউকে ভূতে পেয়েছে, ধরেছে তার কতদিন আগে মরে-যাওয়া প্ৰশুর। কাল সন্ধেবেলা পেয়েছে, আজ বিকেল হতে চলল, এখনও বহাল তবিয়তে তার ঘাড়ে! কোথায় তক্কেতক্কে ছিল ওঝা, খবর পাওয়ামাত্র আজ দুপুরের দিকে সে-ও এসে উপস্থিত। কিন্তু তাদের ঘরটা তাে বেজায় ছােটো, সেখানে ভূতে-পাওয়া বউকে নিয়ে সেঁধিয়ে যাওয়ার পরিসর নেই, অতএব বউটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বাড়ির সামনে উঠোনে, তার সামনে একটা বলশালী ঝাঁটা নিয়ে দাঁড়িয়ে সেই ওঝা। | এই ওঝাকে আগে কোনও দিন দেখিনি, একটু রােগাপানা, কিন্তু চোখদুটো ঠিকরে বেরােচ্ছে চোখের কোটরের বাইরে। সেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা বউটির উদ্দেশে সে থেকে-থেকে চিৎকার করে বলছে, মারের এখনও হয়েছে কি, মেরে তাের পিঠ ভেঙে দেব! বল তুই যাবি কি না!
-না, যাবনা! আমার উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে! বাবা বলে একটুও রেহাই দেয় না ছেলেটা! মদ খেয়ে এসে বাবা-মাকে আকথা-কুকথা বলবে, বউটাকে মারবে, এ তাে আর সহ্য করা যায় না! আজ আমার একদিন আর ভােলার একদিন! কিছুতেই এ-বাড়ি ছেড়ে যাব না!
ভােলা হল এই বউটির স্বামী, তাকিয়ে দেখি ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে দেখছে তার বাবার কাণ্ডকারখানা। মুখটা চুপসে গেছে ভয়ে। তার বাবা মারা গেছে তাও ক-বছর হয়ে গেল, হঠাৎ এতদিন কোথায় তর্কে তঙ্কে বসে ছিল, আজ হঠাৎ তার বউয়ের ঘাড়ে–
| ভূত বিয়য়ে আমাদের এক মাস্টারমশাই প্রায়ই বলেন, ভূত বলে কিছু নেই। ও হল এক ধরনের হিস্টেরিয়া। কিন্তু হিস্টেরিয়ার রােগী কি এরকম তেরিয়া হয়ে কথা বলে!
ল( করে দেখি ইতিমধ্যে প্রচণ্ড মার খেয়েছে বউটি, মারের চোটে তার পিঠ রক্তারক্তি, মার খেয়ে গােঙাচ্ছে সেই অবস্থায়, আচ্ছন্নতার মধ্যে কীরকম তড়পে চলেছে সেই ওঝার উদ্দেশে। যদিও সেই কথাগুলাের একটুও আমাদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল না, কিন্তু ওঝা নিশ্চয় বুঝতে পারছিল, তার গােঙানির উত্তরে আরও ত্রু(দ্ধ হয়ে চেঁচাতে লাগল, যাবি না! তাের এত সাহস, জানিস তাের সামনে কে দাঁড়িয়ে
আছে! তাের যম।
বলেই একটা ছড়া কাটতে শুরু করে, দ্রুতবেগে আউড়ে যাওয়া সেই ছড়ার দু-চারটে শব্দ যা আমাদের কানে আসছিল, তা এরকমঃ
শ্যাওড়া গাছে থাকিস যদি সপাং চাঁপার ডালে থাকিস যদি সপাং সাতখানা গাঁ পার হয়ে এই কিস্টো ওঝা হাজির যখন হয়েছে আজ
মেরেই তােরে করবে পাটলাস বলেই সপাং সপাং করে সেই ঝাঁটা দিয়ে মারতে শুরু করল তার পিঠে। সেই মার দেখে আমারই শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে, আর আমার পাশে আরও কতক মেয়ে-বউ দাঁড়িয়ে দেখছিল সেই দৃশ্য, তারা চোখমুখ কুঁচকে বলছিল, আহা বেচারি, আন্নাটা মুখচোরা মেয়ে, আর ওর ঐশুর কিনা ধরল ওকেই! কী মারটাই না খাচ্ছে!
ত্র(মে ভিড় বাড়তে শুরু করে, চারদিক থেকে নানা মন্তব্যও, তার মধ্যে ঝাঁটাপেটা চলছেনির্মমভাবে। কিছুণ পর জেলে-বউ নেতিয়ে পড়ল মাটিতে, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, যাব, যাব, চলে যাব।
এত(ণে ওঝা-লােকটির মুখে বিজয়ীর হাসি। হাতের ঝটিাটি শূন্যে ঘােরাতে ঘােরাতে বলল, যাবি না মানে! কিষ্টো ওঝা যখন কেসটা নিয়েছে তখন তার হাতেই তাের মৃত্যু!
জেলে-বউ তখনও গােঙানাে কণ্ঠস্বরে বলে চলেছে, কিন্তু এও বলে যাচ্ছি ভােলা যাদি ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করে তা হলে কিন্তু আবার আসপাে!
বলেই সেই নেতিয়ে পড়া বউটার কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে বলল, বল, কীভাবে যাবি? ওই শিরীষগাছটার ডাল ভেঙে যাবি? না, জলভর্তি কলসি মুখে নিয়ে যাবি?
ওঝার কথায় উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে যায়। আমি নিজেও খুব উত্তেজিত বােধ করি কেন না এর আগে বহুবার শুনেছি গাঁয়ে ভূতে-পাওয়া লােকদের ঘাড় থেকে যখন ভূতেরা চলে যায়, যাওয়ার সময়টা নাকি রীতিমতাে রােমহর্ষক। এমন নাকি হয় যে, ভূতরা যখন চলে যায় অশথগাছের মস্ত ডাল ভেঙে পড়ে মড়মড় করে।
বিষয়টা নিয়ে ঘাের সন্দেহ ছিল আমার। ভূত ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়। হিস্টেরিয়া হলে কি মানুষ এরকম উল্টাপাল্টা বকে! জেলে-বউ এবার বলল, কলসি। কলসি–
ওঝা তত্ত্ব ণাৎ ভিড়ের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলল, আই কে আছাে। এক কলসি জল নে এসাে–
তার কথা শেষ না হতে পাশের বাড়ির একজন বউ কাঁখে করে নিয়ে এল একটা মেটে কলসি ভর্তি জল নিয়ে। সেই কলসি তার সামনে রেখে ওঝা বলল, কাঁখে করে নে যাবিনি। দাঁতে করে তুলে নে যাবি। এক-পা দু-পা তিন-পা, ব্যস, তারপর যেন তােকে আর এ দিগরে না দেখি!
পর(ণেই যে-দৃশ্য চোখের সামনে ঘটল তা প্রায় অবিস্য। নেতিয়ে-পড়া জেলে বউ উঠে বসে, তারপর সেই জলভর্তি কলসির কানা চেপে ধরল তার দু-পাটি দাঁতের মধ্যে। ভারী কলসিটা সত্যিই তুলে ধরল দাঁত দিয়ে, অবশ্য সােজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না, একটু নুয়ে এগিয়ে গেল এক-দুই-তিন পা, তারপর কলসিসুদ্ধ দড়াম করে উল্টে পড়ল মাটিতে। কলসি ভেঙে চুরমার, সারা উঠোন জলে জলময়।
মাটিতে পড়েই জেলে-বউ একেবারে অজ্ঞান, তার দুই হাতে মুঠি লেগে গেল শক্ত করে, দু-চোখ বােজা, দাঁতে দাঁত লেগে শরীর স্থির।
সমস্ত উঠোনে তখন লােকে লােকারণ্য। কয়েকজন বউ তাকে ঘিরে ধরে তার মুখে দিতে শুরু করল জলের ঝাপট। একের পর এক ঝাপট দিতে কিছু(ণ করে বড়াে করে একটা ঘাস ফেলল সেই জেলে-বউ। অমনি সমস্বরে সবাই বলল, ও রে জ্ঞান ফিরেছে, জ্ঞান ফিরেছে!
| তারও কিছুণ পর সে অতিকষ্টে উঠে বসল মাটিতে। বাকি বউরা ত( নি ভিজে গােবর হয়ে যাওয়া তার শরীরটা ধরে ধরে নিয়ে গেল ঘরের ভিতর।
ওঝা তখন তার তর্জনী শূন্যে ঘােরাতে ঘােরােতে বলল, আই যাও সব। কাছেপিঠে থাকবে না। এখনও তেনার আত্মা কিন্তু কাছেপিঠে আছে।
বলতেই অমনি ভিড় পাতলা হতে শুরু করে।
আমরাও দ্রুত ঘরমুখাে। যেতে যেতে মনে হচ্ছিল কলসি-ভরা জল দাঁতে তুলে নিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টকর, কিন্তু সে তবু সম্ভব। কিন্তু ভূতটা যদি বলত, শিরীষগাছের ডাল ভেঙে যাবে, সত্যিই কি পারত! ভূতটা বেশ চালাক আছে বলেই সহজ উপায়টা মেনে নিয়েছে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।