“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

ছায়াশরীরি  (রহস্য ভূতের গল্প) 

ছায়ামূর্তি আমার সঙ্গে চলতে লাগল। আকাশে ধূসর কুয়াশা মাখা কৃষ্ণা সপ্তমীর চাঁদ আর ছায়াসঙ্গী যেন লেপটে র‌ইল আমার শীতবন্ধু হয়ে । দূরে কয়লার উনুন থেকে ধোঁয়াটে গন্ধ পাওয়া গেল । আবাসনের তুলসীমঞ্চে লাল-নীল-সবুজ আলো জ্বলছে টিমটিম করে ।  ঝিমধরা নেশায় আমি আবিষ্ট হয়ে গেলাম যেন । হাঁটছি ঠান্ডার মধ্যে কুয়াশা মেখে শরীরের ওম নিতে । শরীর গরম করতে । ভালোই লাগছিল শুধু ঐ ছায়াসঙ্গী  বড্ড অন্যমনস্ক করে দিল ।   তার দিকে চোখ দুটো স্থির করছি আর এগুচ্ছি  ।  পরণে শাড়ির মত কি একটা । পরিপাটী করে মুড়ে রেখেছে নিজেকে । মাথায় মুড়ি দেওয়া ।   নারী-পুরুষ বোঝার উপায় নেই । ডাইনে বাঁয়ে কোনো দিকে তাকাচ্ছেনা সে । পেছনেও  ফিরছেনা । কোথাও কোনো আওয়াজ নেই.. কেবল মাঝে মধ্যে দূর থেকে ট্রেনের হুইশ্‌ল আর দু-একবার ঝিঁঝিঁর ডাক । ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় দাঁড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করল তাকে। আলাপ করলেও মন্দ হবেনা.. ভাবলাম ।   
প্রায় অনেকবছর বাদে এসেছি বোলপুরে। বোলপুরের গেঁয়ো ভাবাটুকুনি যেন হঠাত করে শহরায়নের স্বীকার হয়েছে। এধার ওধার বালির পাহাড়, ষ্টোন চিপ্সে বোঝাই রাস্তাঘাট.. যেন কংক্রীটের জংগলে রাঙামাটীর গন্ধটা একটু একটু করে উবে যাচ্ছে ।  জল-জঙ্গল বুজিয়ে ইমারতের পর ইমারত । কলকাতার কাছে বলেই হয়ত উইকএন্ড ট্রিপের আখড়া হয়ে উঠছে এই অঞ্চল ।    অফিসের ভাড়া নেওয়া কিছু ঘর আছে এই আবাসনের মধ্যে । কেয়ারটেকার আছে । যারা আসে তারা চাবি নিয়ে ঘর খোলে । আর বাইরে থেকে খাবার এনে খাওয়া যায় । দিন চারপাঁচ এমন করে কাটাতে অসুবিধে হয়না আমার । বরং শহরের ভীড়ভাট্টা ছেড়ে বেশ ভালোই লাগে আজকাল । সারাদিনের কাজকর্ম সেরে আমার এই একা একা হাঁটতে বেরুনোটা যেন উপরি পাওয়া । এমন অবসর তো পাইনা কোলকাতায় । দু-একদিন কাজের ফাঁকে ছুটি পেলেই কোলকাতার জন্য মন উচাটন। তখন অবিশ্যি মন্দ লাগেনা শহুরে কোলাহল, সাংসারিক ঝুটঝামেলা। আবার ফিরে এসেই ডুব দিতে হয় অফিসের ট্যুরে। নানা অ্যাসাইনমেন্টের চাপে  প্রাকৃতিক নিসর্গকে কাছ থেকে দেখা যায়না । শুধু এই সান্ধ্য ভ্রমণটুকু লেপটে থাকে আমার রোজের কর্ম ব্যস্ততার ফাঁকে ।   
কিন্তু আজ দেখছি এই সান্ধ্যভ্রমণ বড্ড অস্বস্তি দিচ্ছে আমাকে । কেয়ারটেকারের ঘর মেনগেটের পাশেই । সেখান অবধি গিয়ে একবার জিগেস করে আসতে হবে নতুন এই অতিথির কথা । ভাবছি মেনগেট অবধি যাব তার ফাঁকেই হঠাত দেখি সেই ছায়ামূর্তি উধাও। অন্ধকারে বুঝি অন্যদিকে ঘুরে গেল সে ।  কোমর সমান মেহেন্দী গাছের বেড়ায় এক অনবদ্য ভুলভুলাইয়া । তার ফাঁকে ঐ অন্ধকারে কেউ বাঁক নিলে বোঝাও যাবেনা ।    
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কেয়ারটেকার মহাদেবের ঘরের সামনে এসে পৌঁছলাম ।  মহাদেব তার ঘরের সামনে ধুনি জ্বালিয়েছে সামান্য কাঠকুটো জ্বেলে । বেশ ঠান্ডা সেদিন । আমাকে দেখতে পেয়েই চৌকাঠ পেরিয়ে বাইরে এসে বলল 
-বলুন স্যার।  কিছু দরকার আছে? 
-এখানে কোনো নতুন আবাসিক বা ভাড়াটে  এসেছেন? 
-না তো স্যার, কেন বলুন তো ?  
-নাহ! আজ একজন লম্বা চওড়া মানুষ হাঁটছিলেন এই আবাসনের মধ্যেই। মনে তো হল এ জায়গাটি তার বেশ চেনা । হয়ত আমি দেখিনি এঁকে ।  গত সপ্তাহান্তে বাড়ি গেছিলাম, তাই ভাবলাম নতুন কেউ বুঝি এসেছেন এখানে ।  
-এবার বুঝেছি স্যার, আপনি কার কথা বলছেন।  
-ঠিক ধরেছি তাহলে বলো। এ ব্যাক্তি নতুন এখানে । 
-স্যার, আজ কি আপনি বাইরে খেতে বেরুবেন?  
-কেন বলত? 
-নাহ, তাহলে আমিও যাব বাজারের দিকে । যেতে যেতে রাস্তায় আপনাকে বলব সব । সে এক কাহিনী । এরপর বাজারে গেলে শীতের রাতে কোনো সবজী পাবনা ।  
-ঠিক আছে, চলো তাহলে, আমিও তো বাজারের দিকেই যাব রুটির মিল খেতে । যেতে যেতে শুনব তাহলে ।  
বাড়ির দরজায় শেকল তুলে দিয়ে তালা লাগাতে লাগাতে মহাদেব বলল 
-যা দিনকাল পড়ল স্যার ! বাড়ির জন্যে আমার খুব চিন্তা হয় । দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার পরিবারকে ফেলে এখানে পড়ে থাকি পেটের জন্যে । জেলার দিকে কত ঘটনা  ঘটছে রোজ.. কাগজে পড়ি । 
-আরে শুধু জেলা বলছ মহাদেব? আমাদের কোলকাতায় আজকাল দিনে দুপুরে কত কি ঘটছে হরবকত ।   আমার মা-বৌ একা থাকে  বাড়িতে । আমার বাবার রক্ত জল করা পয়সায় বানানো ঐ বাড়িটুকুনি পাড়ার প্রোমোটার নেবে বলে কি কান্ডটাই না করছে ! পাঁচকাটা জমি আছে বাড়ির লাগোয়া । সেটার ওপর ব্যাটাদের কি লোভ! কত টাকার লোভ দেখিয়ে ঐ বাড়ি-জমি তারা নেবে বলে মুখিয়ে আছে । শুধু সেই জন্যেই তো প্রতি সপ্তাহের শেষে আমার বাড়ি যাওয়া এই ট্রেন জার্নি করে । মা-বৌকে এখানে নিয়ে এসেও শান্তি নেই । তাহলে একলাটি বাড়িটা বুঝি আর থাকতেই দেবেনা ওরা ।  
হাঁটছি মহাদেবের সঙ্গে । ক্যানাল পেরিয়ে শুনশান রাস্তা দিয়ে । দুরে শুধু মাইকে হিন্দী গানের শব্দ ভেসে আসতে লাগল । তার‌ই মাঝে মহাদেব শুরু করল । 
পুরুলিয়ার জয়চন্ডী পাহাড়ের কোলে থাকত প্রমীলা । গাঁয়ের সকলের পেমলা ।  মা অনেকদিন তাকে ছেড়ে চলে গেছে আর বাবা তাকে বুকে করে মানুষ করেছে ছোট থেকে । একটু পড়াশুনোও শিখিয়েছে । গ্রাম পঞ্চায়েতের নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতির প্রয়াসে যতটুকুনি হয় আর কি ! বাবার একফালি ধানজমি আর দুটো বিরির ক্ষেতও আছে । পেমলা রোজ ভোরে উঠে একখানা দশহাতি ডুরে শাড়ি গাছ কোমর দিয়ে বেঁধে আর গোড়ালির ওপর অবধি রেখে মুক্ত প্রকৃতির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে । গ্রামের সকলে তাকে খুব ভালবাসে । কেউ চারটে কুমড়োফুল, কেউ একঝুড়ি পাটশাক; কেউ দেয় ওলের ডেগো আর পেমলা বাড়ি ফিরে কাঠের জালে রান্না চাপায় ক্ষেতের লাল লাল মিষ্টি মোটা চালের ভাত । একটু কিছু হলেই খাসা চলে যায় বাপ-বেটির । কপাল ভাল হলে আলের ধার থেকে দুটো খলসে মাছ কি কাঁসাইয়ের তীর অবধি গেলে একমুঠো চিতি কাঁকড়াও জুটে যায় তার ভাগ্যে । তেল, হলুদ লঙ্কা দিয়ে খাসা বাটি চচ্চড়ি রেঁধে ফেলে সে । পেমলা আর তার বাবার জীবনদর্শন ছিল সাদামাটা। 
-তারপর বল কি হল? 
যা বলছিলাম স্যার,  ওরা বাপ-বেটি খুব সুখি। হেসেখেলেই এভাবে কেটে যাচ্ছিল । পেমলা তখন বছর পনেরোর যুবতী। দোহারা, মাজামাজা গায়ের রঙ  । একপিঠ কালো চুল আর বড় বড় চোখে বুদ্ধির ছোঁয়া । প্রতিদিনের রোজনামচায় কিছু একটা নতুন করে শেখার চেষ্টা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় সর্বক্ষণ ।  একটা নতুন ফল কুড়িয়ে তার স্বাদ পাওয়া কি একটা অচেনা ফুল চোখে দেখা কি একটা নতুন পাখির ডাক অনুসন্ধান করে তার পেছনে ধাওয়া করা । বাবা মাঝে মাঝে বকুনিও দেয় ভালবেসে সোমত্ত মেয়েকে.. “অত্ত দূর দূর নাই যাস বটে’ কিন্তু কিই বা করে পেমলা একলাটি এই একরত্তি জীবনটাকে নিয়ে ? বাবা তো সারাক্ষণ ব্যস্ত ক্ষেতের কাজ নিয়ে আর শহরের মত গ্রামের জীবনে তো কোনো কর্মব্যস্ততা নেই, নেই কোনো যান্ত্রিকতা কিম্বা কোনো বৈচিত্র্য তাই এই প্রকৃতিকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে হয় পেমলাকে । বড় জোড় পালপার্বণে টাঁড়ে আসে বড় বড় যাত্রার দল । কি ভাটবাঁধে কাপড় বেঁধে সিনেমার ভিডিও প্রোজেক্ট করা হয় ঢেঁড়া পিটিয়ে আশপাশের গাঁ থেকে লোক জড়ো করা হয় তখন বাপবেটি পাহাড় থেকে নেমে আসে যাত্রা কিম্বা সিনেমা দেখতে । এভাবেই বেশ চলছিল । হঠাত কিসের গন্ধ পায় তারা …
-একটা কথা বলি মহাদেব? বাজার তো এসেই গেল। আজ না হয় বাজার করে আমার সঙ্গেই রুটি-সবজী খেয়ে নাও । রোজ তো একার জন্য রান্না করো । আর খেতে খেতে বাকী গল্পটা না হয় শুনে নেব । তুমি তো বেশ গল্প বলতে পারো ভাই।  
-কি যে বলেন স্যার। আমি আবার ভেতো বাঙালী যে। দুবেলা ভাত না হলে আমার রাতে ঘুম আসেনা । 
-ঠিক আছে বাবা, তুমি না হয় ভাত‌ই খেও । 
-যা বলেন আপনি ।  বলেই মহাদেব আবারো শুরু করল ।  
বাপ-বেটির  মনে কু গাইতে লাগল । আবার বুঝি সেই ঝুপড়ি ভাঙতে এল ! না কি দলবাজি ? সেরাতে সত্যি এক আকাশের অনেক রঙ দেখল পেমলা । কালো ধোঁয়া আকাশে উড়ছিল.. নীলের মধ্যে কেমন যেন হারিয়ে যাচ্ছিল… লাল আগুনের লকলকে শিখা মধ্যে মধ্যে উঁকি দিচ্ছিল, সেই কালো ধোঁয়ার সাপের মাঝ থেকে । 
-আচ্ছা!  এবার তবে বলো মাছ-ভাত না ডিম-ভাত খাবে? আমি তো রাতে আমিষ খাইনা । 
-স্যার, আমিও নিরামিশ খাব তবে । 
দুজনের ভাত-রুটি-সবজী মিলের অর্ডার দিয়ে টেবিলে বসে আবার  মন দিলাম মহাদেবের গল্পের দিকে ।  
কেমন সুন্দর এই পৃথিবীর বুকে একটা সুন্দর প্রকৃতি ! তবুও কেন এত হানাহানি? জমি নিয়ে জোতদারদের ঝগড়া, ভাগচাষিদের এত বচসা ? সকলের পৃথিবী কেন সুখের নয় ?  গ্রামে তো নিত্যি লেগে থাকে এই সব । ছোট থেকে দেখে আসছে সে ।  পেমলা ভাবে এই সব । বলতে পারেনা কারোকে, গড়তে চায় কেবল ভাঙতে পারেনা । সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘরে এসে দেখে সব শেষ । ঠিক যেমনটি ভাবা ! গাঁয়ের আশে পাশের সকলকে নামতে হবে সেই আন্দোলনে । তার বাবা বুঝি প্রতিবাদ করতে গেছিল , ঝান্ডা হাতে নামতে চায়নি । ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, আরো স্বাধীন হতে হবে সেই দাবীতে । পেমলার এসব পছন্দ না হলে কি হবে সে জানত বড় গাছের আওতায় আছে তারা বাপবেটি মিলে..তাদের গ্রামে সব আছে । আছে চাষ করার ক্ষেত, জল, শৌচাগার, ইস্কুল, হাসপাতাল । তবুও ঝামেলা ঝঞ্ঝাট, জোরাজুরি । বাবার সঙ্গে ঘর আঁকড়ে বসে র‌ইল পেমলা । মশালের আগুনে একরত্তি কুঁড়ে পুড়ে ছাই হ’ল । তখন পালাতে যাবে তারা… বাবার মাথায় পড়ল এক লোহার রড । আর বাবা সঙ্গে সঙ্গে শেষ । অভাগী পেমলার আর কেউ র‌ইলনা তার  জন্য ভাববার ।  জয়চন্ডী-পাহাড়ের কালীকে দূর থেকে প্রণাম জানিয়ে নিজেকে বাঁচাতে সে ছুটল সেই পথ ধরে যে দিকে দুচোখ যায় ।
বাবার জন্য কষ্ট হলেও নিজেকে বাঁচাতে হবে !  পেমলা ছুটতে ছুটতে শালতোড়ার পথ ধরে মেজিয়া থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের পাশ দিয়ে বড়জোড়ায় পৌঁছাল । তারপর দুর্গাপুর ব্যারেজে পৌঁছে খেয়াল হ’ল সন্ধ্যে হয়ে গেছে । তার সম্বল বলতে একটা পুঁটলি যার মধ্যে আছে তার মায়ের দুগাছি সোনার রুলি আর একটা নোলক । সব কিছু ছাড়তে পারবে সে । এ দুটিকে নয় । ব্যারেজে চলছিল কাজ । দিনমজুরদের ঝুপড়ির কাছে দেখতে পেল দু’একজন বসে উনুন জ্বেলে হাতরুটি আর আলুপোড়া বানাচ্ছে । একবার বাবা বানিয়ে দিয়ে ছিল তাকে । বড় বড় ক্ষেতের আলু আর বিলাইতী কাঠ-কুটো জ্বেলে পুড়িয়ে খোসাটা ফেলে তেল, নুন আর লঙ্কা দিয়ে মেখে নিতে হয় । আর সঙ্গে পেঁয়াজ থাকলে তো কথাই নেই । সেদিন ছিল মাঘমাসের  সন্ধ্যেবেলা । রুটি বানিয়েছিল পেমলা । আর তার বাবার বানানো আলু-টমেটো পোড়া দিয়ে জম্পেশ খাওয়া হয়েছিল বাপ-বেটির । কত সুখ ছিল তাদের ! তবুও স‌ইল না কপালে !
জনমজুরদের উনুনের পাশটায় গিয়ে দাঁড়াল । খুব চালাক মেয়ে পেমলা । আগে দেখে নিল আশপাশ আর মানুষ জনের মুখের হাবভাব । অবস্থা বুঝে কথা পাড়ল । এতক্ষণে বাবার জন্য শোকপর্বও উবে গেছে । বাবার সেই কথাটা “দেখিস বাবা, সোমত্ত মেয়ে তুই, যেখান সেখান চলে যাস না’… কেবল তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে তখন । একে পেটের খিদে তাতে আবার নিজের বিপদের ঝুঁকি ! রাতের বেলা এইটুকু মেয়ে , যদি কোনো অঘটন ঘটে যায় ! ঘর পুড়ল, বাবা মরল । 
সেই উনুনের ধারে একটা লোক । নাম বীরবল । তার আয়তঘন চোখের পাতায় চোখ রেখেই পেমলা বুঝল এ লোকটা খারাপ নয়  । আর বীরবলও বুঝল যে মেয়েটা আশ্রয়প্রার্থী, সাহায্য চায় তার । কি জানি কেমন যেন প্রথম আলাপেই পেমলার বুদ্ধির ফাঁদে ধরা পড়ে গেল বীরবল । বীরবল ভালো লোক হতেই হবে । পেমলার ভগবান সব নিয়েছে । আর কত খারাপ করবে তার ঠাকুর ?
তার মায়ের নাকি এমন মানুষ চেনার অদ্ভূত ক্ষমতা ছিল । অপরিচিতের সঙ্গে প্রথম আলাপেই বুঝে নিত কে কেমন । সে বীরবলের নরম মনের নাগাল পেতেই বীরবল একভাঁড় জল এনে দিয়ে বলল” আগে তো জলটা খেয়ে গলাটা ভেজাও তারপর তোমার সব কথা শুনব” । জল শেষ হতেই বীরবল বলল ‘ কি ব্যাপার বলতো ? এত রাতে কোথায় চলেছ একা একা ? ‘ পেমলা নিসঙ্কোচে বলল সবকিছু । কিন্তু বাবার কথা বলতে গিয়ে তার দুচোখে নেমে এল বাঁধভাঙা কান্না । বীরবল সেদিনকার মত রুটি-আলুপোড়া দিল খেতে । আর বললে ” আজ রাতটায় তুমি শোবে এই ঝুপড়ির মধ্যে আর আমি থাকব বাইরে, তোমায় পাহারা দেব’
ভোর হতে না হতেই ঘুম ভাঙল পেমলার । উঠেই দেখে বীরবল নেই । পেমলা পাশের ক্যানেলের জলে হাত-পা-মুখ ধুয়ে নিল  আর নতুন গ্রামের নতুন প্রকৃতির মধ্যে আবার খুঁজে পেল পুরোনো পেমলাকে । 
আবার সে ছুটে যাবে ব্যারাজের এ মাথা থেকে ও মাথা । জলের তোড়ে ধুয়ে যাবে তার মনখারাপ । আবার পাখী ডাকবে, ফুল ফুটবে এখানে..ভাবতে ভাবতে কেঁদে ফেলল । আর তখনই সে  দেখতে পেল  গতরাতের অন্ধকারে তার আশ্রয়দাতা  পুরুষটার না দেখা সুঠাম চেহারা । বিশাল লম্বা মেদহীন দেহ । ঠিক তার মতন গায়ের রঙ । না কালো, না ফরসা । হাতে পেমলার জন্য একটা ছোট ভাঁড়ে চা আর একখানা টোষ্ট বিস্কুট.. “কোথায় যাবে এখন ? কিছু ঠিক করলে ?’
পেমলা বললে “কুথায় আর যাবি ? কে আছে গো আমার ? তুমার বাড়ি যাব বটে’ 
পেমলার অসহায়তা আর বীরবলের সহমর্মিতা… এক নিখাদ ভালোলাগায় দুজনেই আপ্লুত হ’ল । যেন যুগযুগান্ত ধরে কাছে টানার আলিঙ্গন্! যা সার্বজনীন, যা চিরন্তন । পেমলা-বীরবলের ভালোলাগার মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠল । এই মূহুর্তে পেমলা খুব পরিণত হয়ে উঠল আরো কিছুটা । বীরবল তার কাছে এসে হাতের ওপর হাত রেখে বললে ‘যাবি আমার সঙ্গে ?’
হাঁটছে ওরা দুটিতে মিলে আর জিরোচ্ছে একটু । এভাবে পেটে দানাপানি নেই আর ক্লান্ত দুটিতে মিলে বর্ধমানের কাছাকাছি পৌঁছল। তখন অনেক বাজে ।  মাঝেমাঝে পেমলা বীরবলের হাতদুটো জোরে চেপে ধরে থাকে। ভয় হয় আবারো যদি বাবার মত হারাতে হয় মনের মানুষটাকে । বীরবলও যেন মনে খুব বল পেয়েছে । এদ্দিনে ওর জন্য ভাববার মত কারোকে পাওয়া গেছে । 
বীরবল বললে” আমার বাড়ি নাইরে, আমার কেউ নাই, চাল নাই, চুলো নাই, আমার জন্য কাঁদবার কেউ নাই রে’  
পেমলা বললে, “তো কি! এই তো আমি হলাম আজ থেকে, তুমার জন্য হাসব, কাঁদব, গাইব, রাঁধাবাড়া করব, দুজনায় ঘুরতে যাব মেলাতে , আজ থেকে আমরা দুজনে রোজ ভোর দেখব একসঙ্গে’ 
-মহাদেব, যা গল্প তোমার কাছে শুনছি তা শুনে এখনো অবধি আমার দেখা সেই ছায়ামূর্তির কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছিনা । এবার তাড়াতাড়ি বলো ভায়া । খাওয়া শেষ করে মুখ আঁচাতে আঁচাতে বললাম । 
-অনেকটা পথ তো হেঁটে যতে হবে আমাদের । ততক্ষণে বাকীটুকু হয়ে যাবে স্যার ।  
একশ’দিনের কাজ সেদিনের মত শেষ হয়েছে বীরবলের । এবার আবার যাযাবরী জীবনে পা রাখা। অন্য শহরে যাওয়ার তোড়জোড়। সঙ্গে কেবল একশো দিনের খোরাকি । আর সঙ্গী হল পেমলা নামের এক মেয়ে । 
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন ভোরেই যাত্রা শুরু করল । কিছুটা ভীড় বাসে আর কিছুটা হেঁটে । পাঞ্চেত পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বাস ছুটল তাদের । যেন অপরিচিত এক ভালোলাগায় আর কিছুটা অনিশ্চয়তায় ।  বরজোড়া আর তারপর বাঁকুড়াকে বাইপাস করে দুর্গাপুর।  বাস থামে একটু। যাত্রী তোলে আর নামায়  আর পেমলা-বীরবলের চোখের ইশারায়  যাত্রাপথ গল্প হয়ে যায়। পথ ফুরিয়ে আসে । এবার ইলামবাজারের জঙ্গলে নেমে পড়ে ওরা । খুঁজতে হবে জায়গা। পাততে হবে ঘর। এদ্দিন বীরবল ছিল একা পুরুষমানুষ । সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে কোথায় থাকবে ? লোকে কত প্রশ্ন করবে তাদের…খুব টানাপোড়েনে পড়ে গেল ।  
শাল-সোনাঝুরির অ্যাভিনিউ। জোর গতিতে বাস-ট্রাক যাচ্ছে ধুলো উড়িয়ে । বীরবল পেমলার কাছে এসে বলল” দিনকাল খারাপ, আমরা এভাবে থাকাথাকি করলে লোকে কি বলবে, চল্‌ গিয়ে একটা মন্দিরে বিয়েটা সেরে ফেলি ।” পেমলার চোখেমুখে বিস্ময় । সে তখন চায় একজন অভিভাবক। যে তাকে আগলে রাখবে সারা জীবন ।  সে কি উত্তর দেবে ভেবে পেলনা । হাঁটতে হাঁটতে ঘন্টা দুয়েক পার হয়ে গেছে ।  বোলপুরে পা রেখে ওরা একটু জিরোয়, একটু কিছু খায় আবার চলে নিশ্চিত ঠিকানা বাঁধতে । শ্যামবাটীর ক্যানাল মোড়ে এসে কঙ্কালীতলার খোঁজ পেল । 
-বিয়ে করে নিয়ে ওরা একটু সুখ চেয়েছিল, জানেন স্যার? 
-তা বাধ সাধল কে ? 
-আমাদের এই আবাসন তখন নতুন হয়েছে । বীরবল এখানে কাজ নিল বাগান দেখাশুনার আর পেমলা দু-একটা বাড়ির কাজও পেয়ে গেল ।  বাগান করার ফাঁকে ফাঁকে বীরবল মাঝেমাঝে জনমজুরের কাজ করতেও চলে যেত ঠিক যেমন আগে করত । পেমলা তখন একা থাকত ঘরে । সেই সুযোগে ঘটে গেল চরম দুর্ঘটনা। অত ডাগরডোগর মেয়েটা আর শয়তান মানুষগুলোর চোখ এড়ায় কি করে? যে বাবুর বাড়ি কাজ করত সেখানেই সন্ধ্যেবেলায় রুটি বানাতে যেত পেমলা । বাবুটা আপিস থেকে ফিরে মদ খেত প্রায় রোজ । একদিন মেয়েটার ওপর কি অত্যাচারই না করলে স্যার!  বারবার  ধর্ষণ।
-আর সেই লোকটার কি হল তবে? শাস্তি হলনা?  
-সুবিচার হয় স্যার আমাদের দেশে? পয়সা থাকলে সব আগুণ নিমেষেই নিভিয়ে দেওয়া যায় । ক’দিন হাজতবাস করেই জামিন পেয়ে যায় তারা । অনেক নেতামন্ত্রীদের আনাগোনা ছিল ওনার ফ্ল্যাটে । পরে জানলাম সেকথা ।   ধর্ষিতা পেমলা না কি গর্ভবতী ছিল ।  সেদিনের সেই ভয়ংকার কান্ডে ওর পেটের মাসদুয়েকের বাচ্ছাটা মারা গেছিল স্যার । তাইজন্যেই তো মেয়েটা গায়ে আগুণ দিয়েছিল । বিচারের রায়  পেমলাকে  দোষী সাব্যস্ত করেছিল  । ঘরমোছার বালতি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে তার অঘটন বলা হয়েছিল । হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সকলের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল নাকি । রেপকেসটাকে আমূল গর্ভপাত বলে সাজানো হয়েছিল স্যার তাই জন্যেই তো মেয়েটার অত দুঃখ ।  লজ্জায়-অপমানে মেয়েটা  গায়ে আগুন দিয়েছিল । আমরা সকলেই ছিলাম হাসপাতালে । বাঁচানো যায়নি তাকে । বীরবল সেইথেকেই কেমন যেন হয়ে গেল স্যার । ও আর এখানে বাগানের কাজ করেনা । মেয়েটাকে পোড়াতেও যায়নি । সেইথেকে লোকটা যে কেমন গুম্‌ মেরে গেল! না বলে একটাও কথা, না করে কোনো কাজ। শুধু খিদে পেলে দোকানের সামনে যায়। কেউ কিছু দিলে খায় নয়ত উপোস করেই থাকে । আর রোজ সন্ধ্যে হলেই এই আবাসনের বাগানে এসে ঘুরপাক খায় । কি আছে তার মাথায় কে জানে ।  
বোধহয় ভুলতে পারছেনা তার পেমলাকে । হয়তবা ভাবছে পয়সার লোভে বাইরে কাজ করতে গিয়েই এই বিপত্তি হল বৌটার । বৌ-বাচ্ছা সব গেল তার .. নিজেকে বুঝি ক্ষমা করতে পারেনা । বাউলের আখড়ায় যায় । গান শোনে। একটু গাঁজা খেয়ে রাস্তায় উল্টে পড়ে থাকে । কিন্তু জ্ঞান থাকলে সন্ধ্যের ঝুলে এইখানে একটিবার তার ঘুরপাক খেতে আসা চাই-ই ।  
-স্যার ওকে কিছু জিগেস করবেননা যেন। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গাল দেবে আপনাকে । আবাসিকদের ওপর খুব রাগ ওর । 
ভাবতে লাগলাম আমি ।  কত সুখের হতে পারত পেমলা-বীরবলের সুখের সংসার, সোনার সংসার, একটা ছোট্ট বাচ্ছা কোলে করে ।  আর সেই ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেলে আমার অস্বস্তির কারণ নেই । বীরবলও তো মানুষ  । আইনকানুন সব গুলে খেয়ে নিয়েছে তার দেশ ।আইন আদালত সবার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে বীরবল । কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই কারোর ওপর । দুদন্ড জিরেন চায় সে রোজ সন্ধ্যেবেলায় । ঠিক যেমন কাজ থেকে ঘরে ফিরে নিজের ছোট্ট কুঁড়েটিতে মুখোমুখি বসত দুজনায়। হয়তবা এফ.এম চলত একটু আধটু। গরম ভাতের গন্ধে সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত ঘন হত । প্রগাঢ় হত ওদের প্রেম । কাছে টেনে নিত বীরবল তার পেমলাকে । মনে মনে বললাম ঠাকুর ওকে চলার শক্তি দাও । 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।