“এই শ্রাবণে আষাঢ়ে গপ্পো” বিশেষ সংখ্যায় অমিতা মজুমদার

গুমঘর

সেবারে সে ধরো গিয়ে যে বছর দেশ স্বাধীন হলো তারও বছর দশের আগের কথা। না একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ না,সেই যে ইংরেজদের হাত থেকে ভারত স্বাধীন হলো সেই স্বাধীনতার কথা বলছি। তখন তো ভারত পাকিস্তান,বাংলাদেশ সব মিলিয়ে একটা দেশ ছিল ভারতবর্ষ। জমিদারী প্রথা উঠে গেলেও ছোটখাট কিছু জমিদার তখনও ছিল। কাগজে কলমে না থাকলেই অভ্যাসে ছিল। সেরকমই এক জমিদার ছিল চন্দ্রদ্বীপের ঝাউতলা গ্রামে ।
সেই জমিদার বাড়িতে তখনও বারো মাসে তেরো পার্বণ যেমন ছিল তেমনই ছিল অন্দরমহল বাহির মহলের নানা নিয়ম কানুন।
আমাদের স্কুল থেকে জমিদার বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাওয়ার প্রোগ্রাম করলেন ইতিহাসের গবিন্দ স্যার। আমরা তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ঠিক হলো এক ছুটির দিনে সকাল ৮টার সময় আমরা সবাই রওয়ানা দেব। যেতে যেতে ঘন্টা তিনেক লাগবে। তখন আবার বাস চলত নৌকায় টানা ফেরী পার হয়ে। আমাদের তো মহা আনন্দ। এই প্রথম আমরা বাড়ির লোক ছাড়া একা একা বাসে চড়ে দূরে কোথাও যাচ্ছি। স্যার সবার কাছ থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা নিয়েছেন।পথে নাস্তা করাবেন আবার দুপুরে হোটেলে খাওয়াবেন। বিকেলেও নাস্তা করাবেন হয়তো। স্কুল থেকেও স্যার কিছু টাকা নিয়েছেন বাকী খরচ স্যারের নিজের।
আমরা সবাই পরিষ্কার পোষাক পড়ে সকাল ৮টার আগেই স্কুলে পৌঁছে যাই।
সবাইকে নিয়ে স্যার রওয়ানা দেন। আমাদের স্যার বুঝিয়ে বলেন আমরা যেন পথে কোনোরকম দুষ্টামি না করি।তাহলে স্কুলের সুনাম নষ্ট হবে। যাই হোক পথে নানা ভোগান্তি পার করে আমরা জমিদার বাড়িতে পৌঁছাই। স্যার সবাইকে বলেন দল বেঁধে ঘুরে ঘুরে দেখতে। সবাই খাতা কলম নিয়ে গিয়েছি  তাতে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো নোট করতে বলেছেন স্যার।
বাড়িতে যারা ছিলেন তারা আমাদের ভালোভাবেই ঘুরে ঘুরে দেখতে দিলেন  সবকিছু। এরমধ্যে আমাদের সাথে কোথা থেকে একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে জুটলো। সে বললো এসো আমি তোমাদের সব ঘুরিয়ে দেখাই।আমরা তো মহাখুশী। এ বাড়ির একজন সাথে থাকলে তো আমাদের সুবিধাই হয়।
সে আমাদের নিয়ে গেল মন্দিরের সামনে বললো এটা আমাদের নাটমন্দির।জানো এখানে পূজায় কতো আনন্দ হতো। ওই পাশে ওখানে শিব মন্দির আছে, এখন তেমন কেউ যায়না তাই জংগল হয়ে গেছে।এই যে খোলা জায়গাটা দেখছ এখানে তাবু ফেলে পালাগান হতো।এভাবে ঘুরতে ঘুরতে সে আমাদের অন্দরমহলে নিয়ে গেল।
তার পিছু পিছু আমরা যাচ্ছি, এক একটা ঘরে নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে এটা জমিদারবাবুর প্রথম স্ত্রীর ঘর,এটা ছোট স্ত্রীর ঘর। এটা সেজ গিন্নীর ঘর যে নাকি ছিল খুব সৌখিন। কিন্তু সেজবাবু তাকে ঘরে রেখে কোথায় যেন গিয়ে রাত কাটাত। তার নাকি নাচ গানের নেশা।সব শুনতে শুনতে আমরা একটা সুন্দর ঘরের সামনে এসে দাড়ালাম। সেটার দরজা বন্ধ। মেয়েটা বললো এ ঘরে যাওয়া যাবেনা। আমরা কৌতুহলী হয়ে  জানতে চাইলাম কেন ? মেয়েটা বললো এত প্রশ্ন করোনা তো ।  এভাবে তিনতলা,দোতলার প্রায় সব ঘর ঘুরে নীচের তলায় এলাম। আসতে আসতে একে একে সবাই কখন চলে গেছে টের পাইনি। এখন শুধু আমি আর সেই ফুটফুটে মেয়েটা। মেয়েটা হেসে বলল এবারে একাকী তোমাকে একটা ঘর দেখাই যেটা কেউ  ওরা কেউ দেখেনি,বলে সোজা হাঁটতে শুরু করল। আমিও কেমন পিছু পিছু হাঁটলাম। দেখি একেবারে পশ্চিম দিকের শেষ মাথায় চলে এসেছি ।আমি বললাম কই কোন ঘরতো দেখলামনা। হঠাৎ সামনে সিঁড়ি দেখালো। যেটা ওই দালানেরই ভেতরে নীচে চলে গেছে। আমার একটু কেমন ভয় করতে লাগল। কিন্তু মেয়েটি আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। নীচের দিকে নামছি তো নামছি সিঁড়ি আর ফুরায়না। এখন সামনে তেমন কিছু দেখতেও পাচ্ছিনা।আমি শক্ত হয়ে দাঁড়ালাম ,বললাম আর নীচে যাবনা। চল ফিরে যাই।
হঠাৎ মেয়েটা হেসে উঠল, আর আমার হাত ছেড়ে দিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল ! পেছনে শুনতে পেলাম একটা দরজা বন্ধ হবার শব্দ। আর মেয়েটা বলছে ছোট মা তোমার মনে আছে আমাকে এখানে আটকে রেখেছিলে, আমি তোমার ছেলে মানে আমার ভাইকে একটা চড় দিয়েছিলাম বলে। আমি কত কেঁদেছি তুমি আমাকে খেতেও দাওনি আর বের হতেও দাওনি। বাবা মহাল থেকে ফিরে এসে যখন আমাকে খুঁজছিল তখন তুমি বলেছিলে আমি জলে ডুবে গিয়েছিলাম। বাবাকে জানালে তো আর আমি ফিরে আসবনা তাই তুমি বাবাকে জানাওনি।
আমি কান্না শুরু করলাম , তুমি ভুল করছ আমি তোমার ছোট মা নই,আমি রুমকি। আমরা সেই সুবর্ণপুর গ্রাম থেকে তোমাদের এই জমিদার বাড়ি দেখতে এসেছি। হঠাৎ` অন্ধকারে পা পিছলে নীচের দিকে গড়িয়ে পড়তে থাকলাম—- । আর কিছু মনে নেই । শুনতে পেলাম মা বলছে কিরে রুমকি কি হলো তোর ? খাট ছেড়ে নীচে শুয়ে আছিস কেন ? আবার কি সব বিড়বিড় করছিস ?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।