এই সময়ের লেখায় ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে

এক

রমেশের সঙ্গে প্রতাপের দেখা। প্রতাপ ভাবল আজ একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
আমার টাকাটা কবে দিবি? শালা চিটিংবাজ। মায়ের অসুখ বলে টাকাটা নিলি। পরের মাসেই ফেরত দিবি বললি, এদিকে তিনমাস হয়ে গেল।
রমেশের সঙ্গেই টাকা রেডিই ছিল। এটা সত্যি যে তিনমাস হয়ে গেছে। কিন্তু নানা অসুবিধেয় পড়ে টাকাটা দেয়া হয় নি। এবার সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। দেখা হলেই দিয়ে দেবে। কিন্তু চিটিংবাজ শব্দটায় তার ঘোরতর আপত্তি আছে। নিজের সম্পর্কে তার ধারনা খুব স্পষ্ট। নিজেকে কোনভাবেই সে চিটিংবাজ ভাবতে পারে না। কিন্তু প্রতাপকে একটা শিক্ষা দেয়া দরকার। টাকাটা সে সহজে ফেরত দেবে না ঠিক করল।
টাকা? কীসের টাকা! রমেশ যেন আকাশ থেকে পড়লো। আমি তো কোন টাকা নিই নি তোর কাছ থেকে।
প্রতাপ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সত্যিই তো তার কাছে কোন প্রমাণ নেই। এদিকে রাস্তায় লোক জমতে শুরু করে দিয়েছে। তারা দুভাগ হয়ে গেল। একদল টাকা ফেরত দিতে বলল, অন্য দল টাকা দেবার প্রমাণ দাবী করল।
ঠিক তখনই প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়তে শুরু করল। তেড়ে বৃষ্টি এলো। লোকজন যে যেদিকে পারল ছাউনি খুঁজে দাঁড়িয়ে গেল। রমেশও ছুটল আশ্রয়ের খোঁজে। পেছন পেছন প্রতাপ। একটা টিনের চালার নিচে আশ্রয় নিলো।
বৃষ্টির মধ্যেও দুজনের ঝগড়া থামল না। কিছুক্ষণ পরে চালার লাগোয়া ঘরটা থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে এসে বলল, কাকুরা ঝগড়া করো না। সামনেই আমার ক্লাসের পরীক্ষা। পড়তে পারছি না। ডিস্টার্ব করো না।
দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।
রমেশ বলল, টাকা ফেরত দিতে পারি একটা সর্তে।
কী সর্ত?
তুই আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিস। তোকে ক্ষমা চাইতে হবে।
একথা শুনে প্রতাপ প্রচণ্ড রেগে গেল। যা নয় তাই গালাগালি করল। চেঁচিয়ে নয়। ফিসফিস করে। ব্যাপারটা মিটল না।

দুই

পরদিন সকাল। রামবিলাস গ্রিল লাগানো বারান্দায় বসে দৈনিক হিন্দি কাগজ পড়ছিলেন। এলাকার কাউন্সিলর। ভারত নির্মাণ পার্টির নেতা। এঁটুলির মতো তিন বেলা গায়ে গায়ে লেগে থাকে তার সহকারী শম্ভু সরকার। সামনে চেয়ার আর মোড়াতে নানা সার্টিফিকেটের জন্য বসে আছে পাড়ার লোক। কন্ট্রাক্টের আশায়, পাওনা টাকা উদ্ধারের আশায় বসে আছে ঠিকাদারেরা। কেউ কোন কথা বলছে না। মাটির ভাঁড়ে করে চা দিয়ে গেছে কেটলি হাতে বিশু। সামনেই দোকান তার। কেউ কোন কথা বলছে না কারণ শম্ভু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সবাইকে চুপ করে থাকতে বলেছে। কাগজ পড়া শেষ হলেই কাজ শুরু হবে। রামবিলাস ভোর থেকেই পাবলিক মিট করেন। বেলা আটটা থেকে আটটা কুড়ি তার বরাদ্দ থাকে খবরের কাগজ পড়ার জন্য। একদম রুটিন। কোন ব্যত্যয় নেই।
উদ্ভ্রান্তের মতো প্রতাপ ঢুকল। রসিদ ছাড়া কি টাকা ফেরত পাবো না? আমাকে কি বিনা অপরাধে ক্ষমা চাইতে হবে? লোকের বিপদের সময়ে হেল্প করার এই পরিণতি?
রামবিলাস তখন খবরের মধ্যে ডুবে ছিলেন। সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে এলাকার উন্নয়নের রসায়ন আত্মস্থ করার চেষ্টা করছিলেন। প্রতাপকে অনেক দিন ধরেই চেনেন। স্নেহ করেন। পোলিং এজেন্ট হয়ে প্রতাপ ভোটের বুথে বসে। এছাড়াও পার্টির কাজে ডাকলেই তাকে পাওয়া যায়। কিন্তু অকস্মাৎ ওর এজাতীয় কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে শম্ভুর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
প্রতাপ শম্ভুকে সংক্ষেপে ঘটনাগুলো বলল।
দাদা, এটা মনে হচ্ছে ভারত বাঁচাও দলের চক্রান্ত। শম্ভু বলে।
এখানে বলে রাখা ভালো যে এলাকায় আর রাজ্যে রামবিলাস আর শম্ভুর ভারত নির্মাণ পার্টির একতরফা প্রতিপত্তি ছিল এতদিন। এবার সেখানে থাবা বসিয়েছে ভারত বাঁচাও দল। একে একে এলাকা দখল চলছে। আশেপাশের এলাকা থেকে বাজি পটকা ফাটার মতো বোমা পেটো পড়ার আওয়াজও পাওয়া যায় ইদানীং।

তিন

উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। এস-পি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে জাতে মরাঠী। অবশ্য মরাঠী বা হিন্দিতে একে উচ্চারণ করা হয় উদেসপুন্দিত ভাবে। ভাবে তো একটি মরাঠী পদবি, যেমন আচার্য বিনোবা ভাবে। কিন্তু বিনোবা ভাবে না বলে ভাবেন বললেও হয়। কিন্তু কী ভাবতেন এই বিনোবা? তিনি ভাবতেন পৃথিবীর কথা। তার স্লোগান ছিল ‘জয় জগত’, অর্থাৎ জগতের জয় হোক। মরাঠা নয়, ভারত নয় – জগত। এই রকম উদারতা ছিল বিনোবার। গান্ধীজির অনুগামী, সর্বোদয় আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, বিনোবাজি নিজের পড়াশুনোর সার্টিফিকেট ইত্যাদি পুড়িয়ে ফেলে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পাঁচ বছর জেল খেটেছিলেন, ব্রিটিশ শাসনকালে।
উদেসপুন্দিতের এই নামটা দিয়েছিলেন তার বাবা। তিনিও একজন ভাবে এবং ভাবেন। একটু আধটু বাংলা শেখার চেষ্টা করছিলেন রবীন্দ্রনাথে গীতাঞ্জলী পড়ার উদ্দেশ্যে। সেই চেষ্টার ফলেই কোথাও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কথাটি পেয়েছিলেন। তাঁর নিজের পদবীও ভাবে। সাত মেয়ের পর এক ছেলে। বস্তুত এই ছেলের আশাতেই তাঁর স্ত্রী পরপর সাতটি মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ফসল পুত্রসন্তান প্রসব করলেন তিনি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কথাটির তাই একটি হালকা ছায়া আছে দম্পতির পুত্রার্থে এই অদম্য অধ্যবসায়ের।
উদেসপুন্দিত তাই একজন সৎ এবং একবগগা পুলিশ অফিসার। অনেক চেষ্টা করছেন এলাকার গণ্ডগোল থামানোর। তাঁর নিজের প্রদেশ শান্তিপূর্ণ। লোকে পুলিশকে ভয় পায়। এমনটি একটা লাঠি হাতে হাবিলদার যদি চেঁচিয়ে বলে কওউন হ্যায়, তো চোরডাকাতের কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলে। পাড়ার যুবকেরা গুরুজনদের শ্রদ্ধা করে। ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্যাডারে চাকরি হবার ফলে মনে খুব আনন্দ হয়েছিল প্রথম দিকটায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের বাংলা, নেতাজির বাংলা, বিবেকানন্দের বাংলা। সেই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হবেন। তাঁর জন্ম বেড়ে ওঠা সবই মহারাষ্ট্রের এক রুখাশুখা এলাকায়। সজল, শস্যশ্যামল বাংলায় আসার সুযোগ পেয়ে উদেসপুন্দিত তাই যথেষ্ট আনন্দিত হয়েছিলেন।

চার

রামবিলাস কিন্তু প্রতাপের ঝামেলাটা মেটাবার জন্য এস-পি উদেসপুন্দিতকেই ফোন করলেন। সচরাচর ওসিকেই বলেন এজাতীয় ব্যাপার। কিন্তু কয়েকদিন আগেই উদেসপুন্দিতের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপচারিতা হয়েছে কোন এক অনুষ্ঠানে। এসপি নিজেই বলেছেন, যে কোন সমস্যায় তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে। আসলে এসপির অফিস, বাংলো সবই রামবিলাসের এলাকায়।
হেলো হেলো। হামি রামবিলাস বলতেসি।
হা হা বোলেন বোলেন। কী কেস? রেপ্প না মার্ডার।
হামার একটা চেলা আছে। উয়ার কিছু টাকা একজন ধার লিয়েছিল। তাকে একটু বলে টাকাটা আদায় করে দিতে হবে। হামিই পারতাম। কিন্তু আজকাল পবলিক অন্যরকম হয়ে গেছে। ভাববে হামারও ভাগ আছে। তোলাবাজ নাম হইয়ে যাবে।
সে তো হামাদের পুলিশদেরও একই অবস্থা, এ চাকরিতে আর সে চার্ম নাই। যাক সে কথা। হামার উপর ছেড়ে দিন। শুনি তো আগে বেপারটা।

পাঁচ

তিন দিন পরের কথা। রিনরিন বেজে উঠল রমেশের ফোন।
হামি এস-পি উদেসপুন্দিত বলছি। আপনি রমেশবাবু তো? হামার অফিসে একবার আসেন কোস্টো করে।
কে আপনি? পুলিশ? ক্যানো যাবো, আমি কি করেছি?
আরে আসেন তো একবার। কোন ভয় নাই। মালাই চা খাওয়াবো। বড়িয়া। আর একটু গপসপ করবো। হামাদের এটা পাবলিক রিলেশনের পার্ট আছে। দেখেন না, থানার থেকে ফুটবল খেলা করে, পাড়ার ছেলেদের নিয়ে। সেইরকম আর কী! আপনি পাড়ার মাস্তান আছেন, আমাদের কাছে খবর আছে। আপনাকে খুব দরকার আমাদের।
না মানে!
ভালভাবে বলছি চলে আসেন। নয়ত কোতোয়ালিতে ভরে দিলে সেটা ভালো হবে? ওসিকে বলবো নাকি?
হিসেব পরিষ্কার করে নিলো রমেশ। রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে। বলল, ঠিক আছে আমি এখুনি আসছি।
আসেন আসেন, আমি চায়ের অর্ডার দিয়ে দেব। আমাদের কাজটাই এমন। আপনি ভদ্রলোক মাস্তান। দুটো খারাপ কথা বললাম। মনে কুছু লিবেন নাই। গড ব্লেস ইউ। দুই ঘণ্টার মধ্যে চলে আসেন।

ছয়

ঠিক তক্ষুনি রিনরিন বেজে উঠল প্রতাপের ফোন।
হামি এস-পি উদেসপুন্দিত বলছি। আপনি প্রতাপবাবু তো? হামার অফিসে একবার আসেন কোস্টো করে।
কে আপনি? পুলিশ? ক্যানো যাবো, আমি কী করেছি?
আরে আসেন তো একবার। কোন ভয় নাই। মালাই চা খাওয়াবো। বড়িয়া। আর একটু গপসপ করবো। আমাদের এটা পাবলিক রিলেশনের পার্ট আছে। দেখেন না, থানার থেকে ফুটবল খেলা করে, পাড়ার ছেলেদের নিয়ে। সেইরকম আর কী! আপনি পাড়ার মাস্তান আছেন, আমাদের কাছে খবর আছে। আপনাকে খুব দরকার আমাদের। আসলে একটা কমপ্লেইন আছে। রামবিলাসবাবুর রিকোয়েস্ট, আপনার টাকা চোট হয়ে গেছিল না? সেই ব্যাপারে আর কি!
প্রতাপ একটু থতমত খেলো, বলল, সে তো ভালো কথা। কিন্তু সেজন্য থানায় যেতে হবে কেন। ছেড়ে দিন মাইরি, টাকার ফেরত দরকার নেই। বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা আর পুলিশ ছুঁলে ছত্তিরিস।
আপনি তো আচ্ছা বুরবক আদমি আছেন। আমি এস-পি বলছি আর আপনি ভয় খাচ্ছেন! আসেন আসেন, আমি চায়ের অর্ডার দিয়ে দেব। আমাদের কাজটাই এমন। আপনি ভদ্রলোক মাস্তান। দুটো খারাপ কথা বললাম। মনে কুছু লিবেন নাই। গড ব্লেস ইউ। দুই ঘণ্টার মধ্যে চলে আসেন।

সাত

দু’ঘণ্টা বাদে রমেশ আর প্রতাপ দুজনেই থানায় এসে হাজির। কিন্তু ইতিমধ্যে অবস্থা দেখে চোখ চড়কগাছ। উদেসপুন্দিত ঘেরাও। দুটো রাজনৈতিক দল ভারত নির্মাণ আর ভারত বাঁচাও দুদিক থেকে এসে এস-পি অফিসের সামনের রাস্তা জ্যাম করে আছে। খুবই গরম পরিস্থিতি। একটু দূরের বেপাড়ার ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা। সব মারকুটে মোটা মোটা গুণ্ডা আর সরু সরু মাস্তানের ভিড়, একবার গণ্ডগোল লাগলে যে কটা ভালো লোক আছে তাদের সাধ্যি নেই যে বাধা দেবে। মার খেয়ে মরেই যেতে হবে। ভিড়ের মধ্যে রামবিলাস, শম্ভু আর বিশুকেও দেখা যাচ্ছে। ওই ঝুট ঝামেলার মধ্যেও বিশু কেটলি করে চা বিক্রি করে যাচ্ছে।
রমেশ আর প্রতাপ দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল। চল কেটে পড়ি, অন্য কোথাও গিয়ে বসি।

আট

ঠিক তখনই প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়তে শুরু করল। তেড়ে বৃষ্টি এলো। লোকজন যে যেদিকে পারল ছাউনি খুঁজে দাঁড়িয়ে গেল। রমেশও ছুটল আশ্রয়ের খোঁজে। পেছন পেছন প্রতাপ। একটা টিনের চালার নিচে আশ্রয় নিলো।
বৃষ্টির মধ্যে দুজনের আর ঝগড়া বাধল না। রমেশ মুচকি হেসে বলল। এই নে তোর টাকা। আর ঝামেলা করে দরকার নেই। পুলিশ খবর নিলে বলে দিস, ঝামেলা মিটে গিয়েছে। প্রতাপও হেসে বলল, ঠিক বলেছিস। মনে করিস না কিছু। ভুল বোঝাবুঝি হয়েই থাকে।
প্রতাপ আর রমেশ কেউই থামল না। প্রবল চিৎকার করে গল্পগুজব আর হাসি ঠাট্টা করতে লাগল। ওদের খেয়াল ছিল না। প্রথমবারের ঝগড়াটা হয়েছিল ঠিক এখানেই।
কিছুক্ষণ পরে চালার লাগোয়া ঘরটা থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে এসে বলল, কাকুরা চেঁচামেচি করো না। সামনেই আমার ক্লাসের পরীক্ষা। পড়তে পারছি না। ডিস্টার্ব করো না।
দুজনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।
রমেশ বলল, আমার সর্তটা মানলি না।
কী সর্ত?
তুই আমার সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিস। তোকে ক্ষমা চাইতে হবে বলেছিলাম।
একথা শুনে প্রতাপ প্রচণ্ড জোরে আবার হেসে উঠল। বলল, এখন তো ব্যাপারটা মিটেই গেছে।

শেষ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।