• Uncategorized
  • 0

এই সময়ের লেখায় যশোবন্ত্‌ বসু

ফেলছি তোমার বন্ধুতা

কথাটা দিদিমার মুখে শুনেছিলুম, “ পয়সা নেবে গুনে,বন্ধু নেবে চিনে ”। বন্ধু সম্পর্কে এমন অজস্র কথা চালু আছে। তার মধ্যে আরেকটি হল, মানুষের বন্ধুলাভ যা হবার ঐ ছোটবেলা পর্বে বা স্কুল জীবনেই হয়ে যায়। জীবনের পরবর্তী ধাপে যাদের সঙ্গে আলাপ বা ঘনিষ্ঠতা তারা সেই অর্থে ‘ বন্ধু ’ ঠিক নয়, পরিচিত বা ভীষণ পরিচিত জন মাত্র। সেই অর্থে মানে কোন্‌ অর্থে ? ইস্কুলের সংস্কৃত ক্লাসে পড়া সেই শ্লোকটির অর্থে ? উৎসবে,ব্যসনে,রাজদ্বারে,শ্মশানে,দুর্ভিক্ষে এবং রাষ্ট্রবিপ্লবে যে পাশে অটুট অবিচ্ছেদ্য থেকে যায়, সেই প্রকৃত বন্ধু ? শ্লোকটির সারবত্তা আছে, সন্দেহ নেই।
তবে ছোটবেলা বা ইস্কুলবেলা পেরিয়ে এসে আর কারও সঙ্গে সেভাবে বন্ধুত্ব হয় না এমন সরলীকরণেও আমি বিশ্বাসী নই। আমার নিজেরই এমন একাধিক বন্ধু আছে যারা কৈশোরোত্তর বা প্রাক্‌ যৌবন পর্বের প্রাপ্তি। অবশ্য ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে মনের বাঁধন যে অনেকটাই বেশি সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
ফেসবুকের ‘ ফ্রেন্ডশিপ ’ নিয়ে খানিক বকবকানির জন্য কি-প্যাড উসখুস করছিল, সচেতন ভাবেই তা এসকেপ করে গেলুম। বন্ধুত্ব অত সস্তা ও সহজ জিনিস নয়।
দুটি ছেলে একই স্কুলে পড়ত। ক্রিকেটখেলায় দুজনেরই উৎসাহ ছিল প্রবল। প্রতিভা ছিল বলে খেলতও দারুণ। বড় হয়ে ক্রিকেটখেলাটাকেই তারা পেশা করে নেয়। নামডাক, যশ,খ্যাতি,প্রতিপত্তি হতে থাকে দুজনেরই। একজন নিষ্ঠা, কঠোর শৃঙ্খলা, সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে সাফল্যের প্রায় সবকটা চুড়োই ছুঁয়ে ফেলে। পৃথিবীজোড়া সুনাম ও জনপ্রিয়তা পায়। আরেকজন হঠাৎ-পাওয়া অর্থ ও গ্ল্যামারের হড়পা বানে নোঙর ঠিক রাখতে না পেরে লাগামছাড়া বিলাসবৈভব ও শৃঙ্খলাহীনতায় ভেসে যায়। কেরিয়ার গ্রাফ চড়চড় করে পড়তে থাকে। বিখ্যাত হতে গিয়ে বিস্মৃতির গর্তে ঢুকে যায় ছেলেটি। বন্ধুর সাফল্যে তখন তার শুধুই ঈর্ষা আর হতাশা।
আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তুমি নাম করবে তা কে জানত
কত মেরেছি বাউন্ডারি কোণে কোণে
তখন বল কুড়িয়ে কে আনত
আজকে তুমি রাজার রাজা হলে
আর আমাকে সবাই গেছে ভুলে
আমারই দোষ আমার মতিচ্ছন্ন
নইলে আজ গল্প হতো অন্য …
আলোর বন্ধুটির নাম সচিন তেন্ডুলকর, অন্ধকারের বন্ধুটি বিনোদ কাম্বলি।
আরেকটি গল্প এক শান্ত মফস্‌সলের। দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। একই পাড়ার,একই স্কুলের, একই প্রাইভেট টিউশনের। এক সঙ্গে যাওয়া আসা। একজন গল্প লেখে, অন্য জন শোনে। যে-কোনও নতুন লেখা হলেই সবার আগে প্রাণের বন্ধুকে শোনানো চাই। সেই তার প্রথম পাঠক, সমালোচকও। তার মতামত ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুর গল্প শুনতে গিয়ে কত কত বিকেলের খেলা, ঘুড়ি-ওড়ানো যে সেই প্রাণের বন্ধুটিকে স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে, হিসেব নেই। কোনও গল্প বেশ জমে ওঠে, কোনওটা আবার তেমন দাঁড়ায় না। তবু সেইসব নিভৃত আলোচনায় সৃষ্টির আনন্দ,উত্তেজনা,শিহরন ভাগ করে জীবন এগিয়ে যায়।
গল্পলেখক বন্ধুটির পরবর্তী অধ্যায় গুলি বৃহত্তর পাঠকসমাজ ও জনপ্রিয়তায় ছড়িয়ে পড়ার গল্প। ফেসবুক,সাহিত্য সম্মেলন,বইমেলা,স্বীকৃতি,প্রশংসা ও ভক্তসমাগমের গল্প। তবুও কোথাও যেন একটা কাঁটার খচখচানি। সেই প্রথম পাঠক বন্ধুটি এক লাইনও সাহিত্য সৃষ্টি না করেও তার সমঝদারিত্ব দিয়ে,তার স্বভাব ও ব্যক্তিত্বের গুণে বন্ধুমহলে যেন একটু বেশিই জনপ্রিয়। একটা হিল্‌হিলে হিংসা ভেতরে যেন পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওঠে। এত অনুরাগী ও স্তাবক পরিবৃত হয়েও তৃপ্তির জিভে খানিকটা তেতো স্বাদ লেগে থাকে।
সাহিত্য সম্মেলনের মঞ্চে যখন সংবর্ধনার পরে বক্তৃতা ও আত্মকথন,লেখকজীবনের অনুপ্রেরণা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে অন্য অনেক নাম উচ্চারিত হলেও সেই ছোটবেলার বন্ধুটির নাম একবারও জিভে আসে না।
কাজেই বন্ধুত্বের গতিপ্রকৃতি নিয়ে শেষ কথাটি বলে ফেলা অত সহজ কম্মো নয়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।