যখন ছোট ছিলাম পুকুরে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম।আমার জ্যাঠামশাই খুব ভালো মাছের চার বা টোপ বানাতে পারতেন।পারুটি,কুরকুট,মদের মিয়া,ময়দা রসুন প্রভৃতি উপাদান দিয়ে পরিপাটি করে মাছ ধরার টোপ বা চার বানানো হয়।আর মাছ ধরার আগেই সেই মাছের লোভনীয় চার পুকুরের নির্দিষ্ট ঘাটে ফেলে দিতেন।কিছুক্ষণের মধ্যে মাছে ছয়লাপ হয়ে যেত।পুকুরের গভীর জলের মাছেরাও চারের লোভনীয় গন্ধ স্বাদে জলেরতল থেকে ভুড়ভুড়ি কাটত।পুকুরের জলে বুদবুদ উঠত।মাছে গান্দি লাগত।ছিপ ফেললেই সঙ্গে সঙ্গে সাদা ফাদনাটা উঠা-নামা করতে করতে টপ টপ করে ডরসহ ছিপটাকে টেনে নিয়ে যেত।আর টোপের ভিতরে সাংঘাতিক কাঁটাটি গিলে ফেললেই কেল্লা ফতে।আর যে যত বড় দক্ষ মেছেল সে খেলিয়ে খেলিয়ে মাছ ঘাটে তুলতেন।আর আমরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম।জলের মাছ পাড়ে উঠলে গামছা জড়িয়ে ধরে যথা স্থানে রান্না ঘরে পৌঁছে দিতাম।একবার যাদের মাছ ধরার নেশা চেপে বসত সেই নেশা সহজে তাকে ছাড়ত না।এমন অভিজ্ঞতা অনেকের আছে।এই ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কারণ এই সময়ে ঘটে যাওয়া দেশজুড়ে নাগরিক পঞ্জিকা নিয়ে দেশজুড়ে যে চাপান উতর চলছে সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে।আর এমন ঘোলাজলে অভ্যাস মতো মাছ ধরতে নেমে পড়েছে শাসক বিরোধী শিবির।মনে হচ্ছে ভোট রাজনীতির লোভনীয় সময় উপযোগী চারা পড়েছে।শাসক-বিরোধী রাজনীতির কারবারীরা কিলবিল করছে মাছের মতো।এই ঘোলাজলে যে রাজনীতি পারদর্শিতা দেখাতে পারবে তাদের সাফল্য অনিবার্য।ভোট ব্যাঙ্কের এমন সুবর্ণ সুযোগ কে হাত ছাড়া করে।
পশ্চিমবঙ্গের মতো গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত রাজ্যের সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর।প্রতিবেশী রাজ্যের ও দেশের প্রভাব এ রাজ্যে ভীষণ ভাবে পড়ে।ভোট রাজনীতির এমন লোভনীয় ইস্যু শাসক বিরোধীরা লুফে নেই।
আর ডিজিটাল ইণ্ডিয়া ছুটবে সামনের দিকে।পূর্ব পুরুষের ঠিকুজি খুঁজতে মানুষের দল হন্যে হয়ে ছুটছে।আর এর মাঝখানে ঘটে যাবে রাজনীতির কারবারীদের রাজনৈতিক ফায়দা তোলবার কুস্তি কসরত।এই নাগরিকপঞ্জি হল নাকি দেশে থাকবার তালিকা।পাসপোর্ট আর ভোটার তালিকায় নাম থাকলেই ভারতীয় নাগরিক হতে পারা যাবে।কিন্তু এখন সে গুড়ে বালি। নৈব নৈ ব চ।সম্প্রতি আসামের ঘটে যাওয়া ঘতনার বিভিন্ন সংবাদ আমাদের আঁতকে দেই বইকি।
উল্লেখ্য সত্তরের দশকে আসাম আন্দোলনের পর ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তি হয়।প্রয়াত রাজীব গান্ধী যার মুল রূপকার।আজকের অনেক রাজনীতিবিদ তখন সংসদ ছিলেন।বিভিন্ন সংবাদসুত্রে জানা যায় চুক্তির ২০ বছর পার হওয়ার পর ২০০৫ সালের ৫মে ‘আসু’র সঙ্গে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ত্রিপাক্ষিক বৈঠকেই প্রথম বিদেশি সমস্যা নির্মূল করতে নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রসঙ্গ উঠে আসে।১৯৭১ সালে ২৫মার্চের আগে যারা আসামে এসেছেন তারা আসামের বাসিন্দা হবে।১৯৫১ সালের একমাত্র আসাম রাজ্যে নাগরিকপঞ্জি নবায়নের কথা বলা হয়।ব্রহ্মপুত্র নদে অনেক জল গড়িয়ে গিয়েছে।যমুনার তীরে সরকারের বদল ঘটেছে।শীর্ষ আদালত আইনি প্রক্রিয়ার পর এন আর সি তৈরির নির্দেশ দিয়েছে।
নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব বিধি সংশোধন করা হয়েছে।জানা যায় ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৬(এ) নং দফা এবং ২০০৩ সালের সংশোধিত নাগরিকত্ব বিধি মেনে শুরু হয় ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জি নবায়ন।এই নাগরিকপঞ্জি নবায়নের কাজের শুরু হতেই হাহাকার পড়ছে সর্বত্র।বিদেশি সন্দেহে নাগরিকত্ব নির্ধারণের এই উদ্যোগ বিপাকে পড়েছে অনেকে।বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা থাকছে।আর রাজনৈতিক দলগুলির দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যে ঘৃতাহুতি হচ্ছে।
স্বাধীনতার ৭১ বছর পরও নাগরিকতার সলুক সন্ধান করতে কোটি কোটি টাকা টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।যাদের নাম খসড়ায় থাকবে না তাদের এখন আঁতুড় খুঁজতে হয়রানি হতে হবে তাতে সন্দেহ নেই।আসামে এমনটাই ঘটেছে।
গরীব-গুর্বরা এর শিকার স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে।আর ধর্ম-জাতপাতের তাসটি সুকৌশলে কিছু রাজনৈতিক দল খেলতে থাকবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশ আসামের মরিগাও জেলার বাসিন্দা আব্দুল হামিদ নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রায় নিঃস্ব।জানা গেছে ১৯৮৫ সালে আসাম আন্দোলনের সময় বাংলাদেশি সন্দেহে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়ে ছিলেন।তার মধ্যে হামিদের পরিবারের ছয় জনের প্রাণ যায়।পরবর্তীকালে হামিদের নামে ডি ভোটারের নোটিশ আসে।আর তাই প্রমাণ করতে হামিদ পরিবার জেরবার।যদিও ভারতীয় হয়ার উপযুক্ত তথ্য থাকায় ফরেনার্স-ট্রাইব্যনাল তাকে ভারতীয় বলে রায় দিয়েছেন।কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য হামিদের পরিবারের নাম ছিল না এন আর সি খসড়া তালিকায়।শুধু হামিদ নয় এমনও হাজারো উদাহরণ এখন আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের চর্চার বিষয়।এর শিকার বেশি বেশি ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘুরা।বিবাহ সংক্রান্ত শংসাপত্র না থাকায় বহু মহিলার নাম খসড়ায় ছিল না ।পঞ্চায়েতের নথির মান্যতা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।বহু নথি ভিন রাজ্য থেকে ফিরে আসেনি।হয়তো খসড়ার অঙ্কের হিসাব কিছুটা নিম্নগামী হবে।সংবাদে প্রকাশ দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন,সব কিছু বস্তুনিষ্ঠ ভাবে চলছে।জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থে প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক চিহ্নিত করার কথা শুনিয়েছেন।কোনো রকম বৈষম্য হবে না এমন আশ্বাস দিয়েছেন।
মনে হচ্ছে আসামকে কেন্দ্র করে দেশের এই সময়ের একটি ভয়ঙ্কর সমস্যা।আজকাল সর্বত্র আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে।আর আমরা দেশের জনগণের কাঁড়ি কাঁড়ি ট্যাক্সের টাকায় কখনও আধার কখনও নাগরিকপঞ্জির নামে সাধারণ মানুষদের হতে হয় হয়রানির শিকার।লোকশিল্পী রবি বাগদীর গানের কয়েকটা কলি মনে পড়ে যাচ্ছে,হাড়রে জল ঢুকছে ভুলুকে দিই তালি।
ভারতের রয়েছে বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চল।উত্তর সীমান্তে চীন তিব্বত,ভুটান নেপাল।পশ্চিমে থর-মরু অঞ্চল আর পাঞ্জাব সমভূমির উপর প্রসারিত পাকিস্থান রাষ্ট্র।উত্তরপূর্বে মায়ানামার রাষ্ট্র,গঙ্গা সমভূমির জলবিভাজিকায় বাংলাদেশ সীমান্ত।ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের মোট দৈর্ঘ্য ৪,০৯৬.৭০ কিলোমিটার (২,৫৪৬ মাইল)এত কথা বলার কারণ এসব সীমান্তদুয়ারগুলি কী সত্যি নিশ্ছিদ্র? যদিও পুরোপুরি তা সম্ভব নয় এ কথাও মানি।কোনো কোনো সীমান্ত জঙ্গী কার্যকলাপের সদর দরজা।কিংবা ভোট ব্যাঙ্ক রাজনীতির মুক্তাঞ্চল।অবাধে সীমান্ত পাহারাকে বুড় আঙুল দেখিয়ে সীমান্ত রাজ্য প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন ঘটনা আকছার ঘটছে।ঘটছে চোরাকারবারীদের মধ্যে আভ্যন্তরীণ গণ্ডগোল।রয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও কিছু রাজনৈতিক নেতাদের অশুভ আঁতাত।এমন সংবাদ রোজকার ঘটনা।বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকা।কারণে অকারণে সীমান্ত টপকাচ্ছে বহু মানুষ।রাজনৈতিক,সামাজিক অর্থনৈতিক কারণ তো এর মূলে আছেই।কিন্তু ভোট রাজনীতির সঙ্কীর্ণ স্বার্থে সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশকারীদের পুষ্ট করার কাজটি রাজনৈতিক নেতাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।তাদের অতিথি প্রীতি কেবলই রাজনৈতিক মৌরসিপাট্টাকে উৎসাহিত করছে।একই ডাণ্ডায় ঝাণ্ডার রং শুধু বদলে যাচ্ছে।এরকম জ্বলন্ত ইস্যুতে রাজনৈতিক কারবারিদের পোয়াবারো সন্দেহ নেই।দেশ ভক্তির গদ গদ রাজনৈতিক দলগুলিও এই ঘোলা জলে মাছ ধরতে ছিপ ফেলে বসেছে।জাতপাত-ধর্ম-বর্ণের রাজনীতি তারা নিজেদের মতো পরিবেশন করছে।উদ্দেশ্য পরিষ্কার ভোটের বৈতরণী পার হওয়া।চুক্তি যুক্তি এসব থাকতেই পারে।থাকতে পারে সেই চুক্তিকে লাগু করে দেশের মূল সমস্যার সমধানে ব্রতি হওয়া।দেশে নাগরিকপঞ্জি হোক আপত্তি নেই তাতে।আপত্তি এখানেই সুবিধাবাদী রাজনীতির আর ভোল পালটানোর রাজনীতির বিরুদ্ধে।শাসক বিরোধী সমন্বয় আর দেশের নাগরিকদের প্রতি আন্তরিকতায় আসল কথা।কিন্তু আমরা সন্দিহান সেখানেই।অভাব রাজনৈতিক সদ্দিছারও।অন্ন বস্ত্র আর বাস্থানের আজও আমরা ব্যবস্থা করতে পারি না।সম্প্রতি
সংবাদ পত্রে দিল্লীর তিন শিশু কন্যার অনাহারে মৃত্যুর করুণ কাহিনি পড়ে কার না চোখে জল আসবে।সংবাদে প্রকাশ মেদনীপুরের বাসিন্দা পেশায় রিক্সা চালকের তিন কন্যা সন্তানের অনাহারের মৃত্যু হয়েছে।বন্ধুর কাছে ধার নিয়ে দিল্লীতে রিক্সা কিনে চালাত মঙ্গল।সেখানেই বিয়ে করে ঝুপড়ি বাসি হয়েছিল কিন্তু সম্প্রতি তাঁর সাধের রিক্সা চুরি হয়ে যায়।ফলত তিন শিশু কন্যার পিতা মঙ্গল কাজের সন্ধানে সপ্তাহখানেক আগেই অন্যত্র চলে যায়।আর ফেরেনি মঙ্গল।ভিখেরি দশা হয় তার স্ত্রী কন্যার।পরবর্তী সময়ে তিন শিশু কন্যার মৃত্যু ঘটে।সরকারি হাসপাতাল সুত্রে খবর মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণ অনাহার।হাসপাতালে নিয়ে আসার ১২ থেকে ১৮ আগেই মৃত্যু হয়।দুইবার ময়না তদন্ত করে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন শিশুগুলির পাকস্থলীতে খাবারের কোন অংশ পাওয়া যায়নি।চিকিৎসকরা বিস্ময়ের সঙ্গে বলেছেন ১৫ বছর কর্মজীবনে নাকি এমন ঘটনা তারা দেখেননি।এমন মর্মস্পর্শী ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেই আমাদের স্বাধীন দেশের কঙ্কালসার শরীরটা।সারা দেশজুড়ে হাজারও মানুষ ফুটপাতে গাড়ি-বারন্দায় প্ল্যাটফর্মে রাত কাটায়।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় হাত বদলায় শরীর।রঙিন রাত বিক্রি হয় রাতের গভীরে।নারী হয় পন্য সাবান সুন্দরীর বিজ্ঞাপনে।কালাহাণ্ডির কালো হাঁড়ির জল অন্নের অন্বেষণে খোঁজে গাছের শিকড়।ক্ষুধার জ্বালায় দেশের তলপেটে জ্বলে আগুন।চোখের নোনা কান্নার নোনা জল বাস্প হয়ে ওড়ে যায় সুদূর আকাশে।একটা ভারত রাত জাগে উলঙ্গ সত্য বুকে চেপে পথে ঘাটে উলঙ্গ মাঠে তখন আর একটা ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রাচুর্যের প্রহেলিকায় গা-ভাসায়।উন্নয়নের মোহনীয় বিজ্ঞাপনে তবুও মুখ ঢেকে যায়।স্বাধীনতার ৭৩ বৎসর পরও নাগরিক পঞ্জিকার তালিকায় কালো অক্ষরে নাম তুলতে আঁতুড় খুঁজতে হন্যে হতে হয় নিজভূমে।এযেন এক যুগ অন্ধকারে ঠিকুজি হাতড়ে বেড়ান।ভুপেন হাজারিকার সঙ্গে কী গলা মিলিয়ে বলতে পারি না সেই বিখ্যাত মানবতার গানটি মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য/ একটু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না ও বন্ধু …’