• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ১২)

কফি পাহাড়ের রাজা

প্রথম পর্ব:

১২)

বাইরের আবহাওয়া বদলাচ্ছে ধীরে ধীরে। রোদ রোদ আলো উঠেছে একটু। বৃষ্টি প্রায় থেমে এসেছে। ঘরের গুমোট ভাবটাও যেন কেটে যাচ্ছে এবার। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসল বিদ্যা। নাহ! এভাবে স্মৃতি নিয়ে জাবর কাটা তার ধাতে সয় না। বৃষ্টির সাময়িক বিশ্রামে বরং বাগানটা একটু সাফাই করিয়ে রাখতে হবে। মুরুগানের দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিল, ‘কাল থেকে দুটো লোক লাগাব বাগানে। তুমি দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখেশুনে পরিষ্কার করিয়ে নিও। আমি উঠোনের দিকটা দেখব’। মুরুগান ঘাড় নেড়ে সায় দিল। সেও উঠল এবার। একবার বরং এই সুযোগে একটু টহল দিয়ে আসা যাক রাস্তায়। কফিখেতের অবস্থাও দেখে নিতে হবে একটু। একটু ঘুরেই বেশ মনে ফুর্তি এসে গেল মুরুগানের। এই বৃষ্টিভেজা চকচকে পথঘাট, চারিদিকের সদ্যস্নাত চকচকে সবুজ রঙ ওর মনে যৌবনের রেশ বুলিয়ে দিল খানিক। হেঁড়ে গলায় গান ধরল ও যেতে যেতে। কফিবাগান ঘেরা এই রাস্তায় এখন লোকজন নেই বললেই চলে। দুচারঘর ঝুপড়ির বাসিন্দা মুরুগানের গান শুনে হেসে হেসে ওর সঙ্গে কথা বলতে বেরিয়ে এলো। এখন কাজকর্মের ব্যস্ততা নেই এখানে। কফিখেতে ঝোপঝাড় আর এলাচের গাছগুলো ভিজে ঝুপ্পুস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা রোদে গা শুকোচ্ছে ওরা। মুরুগান দুচারজনের সঙ্গে বকবক করল যেতে যেতে। আজ তার মনে বেশ আহ্লাদ এসেছে তার এলাচপ্রিয়ার জন্য। সেদিকেই গন্তব্য তার। কতক্ষণে দেখা পাবে তার…বিরহ আর প্রেম মিলেমিশে মুরুগানের মন উচাটন হয়ে আছে। অবশেষে এলাচ সখির কাছে এসে মনটা আরও উৎফুল্ল হল। খেতের মধ্যে ঢুকে পড়ল ও। প্রিয় গাছটির কাছে গিয়ে ভেজা এলাচপাতাগুলো থেকে জল মুছে দিল রুমাল বের করে। যেন টাওয়েল দিয়ে প্রিয়ার গা মুছিয়ে দিচ্ছে ও। এই দৃশ্য দেখার সাক্ষী কেউ নেই আপাতত। স্থানীয়রা এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন কেউ ওদের দেখলে বিস্মিত হত নিশ্চিত। এরপর গাছটাকে পরম আশ্লেষে জড়িয়ে ধরল মুরুগান। পাতার ঝারে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিল প্রিয়ার। তারপর অনেকক্ষণ ধরে চলল ওদের কথোপকথন। ওদের কথা কেবল ওরা বোঝে। ওদের কথা কেবল ওদের জন্যই।
   বিদ্যা ঘরের কাজ সেরে নিয়েছে অনেকক্ষণ। লোকটা যে সেই বেরোল, এখনও ফিরল না! আচ্ছা ক্ষ্যাপা নিয়ে তার ঘরসংসার। এইরকম মনে মনে ভেবেই হাসি পেল বিদ্যার। এক চুটকি হাসি ওর ঠোঁটের কোণায় এসেও গেল। ঘরসংসার! হাহাহাহা…নাহ! বিদ্যার কোন ঘরসংসার আর নেই। কুপিল্লা মরে যাওয়ার পরে সে আর কোনো ঘরে নিজেকে বাঁধতে চায়নি। তবুও এই এখানে, মুরুগানের বাড়িটাও তার নিজের শাসনে, দেখভালে চলে। এই সংসারের হালও ওর হাতে। তবুও এটা মুরুগানের ঘরবাড়ি। অন্যের সংসার। সে যেন মাঝেমাঝে এসে কেয়ারটেকারের মতো সবকিছু সামলে দিয়ে যায়। হ্যাঁ সবকিছুর মধ্যে মানুষজনও পড়ে। মুরুগানকে সামলানোই সব থেকে বড় দায় তার। আর এই দায় কেউ চাপায়নি ওর কাঁধে। সে নিজেই জড়িয়ে পড়েছে। ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। এইসব ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় কেটে গেল। খাবার চাপা দিয়ে চলে যাবে কিনা ভাবছিল…আর সেই সময়েই হাজির হল মুরুগান। ওর ফেরা দেখেই বিদ্যা বুঝতে পারল, আজ মুরুগান অনেক দিন বাদে মুড-এ এসেছে। আজ হুল্লোর হবে খুব। ওর আর আজ যাওয়া হবে না এখন। ঘরে ঢুকেই শুরু করল মুরুগান। ‘আচ্ছা, তুই কি জানিস, এই যে আমরা, মানে কোরাবারা যেভাবে থাকি…মানে এই যে একসঙ্গে চাষবাস, একসঙ্গে রান্না, উর, নার, টাক্কাদের মেনে চলা…এইসব স্ট্রাকচারাল ফর্ম কোথা থেকে এলো তুই জানিস?’ বিদ্যা তো আকাশ থেকে পড়ল। ‘হঠাৎ এই কথা?’ ‘হঠাৎ নয় রে। বাড়ি আসতে আসতে ভাবছিলাম…আমাদের এই যে একসঙ্গে থাকা-খাওয়া, এই ইউনিটি, যার জন্য আমরা এখনও টিকে আছি, কোরাবাদের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, অন্যান্য জনজাতির মতো আমরা হারিয়ে যাইনি, এর পিছনে অনেক বড় একটা গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা কী’করে শিখেছিলেন বা জেনেছিলেন এবং এই ফর্মকে চালু করেছিলেন নিজেদের মতো, তা ভাবলে তুইও অবাক হবি’।
   কী এক আবিষ্কারের আনন্দে মুরুগানের চোখমুখ তখন উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। মুরুগানের অনেক পাগলামি দেখেছে বিদ্যা এযাবৎ, কিন্তু আজকের ব্যাপারটা কী নিয়ে সেটা ভেবে থই পেল না ও। মুখে স্বাভাবিক ভাব দেখিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, শুনব এখন! তুমি আগে মুখ, হাত ধুয়ে এস, খাবার বেড়েছি’। মুরুগান যেন ঘোর লাগা মানুষের মতো যন্ত্রবৎ পরিষ্কার হয়ে এসে খেতে বসে পড়ল। খাবার মুখে তুলতে তুলতেই বকতে শুরু করল আবার। ‘তুই কি জানিস, আমাদের এই গ্রামের যে স্ট্রাকচারাল ফর্ম, সেটা অনুসরণ করে একটা গোটা, আস্ত আর বিরাট দেশ চলেছে বহু যুগ ধরে? একটা রোল মডেল বলতে পারিস সেই দেশকে। এখন অবশ্য ইউনিটি নেই সেই দেশের। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে’। বিদ্যা চুপ করে আছে। ও জানে একটু বাদেই আবার শুরু করবে মুরুগান। ‘তবে ওরা যে আমাদের অনুসরণ করেছে, এমন কথা আমি বলছি না। আবার আমরাও যে ওদের অনুসরণ করেছি, তাও না! মোদ্দা কথা, নীতি দুটো একই। আর এই দেশ চলেছিল একটা, দুটো লোকের থিওরি অনুযায়ী। কার্ল মার্ক্স, লেনিনের নাম শুনেছিস তো? এই সেই মানুষ, যাকে অনুসরণ করে রাশিয়া তৈরি হয়েছিল একদিন। লেনিনের মূর্তি বসেছিল একদিন শহরের প্রাণকেন্দ্রে। আবার বহুযুগ বাদে মানুষই এই মূর্তি ভেঙে টুকরো করেছে, মানতে পারেনি আর ওই থিওরি। তত্ত্বকেও বোধহয় যুগের সঙ্গে বদলাতে হয়, তাল মিলিয়ে চলতে হয়। নইলেই ধরাম্‌!’ এই বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হোহো করে হেসে উঠল মুরুগান। তারপর বিদ্যার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আমাদের গ্রাম, আমাদের কোরাগু এখনও টিকে আছে, কোরাবারা এখনও বেঁচেবর্তে আছে বহাল তবিয়তে। তবে এই গঠন আর কতদিন থাকবে সেও কিছু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। চারিদিকে দেখছিস না তাকিয়ে…কেমন শহরের হাওয়া লেগে মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে?’ বিদ্যার এ নিয়ে কোন সংশয় নেই। সেও দেখছে এসব। কেমন ভাবে জোয়ান ছেলেমেয়েগুলো শহরে চলে যাচ্ছে। শহুরে বাবু/বিবি হয়ে যাচ্ছে। গ্রামে পড়ে থাকছে বয়স্করা। তবে কোনটা ভাল, কোনটা খারাপ, সে বোঝে না। সেই প্রশ্নই করে ফেলল মুরুগানকে, ‘আচ্ছা, তোমার মতে কোনটা ভাল? এই যে শহুরে হাওয়া লেগেছে চারদিকে, মানুষজন আরও আধুনিক হয়ে যাচ্ছে, কত কত পড়াশুনো করছে, অনেক অনেক টাকা কামাচ্ছে, ভালমন্দ দেশবিদেশের খাবার খেতে শিখেছে, পরতে শিখেছে, এগুলো কি খারাপ? নাকি এই গ্রামে পড়ে থেকে, একই ভাবে যুগ যুগ ধরে একই রকম থেকে যাওয়া ভাল? থেমে যাওয়া নয় কি এটা?’ দিব্যার মুখে এহেন প্রশ্ন শুনে আরও চমকিত হল মুরুগান। ও স্বপ্নেও ভাবেনি, বিদ্যা এমন ভাবনা কখনও ভাবতে পারে। চোখেমুখে অপার মুগ্ধতা ছেয়ে গেল মুরুগানের। ঠিক, ঠিক এই জন্যই দিব্যাকে মুরুগান ছাড়তে পারেনি, এড়াতে পারেনি। ওর ভাবনা, চিন্তায় এমন অদ্ভুত টানাপোড়েন আছে, আধুনিকতা আছে, এতদিন ধরে ওকে দেখেও মুরুগানের মুগ্ধতা ঘুচল না তাই। বিদ্যা আবার প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, তবে কি তোমার ওই থিওরি অনুযায়ী, আমাদের এই একসঙ্গে থাকা, কোরাগু’র আদি গঠন ভেঙে যাবে? কোরাগুরা ফেলে দেবে আগের সমস্ত নিয়ম নীতি? কোরাগু থাকবে না?’ শিউরে উঠল মুরুগান বিদ্যার প্রশ্ন শুনে। বিদ্যারও যেন ঘোর লেগেছে আজ। সেও বলে চলল, ‘এই যে আমি, আমার মতো আরও কত জন, নিজেরা চাষবাস না করে তোমার কফি খেতে কাজ করি, আমরা তো শ্রমিক মাত্রই। আদিতে আমরা ছিলাম যোদ্ধার জাত। তারপর শিখলাম চাষবাস। তারপর হলাম খেতমজুর। কেউ শহরে গিয়ে বড় বড় চাকরি করেছে…আমরা সত্যিই বদলে গেছি আগের থেকে। আর যাই হোক, এসবকে তুমি খারাপ বলতে পারবে না কিছুতেই। বদল তো হবেই। তার মানে কি কোরাবারা আর থাকবে না?’ দুজনেই এবার চুপ করে গেল। অনেক অনেক কথা ওদের মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকল, যা কেউ কাউকেই আর বলল না। সংশয়, দোলাচল, অস্তিত্বের টানপোড়েন, এইসব কি আর মুখ ফুটে বলা যায়? ভাষায় প্রকাশ করা যায়?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।