• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ২ ।। খন্ড – ৩)

কফি পাহাড়ের রাজা

দ্বিতীয় পর্ব:

৩)

  এরপরের রাতে রাজারাজেন্দ্র আর রানী মহাদেবাম্মা আবার আগের দিনের মতো বারান্দায় বসলেন মাদুর পেতে। রাজা বলতে শুরু করলেন তাঁর নিজের কথা। ‘আমি কীভাবে পালিয়ে এসেছি বা এরপরে কী হয়েছিল জানার আগে, তোমাকে আরও একটু আগের ঘটনা জেনে নিতে হবে। নইলে সম্যক চিত্রটি তোমার কাছে পরিষ্কার হবে না। টিপুর কথা তো জানই। কোরাগুর ওপরে হায়দার আলীর প্রভাব না জানলে কিছুই জানা হয় না আসলে। হায়দার বৃটিশদের বিরোধিতা করার জন্য তৎকালীন ফরাসীদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন। মাইসোরে নিজের রাজধানী সুরক্ষিত রেখে এরপর কোরাগু অভিযানে এগিয়ে আসেন তিনি। সেই সময়ে কোরাগুর রাজা ছিলেন চিক্কা বীরাপ্পা। যথারীতি ছোটখাট যুদ্ধ বেঁধে যায় তাঁদের মধ্যে। হায়দার আলীকে মাইসোর চিক্কা বীরাপ্পা নিজের এলাকার কিছু অংশ দিয়ে সন্তুষ্ট করেন সেই সময়ে। কিন্তু পরবর্তী কালে, নিজেদের অংশ মাইসোরে চলে যাওয়ায় বিক্ষোভ দেখান প্রথম লিঙ্গরাজা। তখনকার হালেরি রাজা, মুদ্দায়ার ছোট ভাই ছিলেন তিনি। প্রথম লিঙ্গরাজা অর্থাৎ আমার পিতা সীমানা এলাকায় হায়দার আলীর সেনাদের আক্রমণ করেন। সেবারের মতো হায়দার সরে পড়েন। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই আবার হায়দার সীমানা দখলের চেষ্টা করতে থাকেন। মোটামুটি ভাবে ১৭৬৫ সাল থেকে ’৬৮ সাল পর্যন্ত এইরকম চলার পর লিঙ্গরাজার আক্রমণে হায়দার এবার একটু সুর নরম করেন। সেই সময়ে একটি চুক্তিতে হায়দার আলীর মাইসোর এবং কোরাগুর সীমারেখা নির্দিষ্ট করা হয়’।
  এই পর্যন্ত বলার পরে রাজেন্দ্র চুপ করে যান। রানী উদগ্রীব আগ্রহে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী হল, থামলে কেন? তারপর কী ঘটল?’ রাজা রাজেন্দ্র আবার এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নিজের হাতে। তারপর দুঃখিত মুখে বলতে শুরু করলেন, ‘কী জান তো রানী, আমার পিতাই বোধহয় সেইসময়ে এক বিরাট ভুল করে বসেছিলেন। যার মাসুল আমরা ভাইয়েরা গুণেছি’। পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ রাজা। তারপর আবার বলতে থাকলেন। ‘হোরামালে আর বাবাদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না সেই সময়ে। বাবার প্রতাপ দেখে রাজা তাঁকে সহ্য করতে পারছিলেন না, তাঁকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করছিলেন। এই চক্রান্তের কথা বাবা কোন উপায়ে জেনে যান। আর নিজের সুরক্ষার কথা ভেবে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে সেই হায়দার আলীর কাছেই ছুটে যান’। ‘সেকী! এ তো বোকামির কাজ হয়েছিল’। এই বলেই রানী সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিলেন রাজার কাছে। ‘আমাকে মার্জনা করে দিও রাজা। আমি অশিক্ষিত এক নারী, কী বলতে কী বলেছি…’। রাজা হাসলেন একটু। ‘তুমি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এক নারী। যাকে আমি চিনেছি মন থেকে। তুমি কিছুমাত্র ভুল বলনি। সত্যিই এক চরম ভুল করেছিলেন আমার পিতা। যা ঘটে গেছে, যা কিছু অতীত, তাকে তো আমরা আর বদলাতে পারি না! বরং শিক্ষা নিতে পারি সেই থেকে, এটুকুই। যাক্‌, ঘটনায় ফিরে আসি আবার। পিতা হায়দার আলীর কাছে পালিয়ে গিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করলেন। আসলে তখন হরামালে আর মুদ্দায়া দুই গোষ্ঠীর রাজারা কোরাগু পরিচালনা করত। হোরামালেরা তখন কোরাগু প্রায় দখল করে ফেলেছিল। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমার বাবার এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, যেহেতু একটি চুক্তি হয়েছে তাঁদের মধ্যে, তাই হায়দার কোরাগুর দখল আর নিতে চাইবেন না’।
  ‘হায়দার আলীর সহায়তায় লিঙ্গরাজা কোরাগু তো ফিরে পেলেন। হায়দার লিঙ্গরাজাকে রাজা মানলেন। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু তখনও সাদা মনের মানুষ কোরাগুরা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি এরপর তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে’। আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন রাজেন্দ্র। ‘হায়দার আলী কিছুদিনের মধ্যেই কোরাগু নিজের হাতে নিয়ে নিলেন, আর লিঙ্গরাজাকে তাঁর সামন্ত হিসেবে রেখে দিলেন। এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না কোরাবারা। অক্ষম রাগে তারা ফুঁসতে থাকল ভেতরে ভেতরে। এই ঘটনার পরেই আমার পিতা অপমানে, অসম্মানে কার্যত মারা গেছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর শারীরিক মৃত্যু হল। সেই ১৭৮০ সাল তখন। আমাদের তখন বোঝার মতো বয়স হয়নি’।
‘তারপর?’
‘রাজা বিহীন কোরাগুতে তখন বিশৃঙ্খলা শুরু হল। দু বছরের মধ্যেই যোদ্ধার জাতি কোরাবারা হায়দার আলীর অনুপস্থিতিতে একজোট হয়ে আবার নিজেদের রাজ্য ফিরিয়ে নেবার জন্য হায়দার আলীর সেনাদের তাড়িয়ে দিল কোরাগু থেকে। কিন্তু হায়দারও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। কোরাবাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য, কোরাগু যাতে রাজা বিহীন থেকে যায়, সেই জন্যও, লোকলস্কর পাঠিয়ে আমাদের ভাইদের নিয়ে চলে গেলেন। আগেই বলেছি, আমাদের গোরুর কেল্লাতে আটকে রাখা হয়েছিল। যদিও খাওয়া, পরা বা শিক্ষা, কোনকিছুর অভাবই রাখা হয়নি আমাদের। এমনকি রাজপরিবারের সম্মান দিয়েই আমাদের ওখানে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই বয়সেই আমরা বুঝে গেছিলাম, আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের শৈশব, আমাদের স্বাধীনতা’।
রানীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলতে থাকলেন রাজা। আবেগ, স্মৃতিতে তখন তিনি উদ্বেল। ‘সবথেকে আশ্চর্যের ঘটনা কী জান? আমাদের নিয়ে আসার কিছুদিনের মধ্যেই হায়দার আলী মারা গেলেন!’
‘বল কী! তাহলে তো তোমাদের মুক্তির পথে কোন বাধা ছিল না’।
‘হাসির কথা বললে রানী। সেই সময়ে টিপু তখন একেবারে টগবগে জোয়ান। তাঁর তেজ দেখে কে! বাবার মৃত্যুর পর সে এসে আমাদের কেল্লার সুরক্ষা আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিল। তারপর বৃটিশদের সঙ্গে টক্করে গেল। ম্যাঙ্গালোর ছিনিয়ে নিয়ে এলো সে তাদের হাত থেকে। সেই তেজে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল কোরাগুর ওপর। তার সমস্ত সৈন্যসামন্ত নিয়ে কোরাগু দখল করে নিল। মুদ্দুকেরি প্রাসাদে তার নিজস্ব আস্তানা পাকাপাকি ভাবে গড়ে উঠল সেই থেকে’। কিন্তু এরপরেও আমরা দমে গেলাম না। আবারও কোরাবারা টিপুর বিরুদ্ধে আক্রমণে উঠে পড়ে লাগল। প্রচণ্ড ক্রোধে টিপু এবার একেবারে শেষ দেখতে চাইলেন। ১৭৮৪ সাল তখন। ফরাসী জেনারেল লাল্লির সহায়তায় নিজের ৩২,০০০ সেনা নিয়ে কোরাগু আক্রমণ করলেন। এই যুদ্ধে কোরাগুর সাধারণ মানুষদেরও তিনি রেহাই দেননি। হাজারে হাজারে নিরপরাধ কোরাগু নাগরিক, সেনা, আধাসেনা, সবাইকে বন্দি করে একেবারে শ্রীরঙ্গপত্তনে পাঠিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়, কোরাবাদের শেষবারের মতো সাবধান বাণী দিয়ে জানালেন, ‘এ পর্যন্ত অন্তত সাতবার তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছ, আমাদের অনেক সেনা, অস্ত্রশস্ত্র ও সময় নষ্ট করেছ। এরপরে যদি আবার আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ কর, জানবে এই কোরাগু আমি ধূলিসাৎ করেই ছাড়ব’। টিপুর এহেন আক্রমণে ও ধমকে কোরাগুরা কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছিল সেই সময়ে। কর্তৃত্ব দেবার মতো কোন রাজা বা দলপতিও তখন তাদের ছিল না। ফলে প্রায় চার বছর কোরাবারা চুপচাপ বাধ্য হয়ে টিপুর শাসন মেনে নিয়েছিল। টিপুও সাময়িক স্বস্তিতে ছিল ততদিন। আর আমরাও বেড়ে উঠছিলাম কোরাগু থেকে বেশ কিছুটা দূরে’।
  রাত গভী্র হয়ে এসেছে। চারিদিকে পোকামাকড়ের তীব্র চিৎকার আর উৎপাতে রানী বেশ কিছুটা বিরক্ত হয়ে উঠে পড়েছেন। দূরের জঙ্গল থেকে বন্য পশুর ডাকে মাঝেমাঝেই কেঁপে উঠছিল আশপাশ। মহাদেবাম্মা বললেন, ‘চল, এবার ঘরে যাই। ঘুম পাচ্ছে’। অন্যসময় হলে রানীকে নিয়ে এতক্ষণে তিনি আদরে, সোহাগে মেতে উঠতেন। রাজারাজেন্দ্রর এখনকার মানসিক পরিস্থিতি সেরকম নয়। তাঁর মনে পড়ছে একটি কিশোর ছেলের কথা। এক নির্জন কেল্লায় বসে, শুয়ে, একা একা সেখান থেকে পালাবার ছক কষত যে। চারটে বছর ধরে সে ঠাণ্ডা মাথায় শুধু ঘুরে ঘুরে কেল্লার চারিদিকের দরজা, গোপন পথ, সুড়ঙ্গ, পরিখা, সমস্ত কিছু গভীর মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করে গেছিল। আর ঘরে এসে কাগজে ম্যাপ এঁকে পালাবার পরিকল্পনা করত। এখন রাজেন্দ্রর নিজেরই অবাক লাগে, কীভাবে তিনি পালিয়ে আসার সাহস অর্জন করতে পেরেছিলেন সেই অল্প বয়সে! হয়ত মরিয়া হয়ে গেলে মানুষ এমন অনেক কিছুই অসাধ্য কার্য করে ফেলে।
  কুপিল্লার নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। বীরা রাজারাজেন্দ্রর মতো নয়, বরং আর পাঁচটা ছেলের মতোই স্বাভাবিক ছিল তার ছেলেবেলা। বাবার কাছে রাশি, নক্ষত্রের পাঠ নিত যখন, মনে মনে সেই নক্ষত্রের ছবি কল্পনা করত। আর রাশির ছবি ভাবতে গেলেই খেই হারিয়ে ফেলত। যদিও পরে বুঝেছে, এগুলো সবই কাল্পনিক আকার। এই যেমন সূর্য সিংহ রাশিতে প্রবেশের ১৮তম দিনে এই কাইলপোলড়ু উৎসব শুরু হয়। কাইল মানে অস্ত্র আর পোলড়ু মানে উৎসব। এই দিনের অর্থ ‘নতি’ স্বীকার—অর্থাৎ ধান কেটে ঘরে নিয়ে যাওয়া। এর আগে, যখন ধান পেকে উঠেছিল, গ্রামের সকল সদস্য জঙ্গলি জানোয়ারের থেকে ফসল পাহারা দেওয়ার জন্য অথবা ফসলের দেখভাল করার জন্য মাঠেই পড়ে থাকত পালা করে। আর তাদের সব অস্ত্র জড়ো করে রাখা থাকত ‘কান্নি কোম্বারে’ বা প্রার্থনা ঘরে। এই পুজোর ঘর থেকে এই কাইলপোলড়ু’র দিন সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র বের করা হয়। তারপর সেগুলোকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়। সেদিন ভোরে সবাই স্নান সেরে নেয়। তারপর তাদের মহল্লার মাঝখানে অবস্থিত এক বিরাট হলঘর, নেল্লাক্কি নাড়ুবাড়ে’র ভেতরে সাজিয়ে রাখা হয়। পুজোপাঠের পরে পরিবারের প্রবীণজন তাঁর অগ্রজের হাতে তুলে দেন অস্ত্র। পারিবারিক সংহতির এ এক অনন্য নজির। এরপরেই শুরু হয় আসল উৎসব। সেদিন খাদ্য তালিকায় কাড়ুমবুট্টু  আর পানড়ি কারি অবশ্যম্ভাবী। সঙ্গে থাকে মদ। মাঠে ততক্ষণে খেলা ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। পশুপাখি শিকারে সেদিন তারা যায় না। একটা লম্বা গাছে নারকোল বেঁধে দিয়ে, সেটাকেই টার্গেট করে শুটিং প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এছাড়াও ৮-১০ জনের এক একটা দল স্থির করা হয়। একদলের হাতে থাকে নারকোল। অন্যদল সেগুলো ছিনিয়ে নিয়ে আসে। আরেকটি খেলা হল পাথর ছুড়ে নারকোলকে ১০-১৫টা টুকরোয় ভাঙা। পা দিয়ে একটা পাথরের টুকরোকে নিজের ঘাড়ের ওপর দিয়ে পিছনে ছুড়ে দেওয়াও খুব জনপ্রিয় কোরাবাদের মধ্যে। আর এই সবের মধ্যে, ওকে অস্ত্র পুজোর পরে যখনই সবাই ছড়িয়েছিটিয়ে থাকবে, বিদ্যার সঙ্গে ভাব করতে হবে। এবারে আর সে তোতলাবে না, বমিও করবে না।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।