মুরুগান কুর্গ অঞ্চলের এক আধক্ষ্যাপা বয়স্ক কফি প্ল্যান্টার। নিজের বলতে এক মাতাল ভাইপো, কুগান ছাড়া তার সঙ্গী কয়েকটি কুকুর। নিজেই জঙ্গলে ঘুরে পাহারা দেয় রাতভর। একটি পা তার কাঠের। জেসাসের ক্রশ বুকে ঝোলে তার সর্বক্ষণ।
প্রথম পর্ব:
২)
হজ করে ভারতে ফিরছেন এক বৃদ্ধ পিরবাবা। ইয়েমেন থেকে ফেরার সময়ে তাঁকে যেন একটু বেশিই সন্ত্রস্ত আর ভীত দেখাচ্ছে। অথচ একজন হাজি’র তো শুদ্ধ ও প্রসন্ন চিত্তে বাড়ি ফেরার কথা! তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে বাবা বুদান নামে সম্বোধন করছেন মাঝেমাঝে। কোনরকমে দু’এক মুঠো মুখে তুলছেন অনিচ্ছায়। বেশির ভাগ সময়ে চুপচাপ আর স্থির হয়ে হাতের লাঠিটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরে শকটে বসে আছেন। যেন লাঠিতেই রয়েছে তাঁর প্রাণভোমরা। এমনকি রাতেও তিনি ঠায় জেগে বসে আছেন লাঠি হাতে। আর সারাক্ষণ হাতের মালা জপ করে চলেছেন। অথচ সঙ্গীরা কিন্তু বাবা বুদানকে এমন আচরণ করতে আগে কখনও দেখেনি। তারা অনেকেই তাঁর শরীর সম্বন্ধে বারেবারে খোঁজখবর করায় তিনি আবার বিরক্ত হচ্ছেন। ফলে তারা কেবল ফিসফিস আলোচনা করছে নিজদের মধ্যে—কী এমন হল বাবা’র? বেশ কয়েকদিন এভাবে কেটে যাওয়ার পরে বাবার মুখে একদিন যেন হাসি ফিরে এলো। সেদিন ভোরের আলো ফোটার সময়ে আজান শুনে বাবা নমাজ সেরে এলে, সকলে দেখল, বাবা আবার সেই আগের হাসিখুশি অবস্থায় ফিরে গেছে। এ কদিনের দুশ্চিন্তার রেশ উধাও তাঁর মন থেকে। আর সুখের কথা এও যে, আরবের সীমানা ছাড়িয়ে শকট এবার নিজেদের দেশে প্রবেশ করেছে। হয়ত দেশ বাবাকে টানছিল। অনেকদিন একটানা বিদেশে থেকে হয়ত বাবার মন খারাপ হয়েছিল। যাই হোক না কেন, সকলে আজ খুব ভারমুক্ত মনে রইল। তবে বাবা কিন্তু লাঠিটা এখানে এসেও হাতছাড়া করেননি, এটা সকলে খেয়াল করেছে।
শেষ পর্যন্ত যাত্রা শেষ হল। সেই সময়ের মহীশূরের চিকমাগলুর জেলার ছ’হাজার ফিট উচ্চতার চন্দ্রগিরি পাহাড়ে, যেখানে বাবা বুদানের আস্তানা, বাবা এসে পৌঁছলেন সপারিষদ। নিজের ডেরায় গিয়ে বাবা সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি তোমাদের এবার একটি ঘটনা বলব। যা শুনে তোমরা আমাকে যদি দোষী সাব্যস্ত কর, তো সে পাপ আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব।‘ ভক্তরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তখন বিস্ময়ে। এ আবার কী ধর্ম সঙ্কটে ফেলে দিলেন তাদের বাবা! একজন তবু সাহস করে বলে ফেলল, ‘আপনি কোন গুনাহ করতেই পারেন না। এ আমাদের বিশ্বাস। তবু যদি না জেনেবুঝে কিছু অন্যায় ঘটে থাকে আপনার দ্বারা, আল্লাহ্ আপনাকে ক্ষমা করে দেবেন। আপনার স্থান আমাদের কাছে একই রকম থাকবে।‘ বাবা যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন। গুছিয়ে বসে তিনি এবার ধীরে ধীরে তাঁর কাহিনি শুরু করলেন। ‘আমি যখন ইয়েমেনে পৌঁছাই, ওখানে কফি খেয়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভাবছিলাম, আমাদের দেশে কেন এমন কফি পাওয়া যায় না! স্থানীয়দের থেকে কফি চাষের পদ্ধতি শুনে মনে হয়েছিল, আমাদের এই চন্দ্রগিরিতে উত্তম মানের কফি চাষ হতে পারে। এখানকার মাটি, জলহাওয়া, পাহাড়ের ঢাল, সর্বোপরি এই বৃষ্টি—এখানে কফি চাষের খুবই সহায়ক। কিন্তু পরে শুনলাম, এই কফি বীজ আরব দেশ থেকে কোথাও রপ্তানি করা হয় না। বীজ সিদ্ধ করে বা গুঁড়ো করে কফি প্রস্তুত করার পরেই তা রপ্তানি করা হয়। অন্য দেশ যাতে কফি চাষের পদ্ধতি শিখে না ফেলতে পারে, যাতে তাদের ব্যবসায় ক্ষতি না হয়, তাই কফি বীজ ওদেশের বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়ার আইন নেই, লুকিয়ে কেউ নিতে গেলে এবং ধরা পড়লে তাকে কঠিন সাজা দেওয়া হয়। এইটুকু শুনে আমি প্রচণ্ড হতাশ হই। এদিকে সেই কফির ঘ্রাণে আমি পাগল হয়ে উঠেছি প্রায়। কী জানি কেন, মাথায় রোখ চেপে গেল আমার সেদিন। আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে আল্লার নাম করে, একটি একটি করে পবিত্র সাত সংখ্যাকে মনে রেখে, সাতটি বীজ চুরি করলাম। এই সময়ে, একদিকে গ্লানি আমায় চেপে ধরছিল, অন্যদিকে আনন্দ। এরপর আবার সেই বীজ দেশে নিয়ে যাব কীকরে সে উপায় ভাবতে ভাবতে আমার রাতের ঘুম চলে গেল প্রায়। শেষে আল্লাই আমাকে বুদ্ধি দিলেন স্বপ্নে। আমার এই লাঠির ভেতরে আমি সাতটি বীজকে লুকিয়ে নিয়ে এলাম। পুরো যাত্রাপথ উদ্বিগ্ন ছিলাম ধরা পড়ার ভয়ে। একজন লোভী তস্করের বেশি নিজেকে ভাবতে পারছিলাম না সে সময়ে। মনে হচ্ছিল হজ করার সমস্ত পূণ্যফল এই কটি কফি বীজ চুরি করে নষ্ট হয়ে গেল। এইবার তোমরা আমায় যা শাস্তি দেওয়ার দাও। তবে এই পাহাড়ে আমি এই বীজ পুঁতবই। চাষের পদ্ধতিও জেনে এসেছি। তোমাদের শিখিয়ে দেব।‘
ভক্তরা হৈহৈ করে উঠল সব শুনে। তারা বাবাকে কাঁধে করে পাহাড়ে নিয়ে চলল তখুনি। সেই সাতটি বীজ পোঁতা হল। বাবা হাসিমাখা প্রশান্ত মুখে এবার মুরুগানের দিকে তাকালেন। আর বললেন, ‘এবার তোমার দায়িত্ব মুরুগান। এই পশ্চিমঘাট পর্বতমালা শুধু কফি গাছে ভরিয়ে দেওয়া এবার তোমার দায়িত্ব।‘ চোখ খুলে গেল মুরুগানের এরপর। ধড়ফড় করে উঠে বসল ও। এইরকম অদ্ভুত একটা স্বপ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না ও। সেই কবেকার বাবা বুদানের কিস্যা, যা ও লোকমুখে শুনেছে, সেই চন্দ্রগিরিকে এখন বাবাবুদান গিরি নাম দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনা নয় নয় করে সেই ১৬৭০সালের ঘটনা। তারপর পশ্চিমঘাটের গা বেয়ে অনেক অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সেই সময়ের শাপদ সঙ্কুল ঘন জঙ্গলে ঘেরা বাবাবুদান গিরিতে ধীরে ধীরে লোকবসতি বেড়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে কফি চাষ পদ্ধতি শুরু হওয়ার পরে বড় আকারে চাষবাস করতে তাও লেগে গেছে দেড়শো/দুশো বছর। ১৮৪০ সালে স্থানীয় বাসিন্দারা জমি কিনে এই পাহাড়ে কফি চাষ শুরু করে পাকাপাকি ভাবে। তারপর আসে বৃটিশরা উনিশশো সালের পরে। তারা না এলে কফি প্ল্যান্টেশনের আধুনিক পদ্ধতি শিখতেই পারত না কন্নড়রা। সে যাই হোক, এই বাবা বুদানের উদ্দেশ্যে মনে মনে একটা স্যালুট ঠুকল মুরুগান। এতদিন বাদে আবার যেন নতুন করে উদ্দীপনা অনুভব করল ও মনে মনে। যেন সেই তরুণ মুরুগান নতুন করে পাঠ নিতে চলেছে কফি চাষের। কফি বীনসের ভেতর থেকে নির্যাসটুকু স্বার্থপরের মতো বের করে আনা তার কাজ নয়। কফি বিনস ভেতরে ভেতরে যাতে লালিত হতে পারে, শাঁসে ভরে ওঠে যেন তার অন্তরাত্মা, এই পালনের কাজটুকু তার। স্রেফ এক গাইডের ভূমিকা যেন। মাঝেমধ্যে রুটিন প্রসেসগুলো ঠিকঠাক চলছে কিনা খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া। খাদ্য আলাদা করে বিশেষ প্রয়োজন হয় না। যদিও স্পেশাল কিছু সাপ্লিমেন্ট দিতে হয় মাঝেমাঝে। তবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয় কীটনাশক প্রয়োগের ক্ষেত্রে। মুরুগান এত বছরের অভিজ্ঞতায় জেনে গেছে, এই কীটনাশক ছাড়া কফি চাষ কোনমতেই সম্ভব নয়। একবার পোকার সংক্রমণে পাতার পর পাতা, বীনসের পর বীনস একে একে নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতে শেষ হয়ে যাবে, আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া তখন আর কিছুই করার থাকবে না। আবার অতিরিক্ত কীটনাশকে মাটি নষ্ট, পরিবেশ নষ্ট। ফলে এই কাজে প্রয়োজন বিশেষজ্ঞের।
তা মুরুগানও অভিজ্ঞতায়, শিক্ষায় কোন বিশেষজ্ঞের কম কিছু নয়। বিনস দেখলেই ও বলে দিতে পারে, এর কোয়ালিটি সম্বন্ধে। আকাশ দেখেই ও বলে দিতে পারে, এবারের বৃষ্টি কেমন হবে, ফসল কেমন হবে। তবে এগ্রিকালচার সাইনটিস্ট যে ও রাখে না তাও নয়। প্রতি বছর একজন এক্সপার্ট এসে সয়েল টেস্ট করে, নতুন কিছু ফর্মুলা বের হলে, সে নিয়েও আলোচনা হয় তার সঙ্গে। মুরুগান মনেপ্রাণে যথেষ্ট আধুনিক থাকার চেষ্টা করে। ও এতদিনে এটুকু বুঝেছে, এই চাষবাসের ক্ষেত্রে অন্তত নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গি বজায় না রাখলে সমূহ বিপদ। কারণ আর কিছুই না, প্রতি বছর মাটির চরিত্র বদলাচ্ছে, জলহাওয়ার হেরফের তো আছেই। এরপর কীটাণু বা অন্য ভাইরাল সংক্রমণ—তাদের চরিত্র বদলাচ্ছে প্রতি নিয়ত। স্ট্যাটিক ধ্যানধারণার বশবর্তী হলে ফলনে তার ছাপ পড়বে। এরপরেও কিছু আছে এ লাইনে। নিজের চোখ, কান খোলা রেখে নিজেকে প্রতি মুহূর্তে বদলাতে হবে, খাপ খাইয়ে নিতে হবে আধুনিক ব্যবস্থার সঙ্গে। আজও মুরুগানের মনে পড়ে, দশ বছর আগের নিজের গোয়ার্তুমির কথা। হাতেকলমে কাজ করে ততদিনে মুরুগান নিজেকে কফি চাষের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ধরে নিয়েছিল। অভিজ্ঞতার যে কোন সীমা নেই, সেই বছরেই মুরুগান প্রত্যক্ষ করেছিল। এই পাহাড়ে এসে সে ধীরে ধীরে নিজের জমির সীমানা বাড়িয়েছে। তবে প্রথম থেকেই সে ১০০০মিটার থেকে ১৫০০মিটার উচ্চতায় ভাল ও দামী কোয়ালিটির অ্যারাবিকা প্রজাতিরই ফলন ফলিয়েছে। গত কয়েক বছর অবশ্য প্রোডাকশনের চাপ কমাতে ১০০০মিটারের নিচের ঢালে কিছু কম দামী রোবাস্টা প্রজাতিরও ফলন ফলিয়েছে। আসলে এ সবই হল কম্প্রোমাইজ, যা কোনদিন মুরুগান করতে চায়নি। তার একগুঁয়ে স্বভাব তাকে কম্প্রোমাইজ করতে শেখায়নি। তবুও কেন যে রোবাস্টার চাষ সে করছে, সে নিজেও জানে না। আরও টাকা চাই বলে? নাকি নেহাতই সবাই করছে, তাই সেও রোবাস্টায় ঝুঁকল, এমনটা? আসলে মুরুগান যা কামায়, অত টাকাকড়ির ওর প্রয়োজন হয় না। ব্যাংকেই পড়ে থাকে বেশিরভাগ টাকা। এই কারণে আবার তাকে এক উকিলের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ইনকাম ট্যাক্স, ইত্যাদির চক্করে। সে এসবের কিছুই বোঝে না। বোঝে না মানি সেভিংসের এবং ট্যাক্স বাঁচানোর হাজার রকম ফন্দি। এসব না বুঝেও তো দিব্যি কেটে গেল তার জীবনটা। তাও যদি ছেলেমেয়ে থাকত, নাতিপুতি থাকত, নাহয় তাদের মুখ চেয়েও কিছু বাড়তি পয়সা উপায় করার ইচ্ছে হত।