• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ৩)

কফি পাহাড়ের রাজা 

প্রথম পর্ব:

৩)

তখন মুরুগান শুধু অ্যারাবিকাই চাষ করত। নিজে হাতেকলমে পোকা মারার ওষুধ স্প্রে করে এবং করিয়ে খুব ভাল ফল পেয়েছিল সেবারে। গরমের সময়ে তাই কফি গাছের কাণ্ডের ভেতরে বাসা বাঁধা সাদা পোকাগুলোকে আর দেখা যায়নি। মুরুগান ভেবেছিল এই ‘হোয়াইট স্টেম বোরার’গুলোর বোধহয় বংশনাশ করতে পেরেছে। কিন্তু শীতের ঠিক আগে তারা যে আবার এসে কফিগাছগুলোকে কুরে কুরে খেয়ে নেবে, সেটা ছিল ওর কল্পনারও অতীত। ফল যা হবার তাই হয়েছিল। যখন স্প্রে চালু করল ও, ততক্ষণে প্রায় সমস্ত গাছ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেবার কফি চাষ। শয়নে, স্বপনে, জাগরণে মুরুগানকে তখন শয়ে শয়ে, হাজারে, হাজারে সাদা সাদা পোকা তাড়া করছে, কুরে কুরে খাচ্ছে ওর মস্তিষ্ক। খুব ভেঙে পড়েছিল সেবার মুরুগান। চাষের ক্ষতির জন্য ততটা নয়, যতটা নিজের অহং ধাক্কা লেগে চুরমার হয়ে গেল বলে। পরের বার গরম পড়ার আগে নিয়মমতো ১০%লাইম সলিউশন অর্থাৎ ২০০লিটার জলে ১০০এমএল ফেভিকল ডিডিএল-এর সঙ্গে ২০কেজি স্প্রে লাইম মিশিয়ে তৈরি হয় এই লাইম সলিউশন। প্রতি গাছের গা ধুয়ে দিতে হয় এই জল দিয়ে। মুরুগানের মনে হয় যেন ওরা সাবান মেখে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। এরপর বর্ষা এলে স্নান করবে ওরা। এইসব নিত্যকার কল্পনায় ভর করা ভাবনা মুরুগানকে ঘিরে রাখে। নিজেরই আমোদ পায়, হাসে ফিকফিক করে। তবে যাই হোক না কেন, কয়েক মাসের জন্য এই মুরুগানের মুখ থেকে হাসি মুছে দিয়েছিল ওই সাদা পোকাগুলো। একটা ট্রমার মধ্যে চলে গেছিল ও সেবার। ঘুম থেকে উঠে মেঝেতে পা দিলেই মনে হত, মেঝে ময় ছড়িয়ে আছে থিকথিকে সাদা পোকা, ভয়ে, আতঙ্কে চিৎকার করে উঠত ও। রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখত, ওর লিঙ্গ ছেঁকে ধরে আছে ওই সাদাপোকার দল…আতঙ্কে জবজবে ঘামে গা ভিজে যেত ওর। এমনকি টয়লেটে গিয়ে কমোডে বসলে মনে হত, কমোডের গা বেয়ে ওই পোকাগুলো ওর পায়ুর ভিতরে প্রবেশ করছে!! মুরুগানকে কয়েক মাসে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল এই আতঙ্ক। শেষ পর্যন্ত একজন পরিচিতের নির্দেশ মতে কাউন্সিলিং করিয়ে কেটেছিল ওই ট্রমা। ওজন কমে গেছিল আট কেজি। তো, যাই হোক না কেন, সেবারের ধাক্কায় মুরুগান আরও একটু বেশি অভিজ্ঞ হয়েছিল। প্রতি বছর নিয়ম করে তাই এক্সপার্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসে ও। আর শুধু তো এই সাদা পোকাই নয়, আরও আছে বেশ কিছু নচ্ছার।
জীবন তাকে ঘাড়ে ধরে শিক্ষা দিয়েছিল এমনি ভাবে। মুরুগান যেন একটু বদলে গেছিল সেই থেকে। জেদি, একগুঁয়ে ভাবটা একটু কমে গেছিল। আরও বেশি উদাসীনতা তাকে পেয়ে বসেছিল। আর সেই সময় থেকেই এলাচ গাছের প্রেমে পড়েছিল ও। মাঝরাতে এলাচ গাছের চুলে বিলি কেটে দিত ও, জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠত কখনও কখনও। আবার একেক সময়ে মনে হত যেন কপাল থেকে চুল সরিয়ে এলাচ গাছের মুখটি দুহাতে তুলে ধরে চুম্বন করছে ও! কামিনরা হাসত প্রথম প্রথম। ওর নামই হয়ে গেছিল এলাচ-মুরুগান। তবে পরে এসব সয়ে গেছিল সকলের। মুরুগানকে কেউই খুব একটা ঘাঁটাত না বিশেষ। দরকারে ডাকলে অবশ্য মুরুগান এই গরীব মানুষগুলোর সহায় হতে কখনই পিছপা হয়নি। টাকা ধার দেওয়া, কার মেয়ের বিয়ে, কার শরীর খারাপ, এইসব নানা অজুহাত অথবা সত্যি কারণে মুরুগান দিলদরিয়া ছিল। ফলে মালিক, শ্রমিক সমস্যায় ওকে খুব একটা পড়তে হয়নি। তবে একেবারেই যে হয়নি এমনও না। কয়েকজনের উস্কানিতে কিছু শ্রমিক মাঝে ঝামেলা পাকিয়েছিল কিছুদিন। তবে সেসব কাটিয়ে উঠতে বিশেষ সময় বা বেগ পেতে হয়নি মুরুগানকে। অবশ্য এর জন্য ও বিদ্যাবতীর কাছে চিরিকাল ঋণী রয়েছে। বিদ্যা না থাকলে কামিনদের সঙ্গে সেবার বিস্তর ঝামেলা হত। হয়ত কাজই বন্ধ করে দিত ওরা। পাওনাগণ্ডা মুরুগান ভালই দেয়, ছুটিছাটাও নিয়মমতো। তবুও কী যেন সব এজেন্ডা নিয়ে ওদের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছিল মুরুগানের। আর তলে তলে বিদ্যা ওদের ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে ঠাণ্ডা করেছে। এক অদ্ভুত নারী এই বিদ্যা। ওকে কখনই বোঝার চেষ্টা করেনি মুরুগান। বোঝার মতো ওর ভিতর কোন পদার্থ আছে কিনা, সে বিষয়েও ওর সন্দেহ আছে। বিদ্যাকে মুরুগান প্রথম দেখে তাও প্রায় বছর কুড়ি আগে। ওরই খেতে কাজ করছিল। লোহার মতো কালো শরীরটাও যেন সত্যি সত্যিই লোহা দিয়ে তৈরি ছিল ওর। কাটা কাটা ভাস্কর্যের মতো লোহায় কোঁদা মুখের দিকে তাকালে চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে হবে যে কোন পুরুষেরই। দুটো চোখের সাদা মণি যেন কালো মুখের ওপর ভাঁটার মতো জ্বলছে—এমনই মনে হবে যে কোন কারুর। মুখ থেকে ওর শরীরে চোখ নেমে এলে মনে হত, যেন রক্ত, মাংসের নয় ওই শরীর। ধাতব পুরু চামড়ায় তৈরি কোন বস্তু। স্তন, কোমরের বাঁক, নিতম্ব, সবটাই যেন লোহার তৈরি নিরেট, যাকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হওয়ার কোন মানেই হয় না। অথচ বিদ্যাবতীকে নিজের শরীরের নিচে একদিন আবিষ্কার করে মুরুগান বুঝেছিল, শক্ত, কঠিন আবরণের নিচে একতাল নরম মাংস আর কোমল হৃদয়ের মিলনে তৈরি আর পাঁচটা ভারতীয় মেয়ের মতোই ও। শুধু বাইরেটাই যা শক্ত দেখায়। কেন জানি, নারকোলের উপমা মনে পড়ে বিদ্যাবতীকে দেখলে।
বিদ্যাবতীকে প্রথম দেখার পর মুরুগান ওকে মনে রাখেনি স্বাভাবিক ভাবেই। তখন ওর বউয়ের মৃত্যুর বয়স প্রায় এক বছর হতে চলেছে। স্মৃতিকাতরতা খানিকটা হলেও কমেছে। খেতে ঘুরে ঘুরে কাজের তদারকি করতে করতে ওর সারাদিন কেটে যায়। রাতে একা একা পাহাড়ের ঢালে শুয়ে থাকে ও। তখনও মুরুগানের দুটি পা অক্ষত। বয়স কম, শরীরে যৌবন হানা দেয় স্বাভাবিক নিয়মে। জানি না, কেন সেই রাতে বিদ্যা ওই পাহাড়ের ঢালে একা একা এসেছিল। হয়ত ইচ্ছে করেই এসেছিল। মুরুগান যে ওখানে রোজ রাতে এসে শুয়ে থাকে, সে খবর ও জানত হয়ত। বিদ্যার ঘর এই ঢালের নিচেই যে বস্তি আছে সেখানেই। চাঁদনি রাতে কালো পাথুরে শরীরটা নিয়ে বিদ্যা হাজির হয়েছিল মুরুগানের সামনে। মুরুগান তখন খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিত হয়ে শুয়ে তারা গুনছে। এক ঝটকায় ব্লাউজ খুলে ওর বুকের ওপর চেপে বসেছিল বিদ্যা। প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেছিল মুরুগান। বিদ্যাকে চিনতে সময় লেগেছিল ওর। ওর মনে হচ্ছিল কোন গ্রীক দেবী তার পাথুরে-কোমল শরীর নিয়ে তার সামনে এসেছে। এক অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল মুরুগান। স্তনে হাত দিতে ভয় পাচ্ছিল ও। যদি দেবী রুষ্ট হন! কিন্তু সামলাতেও পারছিল না নিজেকে। দেবীই উদ্যত হলেন তখন। তার দুই হাত ধরে স্তনে ছোঁয়ালেন। নিজের পুরু ঠোঁট ডুবিয়ে দিলেন মুরুগানের ঠোঁটে। কামনা মদির সেই রাতে দুই অভুক্ত শরীরের মিলন শেষ হতে বেশি সময় লাগেনি। এতটাই আকস্মিক ছিল সেই ঘটনা, যে মুরুগানের বিহ্বলতা কাটছিল না। আর বিদ্যা স্বয়মাগতা ছিল ঠিকই, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মুরুগানের থেকে পাওয়া প্রথম মিলনের স্বাদ পেয়ে কিছুটা জড়সড়, লজ্জিতও কিছুটা তখন…যেন গর্হিত কিছু কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলায় অনুতপ্ত সে। মুরুগান চুপ করে পড়ে রইল। আর নিজেকে গুছিয়ে বিদ্যা ধীরে ধীরে চলে গেল সেই রাতে। পরের রাতে মুরুগান অপেক্ষা করছিল, কিন্তু বিদ্যা এল না। বিদ্যা তখন নিজের ঘরে, নিজের প্যারালিটিক স্বামীর বাঁদিক পড়ে যাওয়া শরীরে আয়ুর্বেদিক তেল মালিশ করছে। সেই রাতের ঘটনার সাক্ষী কেউ ছিল না যদিও। হয়ত বিদ্যা নিজেকে সামলে নিত আবার। কিন্তু মুরুগানের শরীরে তখন আগুন জ্বলে গেছে। দিনের বেলা প্রতিটি কুলি লাইনে গিয়ে ও বিদ্যাকে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে বের করল। তারপর ওকে ডেকে নিয়ে এল একটু দূরে। সবাই যে ওদের দেখছে, সে সেন্স মুরুগানের ছিল। তাই বেশ উঁচু গলায় বলল, ‘কাল থেকে আমার বাড়িতে আসবি, কাজকর্ম, রান্নাবান্না করে দিবি। তাতে তোর মজুরি কাটা যাবে না’। এই বলেই মুরুগান আর দাঁড়াল না ওখানে। পরের দিন খুব ভোরে মুরুগানের বাড়িতে হাজির হল বিদ্যা। মুরুগান আর কুগান তখন ঘুমে তলিয়ে আছে। ঘরদোর পরিষ্কার করে, যা যা সব্জি পেল, তাই দিয়েই রান্না করে সে সোজা চলে গেল নিজের লাইনে। মুরুগান জানতেও পারল না বিদ্যা কখন এল আর কখন গেল। তবে এই ইশারায় কাজ হয়েছিল। বিদ্যা সেদিন থেকে রোজ রাতে মুরুগানের কাছে পৌঁছে যেত। এভাবে এই দুজনের শারীরিক প্রেম যে কখন মানসিক দিকে ঢলে গেছিল, তা ওরা নিজেরাও বোঝেনি। মুরুগান কি ভালবেসেছিল কোনদিন বিদ্যাকে? এ প্রশ্ন সে নিজেও নিজেকে করেছে অনেকবার। সদুত্তর পায়নি। যদিও এখন শরীর মরে গেছে দুজনেরই। কিন্তু বিদ্যার স্পর্শ সে রোজ পায় নিজের ঘরে। ঘুম থেকে উঠে মুরুগান দেখে সব কিছু পরিপাটি করে রাখা। রান্না করে ঢাকা দিয়ে রাখা। যদিও একমাত্র বর্ষার সময়ে ছাড়া বিদ্যার সঙ্গে ওর মোলাকাত প্রায় হয়ই না। বিদ্যা এখন নিজের জোরেই মুরুগানের একমাত্র অভিভাবক। দেখা হলেই বকাঝকা করা ছাড়া বিদ্যার বাড়তি কোন কিছু যেন আর বলার নেই মুরুগানকে। মুরুগানও চুপচাপ শুনে যায়। দু একটা উত্তর দেয় মাঝেমাঝে। ভালবাসা আছে কী নেই, এগুলো নেহাতই অবান্তর ওদের কাছে এখন। দুটি মানুষ, একে অপরকে নির্ভর করে বেঁচে আছে—এটুকুই সত্য।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।