• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ৪)

কফি পাহাড়ের রাজা

প্রথম পর্ব:

৪)

মুরুগান আর বিদ্যাবতীর একে অপরের প্রতি ঘনিষ্ঠতা যত বেড়েছে, ঘটনা প্রচার হতেও সময় নেয়নি। মুরুগান একা মানুষ, তায় ধনী চাষী, বিপত্নীক, ফলে ওর যে একটা মেয়েমানুষের শরীর লাগে, এ যেন স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিল সকলে। এমনিতেই মুরুগানের ওপর অভিভাবকত্ব করার কেউ ছিল না। তাই ওর দিক থেকে আপত্তি তোলার কেউ নেই। কুগান দু’একবার ফাজলামি করে বলেছিল অবশ্য, নতুন কাকিমা এল নাকি! তবে সেও ধীরে ধীরে বিদ্যাবতীর যত্নে, স্নেহে ক্রমশ বিদ্যাবতীর ফ্যান হয়ে গেছিল। বিদ্যাকে একসময় মুরুগান কুলি লাইনে কাজে যেতে বারণ করেছিল। বলেছিল, ‘আমি থাকতে তুই কেন এত খাটবি? তোদের সংসারে যাতে কোন অভাব না থাকে সে আমি দেখব। তুই আমার কাছে আসবি, যাবি, আমার ঘরদোর নিজের মতো করে দেখাশুনো করবি, আমার সাথী তুই। তোকে আর বীনস তুলতে যেতে দেব না আমি!’ বিদ্যা এই কথা শুনে খুশিই হয়েছিল প্রথমে। ওর বুকের কাছে এসে আহ্লাদ দেখিয়ে বলেছিল, ‘শোন গো মালিক! আমরা হলাম গায়ে গতরে খেটে খাওয়া মানুষ। কাজ না করলে আমাদের শরীর খারাপ হয়, মনে ফুর্তি থাকে না। আর কাজ না করে বসে বসে তোমার থেকে পয়সা নিলে লোকে আমাকে রাণ্ডী বলবে যে! তোমার সঙ্গে আমার অন্য সম্পর্ক, তাও তো তুমি আমায় দুহাত ভরে দাও, আমার সংসারে কোন অভাব রাখনি, আমার মরদকে ডাক্তার দেখিয়ে, মাসাজের লোক আনিয়ে সুস্থ করে তুলছ ধীরে ধীরে। বদলে আমি আর কতটুকু দিতে পারি তোমায় বল? তোমার ঘরে আর কতটুকুই কাজ থাকে! আর যদি বল শরীরের কথা। তবে সে সুখ তো আমরা দুজনেই পাই সমানে সমানে। তাহলে? তাহলে আর তুমি কোনদিনও কাজ ছাড়ার কথা বলবে না। আমি খুব সুখী তোমাকে পেয়ে।‘ এই একবারই বিদ্যার চোখে জল দেখেছিল মুরুগান। বুঝেছিল ওর আত্মসম্মানে লেগেছে। এরপর থেকে আর কখনও কাজ ছাড়ার কথা ওকে বলেনি মুরুগান।
বিদ্যার কথা ভাবলে খুব অবাক হয় মুরুগান। সমাজের একদম নিচুতলার বাসিন্দা হয়েও একটি প্রায় নিরক্ষর মেয়ের এতখানি আত্মশক্তি, এতখানি তেজ, বিপুল পরিমাণ ঔদার্য যে ও কীভাবে অর্জন করল, ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য লাগে। মাঝেমাঝে মুরুগানের নিজেকে বিদ্যার কাছে খুব তুচ্ছ, ক্ষুদ্র একটা মানুষ বলে মনে হয়। এককথায় বিদ্যার কাছে ও নিশ্চিন্তে আত্মসমর্পন করতে পেরেছে। যা কিনা ওর বউয়ের কাছেও পারেনি কোনদিন। সুশীলাকে বিয়ে করেছিল ও হুট করেই। বিয়ের পর সুন্দরী স্ত্রীকে পেয়ে প্রাথমিক ভাবে বেশ খুশিই ছিল মুরুগান। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই রূপের মোহ কেটে গেলে সুশিলার প্রতি ওর কোন আকর্ষণ অনুভূত হত না। নিজের কাজের ব্যস্ততায় সময় কেটে যেত। সুশীলাকে সেভাবে মনে রাখার মতো কোন সময় মুরুগান কোনদিন দিতে পারেনি। এমনকি সুশীলার জন্য মনের কোণে কোন আলাদা অনুভূতিও ওর তৈরি হয়নি। রূপসী সুশীলা অভাবী ঘর থেকে এসে স্বামীর স্বাচ্ছল্যের সংসারে কিন্তু সুখেই ছিল মোটের ওপর। মুরুগান যে একটু সৃষ্টিছাড়া ধরণের মানুষ, সে তো সে আগেই শুনেছিল লোকমুখে। ফলে ওর বাউণ্ডুলেপনায় সুশীলা খুব একটা বিরক্ত হত না। এখন ভাবলে একটাই আফসোস হয় মুরুগানের। সুশীলা বিয়ের কয়েক মাস পরেই সন্তানের আবদার করেছিল। ওর দিক থেকেও আপত্তি করার কিছু ছিল না। তবু সন্তান আসেনি সুশীলার। বদলে একদিন তুমুল জ্বর এল তার। আর তিনদিনের মাথায় সুশীলা কাউকে কিছু বুঝে উঠতে দেওয়ার আগেই চলে গেল। সুশীলার মৃত্যুতে মুরুগান আহত হয়েছিল ঠিকই। প্রথম প্রথম বাড়িঘর খুব ফাঁকা লাগত। সারাদিনই বাড়ির বাইরে কাটানোর অভ্যেস সেই থেকে শুরু হয়েছিল ওর। আর এলাচ গাছের প্রেমে পড়াও সেই থেকে। সুশীলা সে অর্থে সময় পায়নি মা হওয়ার। আর বিদ্যাকে যখন পেল মুরুগান, ওর মুখেই শুনেছিল—বিদ্যা তিন তিনটি মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছিল। ফলে মুরুগানের জীবনে তাকে বাবা ডাকার মতো কেউ নেই। এত এত শিশু জন্মাচ্ছে চারিদিকে আর ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো কোন শিশু এল না। অকালমৃত সুশীলা আর মৃতবৎসা বিদ্যাবতী, এই দুই নারীকে পাওয়া বা না পাওয়ার তৃপ্তির মধ্যে একটা অতৃপ্তি মুরুগানের রয়ে গেছে। বয়স হচ্ছে বলেই বোধহয় ওর এখন মনে হয়, মৃত্যুর পরে এত সম্পত্তি, অর্থ কার ভোগে লাগবে?
চার্চে দিয়ে যাবে ওর স্থাবর, অস্থাবর, সবকিছু? কিন্তু মন সায় দেয় না। যে চার্চ ওকে টানলোই না, সেখানে দেওয়ার চেয়ে কোন চ্যারিটেবল ট্রাস্টকে বরং দিয়ে যাওয়া ভাল। ওর উকিলের সঙ্গে আলোচনা সেরে ফেলতে হবে এ ব্যাপারে। মানুষের কথা কিছুই বলা যায় না—আজ আছে কাল নেই! সুশীলাই তো মুরুগানের জীবনে এর জ্বলন্ত উদাহরণ। নির্ঘুম রাতে কুকুর সহ পাহাড়ের আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মুরুগান এই সমস্ত রাজ্যের কথা ভাবতে থাকে। কখনও বা গলা ছেড়ে গান গায়। দূরের জঙ্গল থেকে হিংস্র জানোয়ারগুলোও বুঝে যায়, তাদেরই মতো এক রাতচরা মানুষ এখানে ঘুরছে। জানোয়ারগুলোও যেন মুরুগানকে এড়িয়ে চলে। ওকে আক্রমণ করে কোন লাভ নেই, সে ওরা নিজেদের সহজাত ক্ষমতায় বুঝে গেছে। তবে গোখরোগুলো কিন্তু অত বুঝদার নয়। বিশেষ করে, এলাচ, লবঙ্গের গন্ধে, কফি’র গন্ধে ওরা আকর্ষিত হয়ে কফি গাছের গোড়ায় গোড়ায় লুকিয়ে থাকে। এরা যেন কফিগাছগুলোকে শুষে খেয়ে নেবে বলে আসে। তাই যখন যেখানেই দেখুক, মুরুগান গোখরো নিকেশ না করে ছাড়ে না। কুকুরের সহজাত প্রবণতাই হল সাপ দেখে উত্তেজিত হওয়া, হিংস্র হয়ে ওঠা। মুরুগানের কুকুরগুলো যেন আরও বেশি করে সাপ বিদ্বেষী। ফলে আজ পর্যন্ত কত, কত গোখরো যে খতম হয়েছে ওদের হাতে, তার ইয়ত্বা নেই। গোখরোদের গায়ের গন্ধ পর্যন্ত চেনা হয়ে গেছে মুরুগানের। কুকুরগুলোর মতোই ও ওদের অস্তিত্ব টের পায় দূর থেকে। আর লোম খাড়া হয়ে ওঠে গায়ের। হিংস্র একটা শ্বাপদ ওর ভেতর থেকে দাঁত, নখ বের করে সাপগুলোকে শেষ না করা পর্যন্ত শান্তি পায় না। একেক সময়ে মুরুগান ভাবে, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে, তাহলে ইশ্বর নিশ্চিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য ওকে পরের জন্মে গোখরো জন্ম দেবেন।
এই মালভূমি অঞ্চলের বিশেষত্ব এই যে, এখানের মাটি হল ভলক্যানিক রেড আর্থ বা লাল ল্যাটারাইট সয়েল। যা কিনা কফি চাষের পক্ষে বিশেষ সহায়ক। এই মাটির জলধারণ ক্ষমতা কম, আর তাই প্রচুর বৃষ্টিপাতেও জল জমে না মাটিতে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জল নেচে নেচে গড়িয়ে যায়। মাটি যেন বলে—জলে নামব, তবু বেণী ভিজাব না! গ্রীষ্মে শুকিয়ে শক্ত আর ঝুরঝুরে হয়ে ওঠে এই মাটি। এই এখন যেমন হয়ে আছে তার দশা। এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে উড়িয়ে দিল মুরুগান। বৃষ্টি, বৃষ্টি…ওর খুব বৃষ্টি চাই এবার। টানা একমাস ধরে বৃষ্টি চাই। একমাস সে বাড়ির ভেতরে থাকবে এবার। খাবে দাবে আর ঘুমোবে। আজকাল ক্লান্তি লাগে খুব ওর। হাই তোলে ঘন ঘন, অথচ ঘুম আসে না। আকাশে পাতলা, পাতলা বর্ষার মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। ওরা এখনও বালিকা। শরীরে যৌবনের মেদ লাগেনি ওদের। ভরভরন্ত আর পুরুষ্টু হয়ে ওরা ঝরিয়ে দেবে ওদের রতিরস এই মাটির ওপর কিছুদিন বাদেই। ততদিন মুরুগানের অপেক্ষা…

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।