• Uncategorized
  • 0

‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ১ ।। খন্ড – ৫)

কফি পাহাড়ের রাজা

প্রথম পর্ব:

৫)

এবারে কেন জানি না বর্ষা আসতে এত দেরি করছে। বর্ষার আর কী দোষ! মানুষই তো গাছ কেটে কেটে আজ প্রকৃতির সর্বনাশ ডেকে এনেছে। যদিও এখনও এই পাহাড়ে জঙ্গল প্রচুর। কিন্তু আজ থেকে কুড়ি বা দশ বছর আগেও যেমন ঘন জঙ্গল ছিল, এখন সেই তুলনায় অনেক কমে গেছে। মানুষ একের পর এক বসতি বানিয়ে চলেছে। আর মুরুগানও কি কম দায়ী? হয়ত এই কফি চাষের জন্য অনেক শেড ট্রি লাগিয়ে রেখেছে ও, কিন্তু যত ওর চাষের এলাকা বেড়েছে, সেই পরিমাণে কুলি, কামীনদের সংখ্যাও বেড়েছে। আর তারা থাকবে কোথায়? এই পাহাড়েই তো! ফলে জঙ্গল ক্রমশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। কমছে জংলি জানোয়ারের সংখ্যাও। আর শুধু এই গরীব মানুষগুলোকে দায়ী করে কী লাভ? একের পর এক পোচাররা এসে বড় বড় বৃক্ষ, জানোয়ার মেরে পয়সা লুটেছে, তারাই তো সবথেকে বড় ক্রিমিনাল। খেটে খাওয়া মানুষগুলো অন্তত শুধু লোভের বশে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে না, ওরা প্রকৃতিরই অঙ্গ, তাই তাকে যত্ন করতেও জানে। এই পোচারদের মতো নিষ্ঠুর জাতি মুরুগান জীবনে দেখেনি। এদের পাল্লায় পড়েই তো আজ তাকে এই কাঠের পা বহন করতে হচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস খেলে গেল মুরুগানের আশপাশে। সেই সব ভয়ানক দিন মনে আনতে চায় না ও, কিন্তু অতর্কিতে কখনও কখনও সেই সময় এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর টুঁটি টিপে ধরে। এর চেয়ে ভাল হত, সে যাত্রায় যদি মুরুগান মরে যেত। তার বাঁচা না বাঁচায় এই পৃথিবীর কারুর কিছু যায় আসে না। এক ওই বিদ্যা…তবে সে খুব শক্ত মেয়ে। সামলে নিত ঠিকই।
কাঠের পা’টায় পরম মমতায় হাত বুলোল কিছুক্ষণ ও। এ যেন এখন ওর শরীরেরই প্রকৃত অঙ্গ হয়ে গেছে। অনুভূতি সম্পন্ন হয়ে উঠেছে ক্রমশ। মুরুগানের মাঝেমাঝে মনে হয়, এই কাঠের পায়ের ভেতরেও বোধকরি শিরা, ধমনী, স্নায়ুতন্ত্র তৈরি হয়ে গেছে। এই যে হাত বুলিয়ে দিল ও, পা যেন ঠিক টের পেল। পোকামাকড় কামড়ালেও টের পায়। মুরুগানের স্থির বিশ্বাস, এই পায়ের সঙ্গে ওর শরীর আর মনের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ তৈরি হয়েছে। মনগড়া কোন কল্পনা নয়, এ আর পাঁচটা বাস্তবের মতোই আজ মুরুগানের কাছে সত্য। এই সমস্ত মনগড়া কল্পনাকে মুরুগান বরাবর সত্যি বলে ভাবে, বাস্তব বলে মানে। আর হয়ত এই কারণেই ওকে লোকে কিছুটা ক্ষ্যাপাটে বা আধপাগলা বলে আড়ালে। সে বলে বলুক। মুরুগান এসবকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। ব্যক্তিগত জীবনটাকে একটা ছন্নছাড়া খেলার মতো করে কাটিয়ে দিল তো এভাবেই! আর হয়ত মেরেকেটে পাঁচ, দশ বছর। তারপর তো মুরুগানের খেলা শেষ! এই কফিবাগান, এই ঘ্রাণের মোহক, এই প্রিয়তমা এলাচ গাছকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবলে ওর মনেও যেন একটু টান ধরে। কোন ব্যক্তির সঙ্গে যে টান ও আজ পর্যন্ত অনুভব করতে পারল না। জীবনের টুকরোগুলোকে নয়, সমগ্র জীবনটা কিন্তু ওকে টানে। থাক, যাওয়ার কথা থাক আপাতত। স্মৃতির পাতা থেকে ওর রক্তমাংস’র পা’টা আজ চোখের সামনে এসে বসছে কেন কে জানে।
শ্রীনিবাসনের সঙ্গে মুরুগানের পরিচয় কফি বিক্রিকে কেন্দ্র করেই। কোন এক পার্টির সঙ্গে ও এসেছিল। তারপর আলাপের পর চেনাপরিচিতির গণ্ডি পেরিয়ে শ্রীনিবাসন ক্রমশ বন্ধুর জায়গা নিয়ে নেয়। সপ্তাহে একদিন ও আসবেই আসবে মুরুগানের কাছে। সেই সন্ধেবেলা তাদের খানাপিনা জমত খুব। সে’রাতে মুরুগানের পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবার ক্ষমতা থাকত না। যতক্ষণ না ওরা বেহেড মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ত, ওদের পানভোজন থামত না। কুগানও এসে যোগ দিত। এমনকি কুগানের সঙ্গেই যেন শ্রীনিবাসনের দোস্তি বেশি জমে গেছিল। মুরুগানের আড়ালে দুজনে খুব ফুসুর ফুসুর করত। ওকে দেখলেই অন্য প্রসঙ্গে এসে যেত। প্রথমে অতটা পাত্তা দেয়নি মুরুগান। ভেবেছিল, কোন মহিলা ঘটিত গল্প হয়ত। মুরুগান বিশ্বাস করেছিল শ্রীনিবাসনকে। ভেবেছিল, তার এই একা জীবনে এতদিনে একজন বন্ধুর দেখা পেল সে অন্তত। দুজনের মনের কথা দুজনের কাছে প্রকাশ পেতে সময় লাগল না এরপর। তবে মুরুগান যেন এতদিনের খরার পর একবিন্দু জলের দেখা পেয়ে সমুদ্র ভ্রম করেছিল। শ্রীনিবাসনকে ততটা খোলাখুলিভাবে নিজের কথা বলতে দেখা যায়নি, যতটা মুরুগান আলগা হয়েছিল। চাষের কথা, তার প্রভূত টাকাকড়ি নিয়ে সে কী করবে, সেই ভাবনার কথা, এছাড়া স্মৃতিকথা তো ছিলই—সব উগড়ে দিত মুরুগান শ্রীনিবাসনের কাছে। কুগানের সঙ্গে ফুসুর ফুসুর বাড়ছিলই ক্রমশ। একদিন মুরুগান খুব বিরক্ত হয়ে ওদের সামনেই মেজাজ দেখাল। কুগানের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে জানতে চাইল, ‘তোদের কী এত গোপন কথা আছে যে, আমার কাছ থেকে সেসব লুকোতে হচ্ছে? কুগান, তুই তো ব্যাটা হাড়হদ্দ হারামি, সারাদিন বাড়িতে পড়ে পড়ে খাসদাস আর ঘুমোস। তোর তো বাইরের লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাতও নেই বলতে গেলে। তোর আবার কী এত গোপন কথা তৈরি হল যে আমাকে আড়াল করতে হচ্ছে?’ কুগান মুরুগানের এই চেহারা দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছে বোঝা যাচ্ছিল। থতমত খেয়ে কিছু বলতে না পেরে মুখ নিচু করে বসে রইল। মুরুগান এবার শ্রীনিবাসনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। শ্রীনিবাসন প্রথমেই এসে মুরুগানকে জড়িয়ে ধরল। স্পর্শ এমন এক জিনিস, যে প্রিয় মানুষের স্পর্শ হলে তা সংক্রামিত হতে বাধ্য। আর অপ্রিয় মানুষের হলে তা হয়ে উঠত বিরক্তিকর। ফলে মুরুগানের রাগ ঠাণ্ডা হয়ে এল। বন্ধুকে সরিয়ে একটু যেন অভিমানের স্বরে বলল, ‘নিজেদের মধ্যে এত আড়াল, আবডাল আমার পছন্দ হয় না রে শ্রীনি! দূরত্বই যদি রাখার হত, তাহলে তুই আজ আমার বাড়িতে প্রতি সপ্তাহে আসতে পারতিস না। আমি খুব সহজে কাউকে আপন করে নিতে পারি না, আবার আপন করে নিলে এমনভাবেই তাকে গ্রহণ করি, যেন সে আমার নিজেরই সত্তা। এ নিশ্চই তুই এতদিনে বুঝতে পেরেছিস!’
শ্রীনিবাসন মুরুগানকে হাত ধরে টেনে ঘরের বাইরে আনল। তারপর বলল, ‘শোন, আমি তোকে কিছু কথা লুকিয়েছি। কুগানকে এ জন্য তুই কিছু বলিস না প্লিজ! ওকে আমিই বলতে বারণ করেছিলাম’। ‘কিন্তু লুকোতে হল কেন বন্ধু? আর কুগান কী ছেলে তুই এতদিনেও জানলি না? ওর নিজের মতি ঠিক নেই, নেশা করে করে ওর সমস্ত বুদ্ধি, শক্তি, বোধ লোপ পেয়ে গেছে এতদিনে। ওকে কেন টানলি তুই? আর কী এমন কাজ যে আমাকে লুকিয়ে করতে হল তোদের?’ শ্রীনিবাসন এবার ওকে মিনতি করল। ‘প্লিজ, আগে তুই শোন মন দিয়ে আমার কথাগুলো। তারপরে তোর বক্তব্য জানাস।‘ এরপর শ্রীনিবাসন যা বলল, শুনে মুরুগানের চোখ কপালে উঠেছে। এই জঙ্গলে তখন প্রচুর গাছ। আর এত দামী দামী গাছ দেখে শ্রীনি আর লোভ সামলাতে পারেনি। ওর সঙ্গে কাঠচেরাই কলের মালিকের একটা পার্টনারশিপ আছে। ফলে নিজের মুনাফার লোভে ও কুগানকে এই কাজে লাগিয়েছিল। শ্রীনি’র অবশ্য ‘জ্যান্ত’ গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার কোনরকম পরিকল্পনা ছিল না। ওর টার্গেট ছিল যত বৃদ্ধ আর মৃতপ্রায় গাছেরা। এই সমস্ত গাছগুলো শনাক্ত করতে ও কুগানকে কাজে লাগিয়েছিল। মুরুগান যখন খেতের কাজে ব্যস্ত থাকত, তখন কুগান ঘুরে ঘুরে গাছ জোগাড় করত। আর সেগুলো গোপনে কেটে নিয়ে যেত শ্রীনি’র লোকজন। এই গাছ কাটার কাজটা হত একদম কাকভোরে। যখন কিনা মুরুগান গভীর ঘুমের দেশে থাকে স্বাভাবিক ভাবে। কিন্তু কুগানের টাকাপয়সারই বা প্রয়োজন হল কেন, সেটা মুরুগান বুঝে উঠতে পারল না। আর যেহেতু কুগান, অর্থাৎ মালিকের লোক গাছ কাটাচ্ছে, তাই অন্যরাও কেউ কিছু মুরুগানকে এ প্রসঙ্গে কোন কিছু জিজ্ঞেস করেনি। রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে উঠল মুরুগানের। প্রথমেই কুগানের গালে ঠাস করে এক চড় বসাল। সে বেচারা তো হতভম্ব হয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী! ওর চুলের মুঠি ধরে ওর মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে মুরুগান ওকে বলছে ‘বল, বল! নেশার খোরাকী হিসেবে তোর আর কত পয়সা চাই? তোকে ওদের হাতে মরতে দেওয়াই উচিত ছিল। তুই আজ আমারই খেয়ে, আমারই পরে অন্য লোকের কথায় গাছ বিক্রি করছিস!!’ কুগান হাউমাউ করে কেঁদে উঠে এবার মুরুগানের পায়ে ধরল। ‘এবারের মতো তুমি মাফ করে দাও। বিশ্বাস কর, আমি ভেবেছিলাম, এইভাবে কিছু টাকা নিজে একা একা উপার্জন করব আর সেটা দেখিয়ে তোমাকে তাক লাগিয়ে দেব। বিশ্বাস কর তুমি! আমার ভুল হয়ে গেছে। এবারের মতো আমাকে ক্ষমা কর। এ ভুল আর হবে না। প্লিজ আমাকে তাড়িয়ে দিও না।‘ মুরুগান এবার যেন একটু ঠান্ডা হল। কুগানকে বসিয়ে দিল তুলে। তারপর শ্রীনিবাসনকে বলল, ‘আজ থেকে তুই আর এখানে আসবি না। তুই গাছের গায়ে হাত দিয়েছিস। আমার প্রাণ ওরা। ওদের কেটে ফেলা মানে আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিস। তাও পুরোটাই করেছিস গোপনে। আর একটা নেশাড়ুকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওই পথে নিয়ে গেছিস। আমি তোকে কোনদিন ক্ষমা করব না। চলে যা, তুই এখান থেকে!’
শ্রীনিবাসন জানত, এই কাজ গোপন থাকবে না চিরদিন। একদিন না একদিন মুরুগান জানতে পারবেই। আর এও ভেবে রেখেছিল, জানার পরে মুরুগানকে বুঝিয়ে বাঝিয়ে ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। কিন্তু ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে নেমে আসবে, এ ওর কল্পনাতেও ছিল না। শ্রীনিবাসন অনেকবার ক্ষমা চাইল, অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করল মুরুগানকে। কিন্তু ও কোন কথাই শুনতে রাজি হল না। সেদিনের মতো চলে গেল ও। যেতে যেতে ভাবল, দিন সাতেক পরে দামী একটা মদ কিনে এনে মুরুগানকে ঠিক শান্ত করে ফেলবে। কিন্তু ও মুরুগানের নরম দিকটাই শুধু দেখেছিল। ওর একগুঁয়ে, জেদি, রাগী রূপটা ছিল ওর কাছে একেবারেই অপরিচিত। তাই সাতদিন বাদে যখন মুরুগানের ঘরে ও ঢোকার চেষ্টা করেছিল, একটা পিস্তলের ঠাণ্ডা নল ওর কানের ওপর চেপে ধরে মুরুগান শুধু হিসহিসে একটা শব্দ করেছিল মাত্র। অপমানিত শ্রীনিবাসন ফিরে যেতে যেতে প্রতিজ্ঞা করেছিল এর শোধ ও নেবেই। রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে, আশেপাশের জঙ্গল থেকে জ্বলজ্বলে জোড়ায় জোড়ায় চোখ ওকে দেখছিল ঝোপের আড়াল থেকে। ওরা জানত না, শ্রীনি’র চোখদুটোও ঠিক অমন ভাবেই জ্বলছে তখন।

ক্রমশ….

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।