‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ৩ ।। খন্ড – ৫)

কফি পাহাড়ের রাজা

তৃতীয় পর্ব:

৫)

পরদিন থেকে মুরুগান আর বিদ্যা একসঙ্গে চলল বাগানে। যদিও বিদ্যা যেতে চায়নি প্রথমটায়। কিন্তু মুরুগান গোঁ ধরল, বিদ্যা না গেলে ও যাবে না। অগত্যা বিদ্যাকেও যেতে হল। একটু লজ্জা লজ্জা যে লাগছিল না ওর, তাও না। আবার আনন্দও হচ্ছিল খুব। এতদিন বাদে, প্রায় যেন এক যুগ পরে তারা একসঙ্গে কোথাও বেরোল। একসঙ্গে বাগানের কাজ করবে দুজনে—এও আগে কখনও হয়নি। তবে বিদ্যার কিছুটা হলেও চাপ কমল। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে ও রোজ। মুরুগান বাগানের দিকটা দেখলে সে বাকিটুকু সুন্দরভাবে সামলে নিতে পারবে। মুরুগান বাগানে পা দিয়েই হইহই করে উঠল। লোকজন সবাই মুরুগানকে দেখে হাত নেড়ে স্বাগত জানাল। ধীরে ধীরে মুরুগান আর তার কফি বাগান স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এলো। উপরন্তু বিদ্যার কড়া নজরদারিতে কোন কর্মী বা কুলির ফাঁকি দেওয়ারও উপায় রইল না। চারাগাছগুলো বড় হচ্ছিল লকলক করে। তাদের প্রথম থেকে কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে এবার। ওষুধ, সার, ইত্যাদিতে কোনরকম ঘাটতি নেই। হঠাৎ করে কেউ দেখলে ভাববে, এই প্রথম বুঝি কফি চাষ করছে এরা। এরকম একটা আশার আলো মাখা সময় ফিরে এসেছে ওদের কাছে যে, ওরা দূর আকাশের কোণে লুকিয়ে থাকা ধূসর মেঘের টুকরোকে দেখতে পায়নি। ধূসর রঙে কালির পোঁছ পড়ছে এদিকে পরতে পরতে। ওদিকে তারা নতুন কাজের উদ্যমে কাজ নিয়েই মশগুল রয়েছে। এখন পর্যন্ত যা হিসেব, ধারকর্য মিটে যাবে এবারের ফলনেই। পরবর্তী ফলনের ভাবনাও শুরু করেছে ওরা।

এইরকম একদিনে বিদ্যার সঙ্গে একজন দেখা করতে এলো। একটি কোম্পানির ভিজিটিং কার্ড দেখিয়ে সে প্রস্তাব দিল, তারা, অর্থাৎ তাদের কোম্পানি এই বাগানের সমস্ত মাল কিনে নিতে ইচ্ছুক। মার্কেটিং-এর দিকটা তাদের দায়। দরপত্র নিয়ে আলোচনার জন্য একদিন সময় চাইল। বাড়িতে এসে মুরুগানের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনায় বসল বিদ্যা। মুরুগান এককথায় ওদের তাড়িয়ে দিতে বলল। যেহেতু ওদের বাগানের মাল এতদিন যেভাবে বিক্রি হয়েছে মহাজনদের হাতে, সেভাবেই চলুক, এটাই ওর ইচ্ছে। নতুন পার্টিকে এনে পুরনোদের বিরাগভাজন হয়ে কী লাভ? বিদ্যা এবার বোঝাতে বসল মুরুগানকে। ‘শোন তাহলে! এরা যে দর দিচ্ছে বা দেবে বলছে, দরদাম করলে আমরা আরও একটু বেশিই দাম আদায় করতে পারব এদের থেকে। উপরন্তু সমস্ত মাল এরা একথোকে নিয়ে নেবে। তার ফলে পরবর্তী কালে আমাদের কোনও চাপ থাকবে না। তুমি কি চাও না, আমাদের আরও উন্নতি হোক?’ মুরুগান শুনল মন দিয়ে। ভাবল কিছুক্ষণ। কুগান তো বিদ্যার দলের লোক। তাই দুজনের দিকে তাকিয়ে স্পষ্টভাবে নিজের মতামত দিল। ‘তোমাদের যদি এই পার্টিকে মাল দিয়ে দিতে মন চায়, দিতেই পার। হয়ত একথোকে সমস্ত মাল বেরিয়ে গেলে, পুরো টাকা একবারে পেয়ে গেলে, আমাদের লোন মিটে পরের ফলনের জন্য কিছু টাকা বেঁচে যাবে। এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা তোমাদের থেকে অনেকটা বেশি, এটা মানবে তো? তাই এর বিপরীত দিকটাও ভেবে দেখেছি আমি’।

বিদ্যা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘যেমন, যেমন?’

‘এমন অনেক কিছু হতে পারে। হয়ত ওই পার্টি আমাদের মালের সঙ্গে সস্তা কোয়ালিটির কিছু মাল মিশিয়ে চড়া দামে বিক্রি করতে লাগল। এদিকে মালের গায়ে আমাদের কোম্পানির নাম লেখা রইল। তাতে কি আমাদের বাগানের বদনাম হবে না? একবার যদি বদনাম হয়ে যায়, এই লাইনে আমাদের কফি কিনবে না আর কেউ। আমাদের বাগানের যেটুকু বদনাম হয়েছে, সেটা ফলনের ঘাটতির জন্য। সময় মতো মাল পৌঁছে দিতে না পারার জন্য। কিন্তু মানের ক্ষেত্রে আমরা কখনও জল মেশাইনি। ফলে বাজারে আমাদের বাগানের নাম দেখলে কফি প্রেমীদের একটা ভরসা থাকে। কিন্তু সেই সুনাম একবার চলে গেলে আমাদের আর মাথা তুলে দাঁড়াতে হবে না, জেনে রেখ’। এই পর্যন্ত বলে মুরুগান একটু দম নিল। বিদ্যাও এর বিরুদ্ধে কোন যুক্তি দিতে পারল না। হাজার হোক, বাস্তব জ্ঞান তারও কিছু কম হয়নি। তবুও বিদ্যা জিজ্ঞেস করল, ‘আর কী কী বিপদ আসতে পারে বলে মনে হয় তোমার?’

‘বিপদ কখনও বলে আসে রে বিদ্যা? যেমন এও হতে পারে, ওরা পেমেন্ট নিয়ে এমন ভোগাতে শুরু করল যে আমাদের লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেয়ে চলে গেল ততদিনে। উল্টে ব্যাঙ্ক লোন সময় মতো না দিতে পেরে সুদ বাড়তেই থাকল। এছাড়া এমনও হতে পারে, ওরা খারাপ মানের কফি আমাদের বাগানের নামে বাজারে ছেড়ে দিল। তারপর সমস্ত মাল ফিরিয়ে দিল ডিলাররা। তখন কিন্তু আমাদের কাছেই ফিরিয়ে দেবে সবটা। তুই, আমি, কুগান বা রাও এর কোন সুরাহা করতে পারবে কি? তোর জানা আছে এই সব বিপদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়?’ মুরুগানের মেজাজ চড়ছিল, সঙ্গে গলাও। বিদ্যাও সঠিক উত্তর খুঁজে না পেয়ে রেগে গেল। তার কেমন জেদ চেপে গেল। মনে হল—ওর বুদ্ধি, চিন্তা, পরিকল্পনাকে মুরুগান খাটো করছে অকারণে। স্রেফ অহং-এর বশে সে মেয়ে বলে, ওকে যেনতেনপ্রকারেণ ছোট করতে চাইছে। এতদিন সে একা লড়াই করে যাচ্ছিল, কই তখন তো মুরুগান একবারও বুদ্ধি দিতে আসেনি! এখন যেই একটা সুন্দর পরিকল্পনা করে ও এগোতে চাইছে, তখনই এসে বিরুদ্ধ মতামত দিয়ে ওকে দমিয়ে দিতে চাইছে। আসলে মালিক তো! যতই হোক, সে তো এই বাগানের মালিকানার অংশীদার নয়, কর্মী মাত্র। তাই তার মতামত কোনদিনও গ্রাহ্য হবে না। রাগে, ক্ষোভে গলা চড়িয়ে বিদ্যাও বলল, ‘ঠিক আছে। এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই আর। তুমি এ বাগানের মালিক, তোমার কথাই মানতে হবে। ওদের আমি ‘না’ করে দেব’। আগুন চোখে তাকাল মুরুগান বিদ্যার দিকে। তারপর ওর হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এল আলমারির সামনে। তাক থেকে একতাড়া কাগজ নামাল ফাইল ঘেঁটে। কুগানকেও ডেকে নিল। তারপর কুগানকে বলল কাগজটা জোরে জোরে পড়ে শোনাতে। বিদ্যা মুরুগানের রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেছে এবার। রাগে মানুষটা থরথর করে কাঁপছে। ‘তুমি আগে শান্ত হয়ে বস একটু। তারপর নাহয় কুগান কাগজটা পড়বে। আমার কথা শোন লক্ষ্মীটি…’ মুরুগান বিদ্যার কথায় কান না দিয়ে কুগানকে ধমক দিয়ে উঠল। ভয়ে কুগান হুড়হুড় করে পড়তে থাকল কাগজটার শেষ পর্যন্ত। মোদ্দা কথা এটাই লেখা ছিল ওখানে—এই বাড়ি আর কফি বাগানের মালিক এখন বিদ্যা আর কুগান। দুজনেই অর্ধেক অর্ধেক অংশের মালিক তারা। বিদ্যার পরে কুগান সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। এই সম্পত্তিতে মুরুগানের এক অংশও নেই। মুরুগানের স্বেচ্ছায় তার চাহিদা অনুযায়ী, কিছু টাকাপয়সা খরচ করতে পারবে, এইমাত্র। মুরুগানের এই উইল পড়ে ও শুনে কুগান আর বিদ্যা দুজনেই স্তম্ভিতের মতো বসে রইল। আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুরুগান অনেকদিন বাদে তার কুকুরদের নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল। বিদ্যা ওকে পিছু ডাকল না। ও জানে, লোকটাকে হাজার ডাকলেও এখন ফিরবে না। তার চেয়ে রাগ কমুক ওর। ভোররাতে ফিরবে সে। কাল এ নিয়ে কথা বলবে বিদ্যা মুরুগানের সঙ্গে। আজ সে এখানেই রাতটা কাটিয়ে দেবে নাহয়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।