‘কফি পাহাড়ের রাজা’ সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে তুষ্টি ভট্টাচার্য (পর্ব – ৩ ।। খন্ড – ২)

কফি পাহাড়ের রাজা

তৃতীয় পর্ব:

২)

কুগান বসে বসে কাঁচাবাদাম সিদ্ধর চাট খাচ্ছিল। বিদ্যাকে ওর ঘরে আসতে দেখে আগের মতো ইয়ার্কি করে বলল, ‘আরে, নতুন কাকিমা যে! এস, এস। বাদাম খাবে?’ বিদ্যা কপট রাগে চোখ পাকাল। তারপর গুছিয়ে বসল খাটের একধারে। ঘরে স্বভাববশত চোখ বুলিয়ে দেখে নিল—কোথাও কিছু আগোছালো হয়ে রয়েছে কিনা। কুগান বেশ খোশ মেজাজেই আছে। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কুগানকে যারা দেখেছে, এখনকার কুগানের সঙ্গে তারা ওকে মেলাতে পারবে না। অনেকটাই স্বাভাবিক দেখায় ওকে। চোখেমুখেও নেশাড়ুর আচ্ছন্নতা নেই তেমন। কাজেকম্মেও নিজেকে ব্যস্ত করেছে কিছুটা। মোটের ওপর ও নিজের মতো একরকম ঠিকই আছে। পুরনো শোকতাপ তার মন থেকে ধুয়েমুছে গেছে এখন। আপন মনে বাদাম চিবিয়ে যাচ্ছিল ও। যেন এই মুহূর্তে বাদাম চিবনোর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই। বিদ্যা অপেক্ষা করল ততক্ষণ। যদিও ওর নিজের মনেই যথেষ্ট সন্দেহ আছে এখনও, এই বাগানের কাজে কুগান কতটা সিরিয়াসলি মন দিতে পারবে বা দায়িত্ব নিতে পারবে। তবুও ওই একমাত্র অগতির গতি। বাদাম শেষ হলে বিদ্যা যতদূর সম্ভব গাম্ভীর্য এনে কুগানকে ডাকল। কুগান যেন চমকে উঠল প্রথমটায়। যেন ঘুম ভেঙে উঠে তাকাল বিদ্যার দিকে। তারপর বিদ্যার থমথমে মুখ দেখে সচকিত হয়ে তাকাল।
‘দেখ কুগান, তোমার কাকার মতিগতি ভাল ঠেকছে না আজকাল। বাগানের দিকে নজর দিচ্ছে না একদম। যে যা পারছে করছে। এদিকে বীনসের কোয়ালিটি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পোকা লাগছে। তোর কাকার কোনদিকেই যেন খেয়াল নেই। শুধু বলছে—কিছুই ভাল লাগছে না আর! চোখের সামনে এই সাজানো বাগান নষ্ট হতে আমি দেখতে পারছি না। সহ্য করতে পারছি না। তাই বলছি, মানুষটা যখন আর পারছে না বলছে, তুমিই তার একমাত্র উত্তরসূরি, তুমিই এবার বাগানের দায়িত্ব নাও’। কুগান আঁতকে উঠল শুনে। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর হাতজোড় করে বিদ্যাকে বলল, ‘তুমি অন্য যা বলবে, তাইই করব। শুধু দায়িত্বভার নিতে বল না। ও তুমিই নাও। আমি বরং তোমার পিছনে থাকব। তুমি যা বলবে করে দেব। এমনকি যদি বল, নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাদিন, সারারাত বাগানেই পড়ে থাকব। চাইলে নাহয় একফোঁটা মদও খাব না। শুধু আমায় দায়িত্ব নিতে বল না প্লিজ! ও আমার কর্ম নয়। তাছাড়া আমাকে কেউউ মানবে না, পাত্তা দেবে না। সব লাটে উঠে যাবে। তুমিই একমাত্র যে এই বাগান সামলাতে পারবে’।
কুগানের যুক্তি খারিজ করতে পারল না বিদ্যা। সে নিজেও কুগানের ব্যাপারে সংশয়ে ছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতেও তার মন সায় দিচ্ছিল না। মুরুগানের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এ নিয়ে। আলোচনা বলা ভুল, শুনিয়ে, জানিয়ে রাখতে হবে সবটা। হাজার হোক, তারই তো সম্পত্তি। বিদ্যা শুধু দেখভাল করতে পারে মাত্র। অবশ্য বিদ্যা আইনি মারপ্যাঁচে যাচ্ছে না। সে চায়, যেমন করে হোক, কফিবাগানটাকে উদ্ধার করতে। রাতে মুরুগানের ঘরে গেল বিদ্যা। সে তখন টিভি চালিয়ে দিয়ে টিভির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বসে আছে। আর মাঝেমাঝেই বিড়বিড় করে বকছে। এই রোগ তার বেড়েছে আজকাল। একটু বেশিই বেখেয়ালি হয়েও পড়েছে। তাই এখন মুরুগানকে সবসময়ে লক্ষ্য রাখার জন্য একজন লোক ঠিক করেছে বিদ্যা। সে কখন হুটহাট বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে, লোকটিও তার পিছুপিছু যায় আসে। যা শুনেছে ওর মুখে, মুরুগান আজকাল রাস্তায় ঘোরে বটে, তবে গানের বদলে ওই বিড়বিড় করে বেশিরভাগ সময়ে। এমনকি তার এলাচপ্রিয়ার সঙ্গেও ভাবসাব একটু কমেছে। মুরুগান এখন তার বাগানের সীমানা ছাড়িয়ে পাহাড়ের আরও একটু ওপরে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এটাই তার রোজকার রুটিন বলা চলে। সেখান থেকে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনমনে বকবক করে নয়ত নিচের ঢালের দিকে আঙুল দেখিয়ে কাকে যেন কীসব বলতে থাকে। মাঝেমাঝেই বিদ্যা ভাবে, একজন ডাক্তার দেখানো উচিত এবার মুরুগানকে। তার স্বাভাবিক দিলখোলা মেজাজটাও উধাও যেন আজকাল। অথচ তাকে অনেক জেরা করেছে বিদ্যা, কিছুই বলে না উত্তরে। তার দিকে চেয়ে থাকে আর মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আহ! বিদ্যা! আমাকে এবার একটু নিজের মতো থাকতে দে না! এটুকুও দিবি না আমায়?’ বাধ্য হয়ে বিদ্যাকে সরে আসতে হয়েছে। প্রথম প্রথম খুব অভিমান হত বিদ্যার। অনেকবার ভেবেছে, এখান থেকে চলে যাবে। আর আসবে না। তেমন যে করেনি, তাও নয়। দুদিন যায়নি ওখানে। চুপ করে নিজের ঘরে বসেছিল। দম বন্ধ হয়ে আসত তার। মুখ বুজে কান্না সামলেছে সেই দুদিন। এদিকে মুরুগান কিন্তু জাতে মাতাল, তালে ঠিকই আছে, দিব্যি বোঝা গেল। বিদ্যার ঘরের সামনে তৃতীয় দিনের ভোরবেলা এসে বসেছিল চুপ করে। ওকে ডাকেওনি। ঘুম থেকে উঠে বিদ্যা দেখে দাওয়ায় বসে আছে তার পাগল ভোলা! এই বয়সে আর কোন বাড়াবাড়ি রকমের আবেগের দৃশ্য তৈরি হয়নি যদিও সেসময়ে। কিন্তু বিদ্যা সেই থেকে আর মুরুগানকে ছেড়ে যাবে, ভুলেও ভাবে না।
মুরুগানকে ডেকে বিদ্যা বলল, ‘শোন, তুমি তো আর বাগানের দিকে মন দেবে না ঠিক করেছ। এদিকে ব্যবসা লাটে উঠেছে প্রায়। আমার চোখের সামনে এমনটা আমি হতে দিতে পারব না। যতদিন বেঁচে আছি, শেষ পর্যন্ত লড়াই করে যাব। কাল থেকে আমিই যাব তোমার কফিবাগানে। নিজেই একটু একটু করে বুঝে নেব সব। আবার আমাদের বাগান ফুলেফেঁপে উঠবে। আর হ্যাঁ, কুগানকেও সঙ্গে রাখব। ওকেই তো বুঝেসুঝে নিতে হবে সব। আমরা চোখ বুজলে যদি ও চালাতে পারে, চালাবে। কিন্তু বেঁচে থাকতে এই বাগান আমি নষ্ট হতে দেব না’। এই পর্যন্ত বলে বিদ্যা মুরুগানের দিকে তাকাল। ও যেন কিছুই শোনেনি এমন হাবভাব। চুপচাপ বসে রইল। খুব রাগ হল বিদ্যার। অনেকদিন বাদে এত রেগে গেল ও। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে আগুন চোখে চিৎকার করে বলে গেল, ‘আজ থেকে আর আমি এই ঘরে আসব না, কান খুলে শুনে নাও। তোমাকে বাগানের কোন কথাও বলব না। এ বাড়িতে না এলে পারব না, তাই আসব ঠিকই আগের মতো। নাও! এবার শান্তিতে নিজের মতো থাক। আমি চললাম’।
পরেরদিন বিদ্যা অনেকদিন বাদে কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরল। একটা হাল্কা রঙের সিল্কের শাড়ি, মানানসই ব্লাউজের সঙ্গে পরে বাড়ি থেকে বেরল কুগানকে সঙ্গে নিয়ে। নিজের মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছে ও। কপালে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মুরুগানের অফিসে ওর চেয়ারে নিয়ে গিয়ে বিদ্যাকে বসিয়ে দিল কুগান। মুরুগানের নিজস্ব সেক্রেটারি কাম ম্যানেজার, টি ভি রাওকে ডেকে নিয়ে এল কুগান। এই লোকটি খুব বিশ্বস্ত। আর অনেককাল ধরে মুরুগানের সঙ্গে রয়েছে। ফলে রাও সব ঘাঁতঘোত জানে এ লাইনের। বিদ্যা আর কুগানের প্রথম কাজ হল, এই লোকের কাছ থেকে সমস্ত অন্ধিসন্ধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নেওয়া। প্রায় দিন তিনচারেক চলল তাদের বৈঠক। অফিসের অন্যান্য স্টাফরাও যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বিদ্যার আসায়। এ কদিনে বিদ্যা এটুকু পরিষ্কার ভাবে বুঝেছে যে, এই বাগানকে আবার তার নিজস্ব পুরনো ফর্মে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। তবে এর জন্য অনেকটা সময় দিতে হবে। হয়ত বছর ঘুরে যাবে পূর্বের অবস্থা ফিরিয়ে আনতে। বাড়ি ঘুরে নিজের ঘরে ফেরে বিদ্যা। মুরুগানের খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো হচ্ছে কিনা খেয়াল করে। আড়াল থেকে ওর শরীর স্বাস্থ্য আর মেজাজমর্জির খবর নেয় নিঃশব্দে। কিন্তু ভুলেও মুরুগানের সামনে যায় না। একবার লোকটাকে দেখার জন্য বিদ্যার বুক ফেটে যায় মাঝেমাঝেই। কিন্তু ওর নিজস্ব কাঠিন্যের আবরণ দিয়ে সেই দুর্বলতা আড়াল করে রাখে। যেটুকু শুনেছে, মুরুগান আছে মুরুগানের মতোই। ভালো থাকলেই ভাল। তার আর কী! বিদ্যা তো আর কেউ নয় ওর।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।