• Uncategorized
  • 0

কবিতায় অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়

চক্রধরপুকুর

 

চক্রধরপুর নয়, চক্রধরপুকুরের কথা বলছি— আচার্য্য কি বিরক্ত কিছুটা?… সেই পুষ্করিণী, যার নাভি ও নেমিদেশ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকলে এ মার্গে না আসাই শ্রেয়। এ পর্যন্ত বলে আচার্য্য চোখ পিট পিট করেন। ওই ঘোলাটে চোখের অন্তরালে গুহাহিত অনিশ্চিত জলশৈলী ও তার ভৌমক্রীড়া এতদপূর্বে দেখেছি বলেই চুপ করে থাকি। … চক্রধরপুকুর, সে এক আশ্চর্য জলস্থলি। দিবাভাগে তার সর্বাঙ্গ পান্নাপ্রতিম স্তব্ধতা ও তার চতুস্পার্শ ডাহুকসুষমার দ্বারা অলঙ্কৃত। আর রাত্রে? প্রশ্ন উঠতেই আচার্য্য হাসলেন, যেন চক্রধরপুকুরের জলতলে একখানি জলমাকড়সা সরণ ঘটালো। … রাত্রে সে পুকুরের রূপ ও চরিত্র এক্কেবারেই আলাদা। রাত্রির নিকষবর্ণের সঙ্গে তখন জলতলের ভেদ দৃশ্যত লুপ্ত বলেই জলতল ও তার উপরিভাগের বায়ুমণ্ডলের পুরোটাকেই পুকুর বলে সাব্যস্ত করতে পারো। এমতাবস্থায় এক সর্বগ্রাসী নৈকষ্য তোমার নাভি ও নেমিজ্ঞান লুপ্ত করে ছাড়বে। এখন প্রশ্ন অবগাহনের। তুমি কাষায়বস্ত্র ও জবাফুলের মালা ধারণ করে বীজ সম্বল করে তিনখানি ডুব দিতে পারো। মাত্র তিনখানি। তার বেশি নয়। আর ওই তিনটি ডুবের মধ্যেই তোমাকে স্পর্শ করতে হবে পুকুরের নাভি, যেখানে অবস্থান করছেন এক অদৃশ্য মীন। সেই মীনের নেমিদেশ যদি এক বার স্পর্শ করতে পারো, তা হলেই ব্যস, আর কোনও চিন্তা নেই…

বিড়ম্বিত ভাবনা দেয়ালা পাকায় জঠরযন্ত্রে। কীসের চিন্তা? আচার্য্য কি অন্নবস্ত্রের কথা বলছেন? নাকি, তারও অতীত ভৌমরাগ, বিপ্রলব্ধ উচাটন অথবা সমগ্র জীবনব্যাপী কীর্ণ অপমান ও অপস্মৃতি থেকে মুক্তি অপেক্ষা করছে মাত্র তিন-ডুব দূরত্বে? আচার্য্য মাথার উপরে হাত রাখেন, যেন পূর্ব মেদিনীপুরের সুবিস্তীর্ণ মাঠের মাঝখানে পানের সবুজ বরজটির উপর ছায়া ফেলল পয়লা আষাঢ়ের কৃষ্ণমেঘ। মাইল মাইল ব্যাপী সবুজ। সন্ধ্যা নামছে ধীরে। সেই সবুজাভ পৃথিবীর উপর গাঢ় নীলাঞ্জনছায়া ক্রমেই ঢলে যাচ্ছে কৃষ্ণময় এক অস্তিত্বের দিকে। কাষায় বস্ত্র ও জবাপুষ্পে ভাঁড় সেজে চলেছি বীজমন্ত্র সম্বল করে। সামনে এক অন্ধ জলস্থলি। তার উপরিতল ও অধস্তলের মধ্যে ভেদ সেই সন্ধ্যাবর্ণে লুপ্ত। ঘাটের থাক থাক সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে মনে হলো, অনন্ত এক অবতরণরন্ধ্র  উন্মুক্ত হয়েছে সামনে। এক এক ধাপে এক একে ধ্বনিতরঙ্গ যেন কাঁপিয়ে চলেছে ঈথারলোক। কারা তারা? তারাই কি সেই উচাটনস্মৃতি, লোপামুদ্রার ক্লাস নাইনের জ্যামিতি বাক্স থেকে, রুমি চক্রবর্তীর অধর ও স্বদন্তের ফাঁক থেকে, কাবেরী দাশগুপ্তের ম্যাক্সি আবৃত নিতম্বের কূটাভাস থেকে উঠে আসছে অপমান আর লাঞ্ছনার এক নিরেট ইতিবৃত্ত? কোথায় জলতল? সে কি আদৌ কোনও সুশ্রূষাবারিরধি? সে কি পেয়? সে কি অগ্নির অপর পিঠ? ভাবতে ভাবতে কখন জল কোমর ছুঁইয়েছে, মনে নেই… সমগ্র চৈতন্য তখন বীজে সমর্পিত… ওঁ ক্রিং হ্রিং হ্রিং… প্রথম ডুবটিতেই খসে পড়ল এক পরত নিকষবর্ণ। চকিতে মনে হলো, কাবেরীর নিতম্বঘূর্ণনে এক অদৃশ্য মৎস্যের সন্তরণ দৃষ্ট হয়েছিল কোন এক অপরাহ্নে! তাকে ছুঁতেই কি এই মহাকাণ্ড? দ্বিতীয় ডুবের পর কারা যেন খল খল করে হেসে উঠল চারপাশে। অনামিকা, বাশিষ্ঠী আর ব্রহ্মতারা নক্ষত্রলোক থেকে যেন ঝরে পড়ল অষ্টসিদ্ধি। তৃতীয় ডুবের আগেই চরাচর কাঁপিয়ে কে যেন টান দিল ঘাড় ধরে।

ফ্যাটফ্যাট করছে নিয়নবর্ণালি। আচার্য্য হাসছেন ফিক ফিক করে। ছুঁতে পারলে সেই নাভিদেশ? ধরতে পারলে কি মীননেমি? মাথা নিচু করে বসে আছি দেখে আচার্য্যও চুপ করে রইলেন। বাইরের আকাশে তখন বর্ষণের ধারা নেমেছে। তাকাও— বলে জানালার দিকে তর্জনি তুললেন আচার্য্য। চক্রধরপুকুর যেন তার আনুভূমিকতা হারিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে উল্লম্ব ভাবে। নিকষ অন্ধকার আর কৃষ্ণধারাপাত একত্রে যোজনা করছে শূন্যময়ীর উদর আর নিতম্বের গূঢ় নকশাজগৎ। ওর মধ্যে যাও, খোঁজো সেই নাভিচক্র, নেমিব্রহ্ম—

ছিটকে বাইরে এসে ভিজতে থাকি। রাস্তার আলোগুলোও তাল বুঝে অনুপস্থিত। অন্ধকার জল  আর জলীয় অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে ফিরি বেরুবার রাস্তা। অনামিকা, বাশিষ্ঠী আর ব্রহ্মতারা নক্ষত্রলোকে তখন ঘাই মারছেন অদৃশ্য মহামৎস্য। তাঁর লেজের ঝাপটে ভেঙে পড়ছে নীহারিকাস্তম্ভ, জেগে উঠছে বাসনাটঙ্কার।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।