গুচ্ছকবিতায় প্রভাত মণ্ডল
১. অভিশপ্ত মুর্শিদাবাদ
মুর্শিদাবাদ আজ অভিশপ্ত ,
নবাবের দরবার আজ অনুতপ্ত ।
সূর্য তো আজও উঠেছিলো ,
ফুল তো আজও ফুটেছিলো ,
গাঙচিল ভেসে ছিলো ওখানে ,
ও কি ভেবেছিলো ,
বাজবে বিষাদের সুর !
ওকে যেতে হবে বহুদূর ,
আজ সানাই এর সুর হবে মলিন !
তবু তো বদলে গেলো সুর !
ও আজ অন্য বাসার খোঁজে
নীরবে মুখটি বুজে ,
চলে গেলো দূর বহু দূর ,
ওর পায়ের চিহ্ন হল বিলীন ।
আজ তাই তো কেঁদে উঠলো জলাধার
সূর্য তো হয়েছে আজও উদিত ,
তবু চারিদিকে রয়ে গেল আঁধার ।
এ কর্ম মুখর জীবন ,
কে জানতো ওরা ফিরবেনা আর !
তাই তো পথে বের হতেই
কারো মা বলেছিলো ,
খোকা ? সাবধানে যাস ,
দুপুরের খাবারটা সময় মতো খাস ।
ও বলেছিলো ,
মা তুমিও খেয়ে নিও ।
সব রং ফিকে হয়ে গেলো ।
কারো বা ছোট্ট খুকি বলেছিলো
বাবা , বাবা ,
আমাল জন্য ছোত্ত এত্তা পুতুল চাই ।
বাবা বলেছিলো ,
আনবো রে মা আনবো ,
তার জন্য আমার একটা হামি চাই ,
হামি দিয়ে সোনা বললো
পাপা , টা টা বাই বাই ।
সব রং ফিকে হয়ে গেলো ।
কেউ বা হাতে হাত রেখে
শীতের সকালের রোদ্দুর আর
ভালোবাসার মানুষটার আদর মেখে
বলেছিলো ,
এই ফাল্গুনেই বাড়িতে জানাবো ,
আমাদের কথা শোনাবো ,
মা বাবাকে বলবো
আর কত দিন ,
এই ভাবে দূরে দূরে রইবো ।
সব রং ফিকে হয়ে গেলো ।
জানি গো একটা দিন
ফিকে হয়ে যাবে ,
লাল নীল গেরুয়ার পদচিহ্ন
নিহত স্বজনের আঙিনা হতে ।
সাদা ভাত ছাড়া কিছু
রইবে না ওদের পাতে ,
শুধু ঠাঁই পাবে প্রতিশ্রুতি ।
নিহত ভাইয়ের মা-বাবার
চশমার কাঁচ হবে পুরু ,
মেয়েটা যত বড় হবে
ওর জীবনে চলার
পথটাও হয়ে যাবে সরু ,
আর ফাগুন থাকবে অপেক্ষায় ।
আজ নবাবের সভা হল অপমানিত
আবারও ইতিহাসে ঠাঁই পেলো মুর্শিদাবাদ ,
কিন্তু স্বজন হারা মানুষের চোখের জল
চোখেই রয়ে যাবে ।
জলাধারের জল তো বয়েই যাবে ,
ফুটবে কি তাতে শতদল ।
২. বন্ধুস্মৃতি
হারিয়ে গেছিস অনেক দূরে
তবুও ডাকি আপন সুরে
উত্তর তবু দিস না বন্ধু
কেবল দিস দেখা ,
আগেও ছিলিস আজও আছিস
তুই যে প্রাণের সখা ।
হারিয়ে গেছে বন্ধু আমার
হারিয়ে গেছে সব ,
হারিয়ে গেছে প্রাণের মাঝের
নিত্য কলরব ।
নদীর স্রোতের কলধ্বনি
আজও তো নিত্য শুনি ,
প্রাণ মাঝারের হর্ষধ্বনি
আজ যে কেবল চোখের পানি ,
নিত্য নিত্য দিন যে গুনি
বন্ধুরে ! তুই ফিরবি কবে !
আজি আঁখি জলে ডাকি তোরে
বন্ধু তুই কোথায় ?
হাজার তারার ভীড়ের মাঝে
তোর হয়েছে ঠাঁঁই ,
আজ এত ডাকি তবুও বন্ধু
দিস না সাড়া তাই ।
৩. কবিতার ছন্দ
ছন্দ এক সৃষ্টি রহস্য
হোক না তাতে ভুল ,
ভুলে ভরা জীবন খাতা
খাতাতে সবই ছেড়া পাতা ,
পাতা উল্টে দেখতে গেলেই
মিলবে না আর ছন্দ ,
হিসাব যদি কষো তবে
সবই আঁধার অন্ধ ।
জীবন খাতার ছোট্ট পাতা
অহং বোধে ভরা ,
তোমার অহং আমার অহং
সবই যে মন গড়া ।
মনের মাঝেই সব ছন্দ
তবু যেন দ্বার বন্ধ ,
খুলে দেখো মনের দুয়ার
পাবে দেখা মন ভ্রমরার ,
হিন্দু সে কি মুসলিম আর
হোক না খ্রীষ্টান ।
মেলালে মিলবে ছন্দ
না মেলালে বাঁধবে দ্বন্দ্ব ,
খুঁঁজে দেখো প্রাণের ছন্দ
আপন অন্তরে ,
না মিললে বিকিয়ে দিও
আপন প্রাণটারে ।
৪. তোমার সকাল
ফুটেছে আলো , চারিদিকে শিশির ভেজা ঘাস ।
আমরা উঠেছি তুলোর কম্বল আর
গরম বিছানাকে পিছে ফেলে ,
কেউ বা তখন বিছানাতেই জাগছে নয়ণ মেলে ।
তুমি তখন পথের ধারের
চায়ের দোকান গিয়ে ,
হাত বাড়িয়ে চাইছো যে চা
করুণ সুরটি নিয়ে ।
তুমি তখন ফুটপাতেতে
রেল স্টেশনের ধারে ,
শুয়ে আছো তবু ঘুম চোখে নেই
ময়লা , ছেড়া কাঁথা গায়ে দিয়ে ।
তুমি তখন পথের মাঝে
তুমি বনের ধারে ,
আপন মনে বকেই চলো
আকাশ পানে চেয়ে ।
তোমায় সবাই পাগল বলে
মনের হাজার দ্বিধা ভুলে ,
আসল পাগল কে বা চেনে
এই হিংসার দুনিয়ায় !
জাতির বিভেদ সমাজ দ্বন্দ্ব , সকলেরই মনের দুয়ার বন্ধ
এরা কি নয় প্রকৃত অন্ধ
এই সমাজ দুনিয়ায় ?
তোমায় যারা পাগল বলে , আসলে পাগল তারাই হয় ।