“কি চায় ও” ধারাবাহিক বড়ো গল্পে সায়নী বসু (পর্ব – ৪)

সদ্য ফিজিওলজি তে মাস্টার্স করে উঠেছে সায়নী বসু। ছোটবেলা থেকে নাচ গান আর সব রকম গল্প উপন্যাস নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসে। তবে ভৌতিক সাহিত্যের ওপর ঝোঁক চিরকালই বেশি। কয়েক বছর নিজেও লেখালিখি শুরু করেছে। পাঠক পাঠিকাদের ভালোলাগাই তার প্রেরণার উৎস।
পিয়ালী নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রৌনকের দিকে। পিয়ালী র করুন মুখ দেখে রৌনক নিজেকে একটু সামলে নেয়,
– দেখো পিয়ালী এসব মনের ভুল। ওনার বয়স্ হয়েছে তাই উনি এসব বলেছেন। এখন কি কেউ এসব অবাস্তব জিনিসে বিশ্বাস করে?
– তুমি এখনও বলবে এসব মনের ভুল? সত্যি করে বলোতো তোমার নিজেরও কি একবার মনে হচ্ছেনা যে যা ঘটলো তা স্বাভাবিক নয়?
পিয়ালী র এই প্রশ্নে রৌনকও কোনো জবাব দিতে পারেনা। সত্যি তার মনের মধ্যে ও কোথাও যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। ওরা দুজনে এবার ফ্ল্যাটের শান্তি সস্তয়ণ এর পুজোর ব্যবস্থা করার জন্য পুরোহিতের সাথে কথা বলে। তিনি শুভ দিন দেখে বলে দেন সময় মত পৌঁছে যাবেন। বিকেল হতে না হতেই পিয়ালী আবার হাজির হয় হসপিটালে ঋক এর কাছে। ডাক্তার বাবু তখন চেকআপ এ এসেছিলেন। পিয়ালী কে দেখে মাথা নাড়িয়ে বলেন,
– এইরকম কেস আমি আগে কখনও দেখিনি। শারীরিক কোনো ত্রুটি বের করতে পারছিনা অথচ এতটুকু বাচ্ছা কোমা স্টেজে এমনি এমনি চলে যাবে তাও তো হয়না। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবো তারপর সবই তাঁর ইচ্ছা।
এই বলে তিনি চলে যান। পিয়ালী মনে মনে নিজেকে দুষতে থাকে। তারই তো উচিৎ ছিল ঋক কে আগলে রাখা, এখনই বা কি করছে সে! সব কিছু তো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না, মা এরা তার সন্তানের জন্য করতে পারেনা এমন কোনো কাজ নেই, মা এর থেকে বেশি শক্তি কারুর থাকতে পারে না।
ঋকএর পাশে বসে পিয়ালী, শান্ত হয়ে শুয়ে আছে ঋক এতটুকুও কোনো দুষ্টুমি করে নি। পিয়ালী র খালি মনে হচ্ছে এই বুঝি ঋক তাকে মাম বলে জড়িয়ে ধরলো। কত কথা মনে পড়ছে পিয়ালীর, ঋক সারা বাড়ি ছুটোছুটি করতো, লুকোতে যেত, পিয়ালী তাকে শাসন করত, বকেঝকে খাওয়াতো, পিয়ালী কে পাশে না পেলে রিকের তো ঘুমই আসতো না। এসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে ঋক এর কপালে হাত রাখতে যায় পিয়ালী আর সাথে সাথে কেঁপে ওঠে। সারা শরীর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে যায়, যেন সে কোনো মানব দেহে নয় হাত দিয়েছে কোনো শর্ট সার্কিট হয়ে যাওয়া যন্ত্রে।
মনের ভুল ভাঙতে সে আবারও হাত দিতে যায় ঋক এর কপালে কিন্তু এবারেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, কেঁপে ওঠে পিয়ালীর সারা শরীর! ছিটকে সরে আসে সে, হঠাৎ তার মাথায় মহিলার বলা কথাগুলো আসতে থাকে, সেই ইলেকট্রিক শক, সেই বাচ্ছাটা, ‘ ডক্টর, ডক্টর ‘ বলে চেঁচিয়ে ওঠে পিয়ালী ভীত কণ্ঠে। কাছাকাছি কোথাও থেকে একজন নার্স ছুটে আসতেই তাকে সব বলে পিয়ালী। নার্স এগিয়ে গিয়ে ঋক এর কপালে হাত দিয়ে পিয়ালীর দিকে তাকিয়ে বলে,
– কই কিসের কারেন্ট? ওর গা টা ঠাণ্ডা বলে আপনার হয় তো ওরকম কিছু মনে হচ্ছে।
ঠিক তখনই পিয়ালীর কানে আসে এক হাসির আওয়াজ, যেন একটা বাচ্ছা ছেলে খিলখিলিয়ে হাসছে। পিয়ালী নার্স কে জিজ্ঞেস করে ওঠে
– ওটা কার হাসির আওয়াজ? পাশের কেবিনেও কোনো বাচ্ছা ভর্তি হয়েছে?
– হাসি? হসপিটালে কে হাসবে? আমি তো শুনতে পেলাম না। আর পাশের কেবিনে তো একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আছেন।
নার্সের কথা শুনে চুপ করে যায় পিয়ালী, কিন্তু সে শুনেছে, খুব স্পষ্ট শুনেছে সেই হাসির আওয়াজ। নার্স টা কেবিন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে যায়,
– বুঝতে পারছি ম্যাডাম আপনার মনের অবস্থা। ছেলেকে এই অবস্থায় দেখতে কোন মা এর ই বা ভালো লাগে! কিন্তু আপনি নিজেকে একটু শক্ত রাখুন, এরকম প্রেসার নিলে তো আপনিও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
দুদিন পর পুরোহিত মশাই আসেন ওদের ফ্ল্যাটে। বলাই বাহুল্য এই দুদিন ঋক এর অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয় নি। তাই লোক লৌকিকতা বা আতিথেয়তা করার মত অবস্থায় ওরা ছিলোনা। পিয়ালী শুধু পাশের ফ্ল্যাটের ওই মহিলা কে আসতে বলেছিল। যথাসম্ভব আচার বিচার মেনে পুজো সম্পন্ন হলো। পুরোহিত মশাই হাতে শান্তির জলের পাত্র টা নিয়ে সব জায়গায় জল ছেটাতে লাগলেন মন্ত্রচ্চারন করতে করতে। বয়ষ্ক মহিলাটি পিয়ালী কে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলছিলেন,
– দেখো মা সব ঠিক হয়ে যাবে। ভগবান আছেন। উনি তোমার কোল খালি হতে দেবেননা। এত মন খারাপ কোরো না।
এমন সময় পুরোহিতের চিৎকার শুনে সবাই ছুটে গিয়ে দেখে উনি দাঁড়িয়ে ফ্রিজের সামনে আর ওনার হাত থেকে পাত্রটি পড়ে গিয়ে সব জল মেঝেতে পড়ে আছে। পুরোহিত ঠাকুর কেমন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে, চোখে মুখে একরাশ ভয় নিয়ে বললেন,
– এই দিকে জল টা ছিটাতেই মনে হলো সারা শরীরে কেমন কাঁপুনি লাগলো যেনো কেউ তীব্র ভাবে আমায় ঝাঁকিয়ে দিল। হাত থেকে শান্তির জল টা পড়ে গেল। আমার কেমন জানো ঠেকছে, এ লক্ষণ ভালো নয়।
থতমত খেয়ে রৌনক জিজ্ঞেস করলো
– লক্ষণ মানে? কিসের লক্ষণ ভালো নয় ঠাকুর মশাই?
– অতশত আমি বলতে পারবো না তবে আমার ভালো ঠেকছেনা। এ আমার সাধ্যের বাইরে।
এই বলে তিনি একটু তড়িঘড়ি চলে গেলেন, যেন পালাতে পারলে বাঁচেন! ভদ্রমহিলা খুবই চিন্তিত হয়ে পিয়ালী কে বললেন
– আমার মনে হয় তোমাদের এবার একটু অন্যরকম ভাবে চেষ্টা করতে হবে।
– অন্যরকম মানে? কি চেষ্টা করবো?
একটু রাগন্বিত হয়েই রৌনক বলে ওঠে।
– আমার মনে হয় ছেলে কে যদি বাঁচাতে চাও তাহলে এবার একটু অতিপ্রাকৃতিক বিষয়েও বিশ্বাস করো বাবা। তোমরা আজকাল কার ছেলে মেয়েরা কিছুই মানতে নারাজ তবে তোমরা না মানলেই তো সব আর মিথ্যে হয়ে যায় না।
এইটুকু বলেই সেই মহিলা ও নিজের ফ্ল্যাটের দিকে পা বাড়ান।
– সব তোমার দোষ। আমায় নিয়ে চলো সেখানে যেখান থেকে এই ফ্রিজ টা এনেছিলে। আমি দেখবো এই আপদটাকে তুমি কোথায় পেলে।
রাগে চেঁচাতে শুরু করে পিয়ালী। তাকে শান্ত করতে রৌনক বলে,
– বেশ তোমায় নিয়ে যাবো। কিন্তু ওই ভদ্রমহিলা আজেবাজে বকে তোমার মাথা খাচ্ছে এই বলে দিলাম।
পিয়ালী কে নিয়ে রৌনক যায় অ্যাপার্টমেন্টের মালিকের বাড়ি। রৌনকের সন্দেহ হচ্ছিলো যে পিয়ালীর যা মনের অবস্থা তাতে ভদ্রলোক কে উল্টোপাল্টা কিছু বলে না বসে, তাই সে যাওয়ার পথে পিয়ালী কে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছে তবে পিয়ালী সেসব কথার কোনো উত্তর দেয় নি, নির্বিকার ভাবে চুপ করে থেকেছে। তবে ওনার বাড়ি পৌঁছেই পিয়ালী লোক টি কে প্রশ্ন করে
– আপনি একটা পুরোনো জিনিস যেটার থেকে কিনা একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটা কিছু না বলে আমার স্বামী কে কেন বিক্রি করলেন?
প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক চমকে যায়। বেগতিক দেখে রৌনক পিয়ালী কে থামিয়ে দিয়ে ফ্রিজটা নিয়ে যাওয়ার পর যা যা ঘটেছে সব খুলে বলতে শুরু করে। সব শুনে ভদ্রলোক একবার মাথা নিচু করে তারপর পিয়ালী কে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন
– দেখুন ম্যাডাম আপনার হাজব্যান্ড নিজেই এসেছিলেন আমার কাছে এবং জিনিসটা পছন্দ করে নিয়ে গেছিলেন, আমি তো ওনাকে জোর করিনি। তাছাড়া দুর্ঘটনা যেটা ঘটেছিল সেটা সার্কিটের প্রবলেম এর জন্য, ফ্রিজ টার আর্থিং এ ও প্রবলেম ছিল। কিন্তু ওনারা ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমি ওই ফ্ল্যাটের সব ইলেকট্রিক কানেকশন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সারিয়েছিলাম। তাই আর ওই ধরনের কিছু হওয়ার কথা নয়। আপনার ছেলের সাথে যা হয়েছে তার জন্য সত্যি খারাপ লাগছে কিন্তু তাতে আমি কি করে দায়ী হলাম বা ওই ফ্রিজ টাই যে দোষী সেটা কি করে প্রমাণ হল?

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।