ক্যাফে গদ্যে কৃপা বসু

মাকে লেখা চিঠি

জন্মদিনের পায়েসের দুধ কেটে গিয়েছিল, দুধ যখন উতলে উঠছে, তখন গন্ধ শুঁকে বোঝা গেল দুধ কেটে গেছে। আবার দুপুরবেলার মাথা ফাটা রোদে ভাই সাইকেল নিয়ে তাড়াহুড়ো করে দুধ কিনে নিয়ে আসে…..
মা সকালে পাশের বাড়ির বাগান থেকে ধান দুব্য তুলে নিয়ে ঠাকুরের পায়ে রাখে। প্রতিটা জন্মদিনে বাড়িতে খাসির মাংস, দামি চালের সাদা ধবধবে ভাত, পাঁচ রকম ভাজা, পায়েস, রান্না হতো। বাবা সকাল সকাল উঠেই কেক, মিষ্টি, কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনে আনতো……
মা ধীরে ধীরে দরজায় টোকা মেরে ঘুম ভাঙিয়ে হ্যাপি বার্থডে বলতো, চোখ ডলতে ডলতে খাট থেকে নেমে মা আর বাবার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতাম।
ফ্রিজ খুললেই মনে হতো যেন পৃথিবীর যত আলো যত উৎসব আমার ওই ছোট্ট ফ্রিজটাতে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে, কত কত মিষ্টির প্যাকেট, দই, আহা।
তাড়াতাড়ি সেদিন স্নান সারতাম মায়ের হাতের পায়েস খাওয়ার লোভে, আহা গোটা বাড়ি গন্ধে ভরে যেত। মনে হতো সদ্য যৌবনে পা দেওয়া কোনো এক কলেজে পড়া মেয়ে ঘুঙুর পরে নেচে বেড়াচ্ছে ছাদময়….
স্নান সেরে এলেই মা শাঁখ বাজাতো, প্রদীপ জ্বালিয়ে আনতো, ধান দুব্য দিয়ে আশীর্বাদ করতো, মনে মনে বলতো “ঠাকুর আমার মেয়েটা বড় চঞ্চল, বড্ড জেদি, খামখেয়ালি, ওকে দেখো ঠাকুর, ওকে দেখো, ও যেন অনেক বড় হয়”…
তারপর নিজের হাতে পায়েস খাইয়ে দিতো, ভাত খাইয়ে দিতো, একটু বেলা বাড়তেই একজন দুজন বন্ধু আসতো। কেউ পেন কেউ ফুল কেউ গ্রিটিংস কার্ড কেউ আবার ফ্লাওয়ার ভাস নিয়ে আসতো হাতে করে রঙিন কাগজে মুড়িয়ে….
সবার সাথে মিলে কেক কাটতাম, বাবা মাঝখানে এসে দাঁড়াতো, মা বাবা দুজনকে কেকের ফার্স্ট টুকরোটা খাইয়ে সব বন্ধুদের খাওয়াতাম, বন্ধুরা কেক খেতো কম, কেকের ক্রিম নিয়ে একে অপরের গায়ে মাখাতো বেশি….
তারপর আমরা সিনেমা দেখতাম, গল্প করতাম, উপহার গুলো খুলে দেখতাম, মা মেঝেতে আসন পেতে প্রত্যেককে খেতে বসতে বলতো। কাঁসার থালা অনেকগুলো ছিল, সেগুলো বার করা হতো, আর প্লাস্টিকের গ্লাসে করে সবাইকে জল দেওয়া হতো…
খাওয়াদাওয়ার শেষে বন্ধুরা বাড়ি যাওয়ার সময় বাবা আমায় ডেকে বলতো, তোর বন্ধুদের চকলেট আর বেলুন দিতে ভুলিসনা যেন!….
এভাবেই রাত বাড়তো, ক্লান্ত হতাম, মা মুখের থেকে কেকের ক্রিম মুছিয়ে দিতো, কোনওরকমে নতুন জামা খুলে হাত পা ধুয়ে শুয়ে পড়তাম।
আমরা এভাবেই আমাদের জন্মদিন পালন করতাম, আমাদের সময় একটা জন্মদিন ছিল, জন্মদিনের একটা গন্ধ ছিল, সে গন্ধের মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা ছিলো না।
সে গন্ধে নাকে ধাক্কা মারলে মনে হতো কোনো এক মাঠে বসে সূর্য ডুবতে দেখছি গাছের পাতায়, আকাশে ভীষণ মেঘ জমেছে। হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে চুল, স্কুল পালিয়ে কয়েকটা দস্যু ছেলের দল ফুটবল খেলছে গায়ে কাদা মেখে, তার ঠিক দশ হাত দূরে রাঙা দা বসে বাঁশি বাজাচ্ছে…
সেই জন্মদিনের গন্ধ যতবার মেখেছি গায়ে আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো রাঙা দার বাঁশি শুনে গেছি বাউলানি সেজে। মনে হয়েছে রাঙা দার কাছে গিয়ে একবার জিগ্যেস করি কাঁধে হাত রেখে “ও রাঙা দা ভালো আছো গো! এমন বাঁশি বাজাও কেন রাঙা দা, যে সুর শুনলে বেহায়া মানুষ তাল ভুলে যায়, ময়ূর কিংবা রাধা হতে চায়! বলোনা গো এমন বাঁশি বাজাও কেন”…..
আমাদের সময় একটা জন্মদিন ছিল, এখন আর নেই। আগে প্রতিটা জন্মদিনে মানুষ ছোট হতে চাইতো, ফিরে যেতো তার শৈশবে এখন জন্মদিন আসলে মনে হয় মৃত্যুর দিকে হেঁটে যাচ্ছি বৈরাগিনী হয়ে….
মা, তোমায় কিছু বলতে চাই, আমি তোমার অক্ষম সন্তান। তোমায় দিতে পারিনি কিছুই, কতবার ভেবেছি চৈত্র মাসের সেল থেকে একটা সুতির শাড়ি কিনে দিই, একদিন রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে তোমায় মন প্রাণ ভরে খাওয়াই, তোমার সামনে বসে তোমায় দেখবো, তুমি খাবে, যেমন করে ছোটবেলায় আমায় খাইয়ে দিতে…
কত কতবার ভেবেছি তোমায় নিয়ে মেলায় যাই, চলন্ত সিঁড়িতে তোমার হাত ধরে টেনে তুলি, যেভাবে ছোটবেলায় আমি হোঁচট খেয়ে পড়লে তুমি এসে সামলে নিতে। ভাবতেই ভাবতেই ফুরিয়েছে বেলা, ফিরে এসেছি ঘরে মাথা নীচু করে, আমি তোমার বড় অক্ষম সন্তান গো মা…
কিন্তু দুনিয়ার সমস্ত হদ্দবোকা অক্ষমদেরও ভালোবাসার একটা মানুষ থাকে,
ক্যান ইউ লাভ মি স্টিল নাও মা???…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।