ক্যাফে গদ্য -তে অমিয় পাল

আসা যাওয়ার মাঝে

আমি শ্রীময়,উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির ছেলে।তবে বনেদিয়ানা, কলকাতার স্বাদ গন্ধ কোনোটাই সেভাবে পাইনি ছোট বেলায় কারণ বাবার চাকরি সূত্রে বারবার বদলি।কখনো অরুণাচল কখনো দিল্লী তো আবার কখনো শিলিগুড়ি।তবে কলকাতা ফেরার টান বহুদিন ধরেই, আমার শহরকে কাছ থেকে পাওয়ার জন্য আর আমার জানালার জোনাকীকে ফিরে পাওয়ার জন্যই আমার শহরে ফেরার তাগিদ।
যাই হোক আমার কথা না বলে আসল কথায় আসি, অবশেষে ২০১৯-এ আমার কলকাতা ফেরার সুযোগ চলে এলো, ছাড়তে পারলাম না সেই সুযোগ। বাবার হাওড়াতে পোস্টিং, শুনেই খুব মজা খুব আনন্দ। তো সেই শুভ দিনটা চলেই এলো শেষমেষ। শিলিগুড়ি থেকে ট্রেনে চেপে সোজা কলকাতা, জিনিসপত্র সব আগেই এসে গেছে। যাই হোক,আমাদের বাড়িটা ঠিক কুমোরটুলীর গা ঘেঁষে কিছুটা এগোলেই, ছাদ থেকে প্রবহমান গঙ্গা,ঠাকুর তৈরি,মাটির গন্ধ,ঠাকুর বের করার শব্দ আবার কাশী মিত্তির ঘাটের মরা পোড়ার দৃশ্যও দেখা যায়। ছোটবেলায় স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই সবার আগে গঙ্গার ঘাটে, বাবার হাত ধরে আসতাম।
ছোটবেলায় এখানে থাকলেও সেভাবে উপভোগ করা হয়নি তেমন। কারণ আমার বয়স যখন সাত তখনই বাবার হাত ধরে চলে যাই সেই অরুণাচল। তারপর তো ওই অরুনাচলেই স্কুল,তারপর সেখান থেকে দিল্লী। দিল্লী হয়ে শিলিগুড়ি। আমার বন্ধু বান্ধবী দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, তবে জীবনে প্রেমটা হয়ে ওঠেনি আজও, সেসব থাক।
ফিরেই সেদিন গঙ্গার ঘাট থেকে ফেরার সময় কিছু আলুর চপ নিয়ে ফিরলাম। সেদিন মাঝরাতে ছাদে উঠেই আবারও কলকাতার প্রেমে পড়ে যাই আমি।
পরদিন সকালে দোতলায় আমার ঘরের ঠিক পূবের জানালাটা চোখে পড়লো আমার।ছোট থেকেই ওই জানালা টা আমার খুব পছন্দের।কারণ আমাদের ঠিক পাশের বাড়ির উঠোনটা আমার পূবের জানালা দিয়ে দেখা যায়।আর সেই উঠোনে আমি ছোটবেলায় খেলতাম আমার একমাত্র শহরের বন্ধু জোনাকির সাথে। আমার কলকাতা আসার একটা ছোট্ট কারণ ছিল এটাও,আগেই বলেছি। আজ আমার ২৫ বছর বয়স, এতদিন পর জোনাকিকে দেখার ইচ্ছাটাও প্রবল। পূবের জানালার কাছে মুখ রেখে সকাল থেকে বসে আছি, জানিনা আদৌ জোনাকি এখনো এখানে আছে নাকি।কেন জানিনা অকারণেই মনটা আজ কেমন আনচান করছে, ভাবতে ভাবতে আমার জীবনে বসন্তটা এসেই গেল। বাড়ির দরজা খুলে উঠোনে নেমে এলো একজন অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। কোমর অবধি খোলা চুল,পরনে হলুদ চুড়িদার আর কপালে একটা ছোট্ট টিপ .. তাহলে ওই কি জোনাকি ? ওই কি ঝুমুর ? ওহ হ্যাঁ ওই তো ঝুমুর, আমি ছোটবেলায় জোনাকি পোকার গল্প প্রথম ওর কাছে শুনি তাই ওর নাম রেখেছিলাম জোনাকি।যাই হোক মনের মধ্যে হাজার হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে যে , ওর কি আদৌ আমায় মনে আছে ? ও কি আসলেই জোনাকি , নাকি অন্য অন্য মেয়ে ?
সব প্রশ্নের অবসান ঘটলো বিকেলে যখন মায়ের ডাকে পাশের বাড়ির কাকু কাকিমা আর ওই আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা এসে হাজির। স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা কারণ , সকালে তাকে দেখেই ভালো লেগেছে আমার ওকে,দুপুরে তাই ঘুমের ঘোরে একটা ছোট স্বপ্নও দেখে নিয়েছি তাকে নিয়ে। এদিকে এত বছর পরে আমায় দেখে কাকু কাকিমা অবাক,আর জোনাকি, ও তো মিটি মিটি হাসছে আমায় দেখে। আমি অগত্যা ছাদে উঠে চলে এলাম, কিছুক্ষন পরে পায়ের শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম তাকে।
– জোনাকি, তোমার মনে আছে আমায়?
– তোমায় মনে থাকবেনা শ্রীময় ? তুমি তো আমার সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। তারপর একদিন কোথায় চলে গেলে .. তোমায় আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। কেমন আছো তুমি ? বদলে গেছো তুমি। অবশ্য বদলানো টাই তো স্বাভাবিক।
– জোনাকি তুমিও কতো বদলে গেছো তোমায় আমি সকালে সেই পূবের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেছি,কিন্তু চিনতে পারিনি।
কথা এগিয়ে চললো আমাদের মধ্যে আর এভাবেই একরকম প্রেমে পড়লাম আমি।একদিকে শহরের প্রেমে আর একদিকে জীবনের প্রেমে। ওর সাথে ফুচকা খাওয়া,ট্রামে চড়া,ময়দান, নিউ মার্কেট, ভিক্টোরিয়া সব ঘুরে ফেললাম। এরই মধ্যে খুঁজে খুঁজে একটা চাকরিও জুটিয়ে ফেললাম, জোনাকিও আমার প্রপোজাল accept করেই নিলো। আমাদের এই হঠাৎ পাওয়া প্রেমকাব্য , ওর জন্মদিনে হঠাৎ করে ওর পছন্দের জায়গাতে নিয়ে গিয়ে surprise থেকে আমার জন্মদিনে কেক কাটা, সবটাই খুব ভালো চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পরে ও চলে গেল হায়দ্রাবাদে ওর পড়াশোনার জন্য। আমি ওর অপেক্ষায় থেকে গেলাম কলকাতা। দূরে থাকলেও অবশ্য কথা হয় নিয়মিত। তবে , ও নেই কলকাতায় .. তাই পূবের জানালা টাও বন্ধ আজ বহুদিন হলো।
এদিকে বছর শেষের সময় থেকেই সারা বিশ্ব জুড়ে একটা কি রোগ ছড়িয়ে পড়লো। ভাইরাস, করোনা ভাইরাস। তারপর সেটার বার বৃদ্ধি হতেই কলকাতাসহ সব জায়গাতে নতুন বছরের ঠিক দ্বিতীয় মাস থেকে সবকিছু বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিলো সরকার। তাই সেই সুবাদে আমার জোনাকি ফিরে এলো আবার নিজের বাড়িতে, কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী ওকে থাকতে হবে কিছুদিন সবার থেকে আলাদা। সেই অনুযায়ী ও ছিল নিজের ঘরে। এভাবেই ফোনে কথা চলতো নিয়মিত। ওর ঘরটা ছিলো আমার ঘরের একদম অন্যদিকে। কিন্তু ওই জানালা টাও আর খোলা হয়নি কারণ ওর বেরোনো এখন নিষেধ কদিন। ঠিক যখন ওরবাড়িতে থাকার ১৩-তম দিন , সেদিন ওর খুব জ্বর আসে। বাড়িতে ডাক্তার আনলে উনি জোনাকিকে হাসপাতালে দিতে বললেন, এবং হাসপাতালে দেওয়া হলে ওর করোনা পজিটিভ আসে। কথাটা শোনার পরেই যেন আমি হঠাৎ কেমন শান্ত হয়ে গেলাম, পাড়ায় পুলিশ আর পুলিশ। সবার মুখে আতঙ্ক , উৎকণ্ঠা আর ভয়।আমার দিনরাত কোনো ঘুম নেই। না জানি জোনাকি একা একা ওখানে কি করছে, ওর আবার জন্মদিন এপ্রিল মাসের ৩ তারিখ। ভাবছি তবে কিভাবে এবার ওকে surprise দেবো। ডাক্তার অবশ্য বলেছে , চিকিৎসায় সাড়া মিলছে, সুস্থ হচ্ছে আমার জোনাকি, বাড়িতে সবাই একটু হলেও খুশি। এমন ভাবে ৬ দিন কেটে যাওয়ার পর আজ জোনাকির জন্মদিন, ঠিক আগের বছরের মতো ওকে surprise দেওয়ার জন্য ওর পছন্দের কেক আর একতোড়া হলুদ গোলাপ কিনে আনলাম। এনে কেকটা মোমবাতি ধরিয়ে রাখলাম ওর সামনে,ওর আর আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গাতে, আমাদের ওই পূবের জানালায়, কেক আর গোলাপটা রেখে ওকে কয়েকশো বার ডাকার পরও ও এলোনা surprise টা দেখতে,আমি ডাকতে ডাকতে কেঁদে ফেললাম। মা আমায় জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জল দিয়ে বললো, তুই ভালো হয়ে যা বাবাই,জোনাকি তোর কাছেই আছে আর তুইও ওর কাছেই আছিস, শুধু ওর দেহটা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
হ্যাঁ, আজ তিনদিন হলো জোনাকি আমায় ছেড়ে,ওর শ্রীময় কে ছেড়ে,ওর মা বাবা কাকু কাকিমা সবাই কে ছেড়ে ও একটা নতুন জগতে চলে গেছে যেখান থেকে হাজার বার চিৎকার করলেও ওকে আর ফিরে পাওয়া যাবেনা। করোনার মতো ভাইরাসকে হারিয়ে ও জীবন যুদ্ধে অনেকটা জিতে গেলেও শেষ অবধি জয় টা করোনারই হলো। ওকে শেষ দেখাও দেখতে দেয়নি ওরা, শুধু দূর থেকে দেখেছিলাম সাদা প্লাস্টিকে জড়ানো একটা দেহ চুপ করে শুয়ে আছে একটা শবদেহ বহনের গাড়ির ভিতরে।
ওই তো আমার জোনাকি, সবসময় খুব কথা বলা মেয়েটা,খোলা চুল দিয়ে আমায় পাগল করা, নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি যাকে , আমার সেই জোনাকি আজ ওভাবে ঘুমোচ্ছে।
জানিনা আমি এই শহরে কতদিন থাকবো, আদম এই যুদ্ধে বেঁচে থাকবো কিনা। তবে পূবের জানালাটা আর কখনো খুলবোনা বলে promise করেছিলাম সেদিন ওভাবে ঘুমিয়ে থাকা জোনাকির দিকে তাকিয়ে।
আজ বহুদিন কেটে গেল জোনাকি নেই, মায়ের সাথে প্রতি মাসে ডাক্তার দেখাতে যাই আমি। সবাই বলে আমার মাথা নাকি খারাপ হয়ে গেছে। তাই ওই ঘরে আমায় বন্দি করে রাখে আর মাসে মাসে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যায়।
আজ ২৫সে অক্টোবর। আমার জন্মদিন। জন্মদিনে আমার বিশ্বাস জোনাকি আমার সাথে দেখা করতে আসবেই তাই বই খাতার স্তূপ সরিয়ে পূবের জানালার উপরটা পরিষ্কার করলাম খুলবো বলে। জানালার খিড়কিটা ফাঁকা করতেই দেখলাম বাইরে একটা ছোট্ট বাসা করেছে চড়াই পাখি, বাবা মা আর তাদের ৪টে ডিম। ঠিক তার মধ্যে ১টা ডিম ফুটে একটা ছোট্ট লাল ফুটফুটে চড়াই পাখি পৃথিবীর বুকে নিজেকে মেলে ধরতে জন্ম নিয়েছে। নাহ, জানিনা ওই পাখিটা ছেলে হবে কি মেয়ে,তবে ওর নাম রেখেছিলাম জোনাকি। কারণ ওটাই ছিল জোনাকির দেওয়া আমার জন্মদিনের উপহার। এরপরের দিনই আমার থাকার জায়গা হয় মানসিক হাসপাতালে। জানিনা আমি কি করেছিলাম, তবে আমার পূবের জানালাটা আজও আর খোলা হলোনা। তবে আমার জোনাকি পৃথিবীর বুকে নিশ্চই ডানা মেলে উড়ছে। জোনাকি , তুমি ভালো থেকো ।

ইতি-
জোনাকির শ্রীময়

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।