Cafe কলামে সংগ্রামী লাহিড়ী – ১

সংগ্রামী লাহিড়ী নিউ জার্সির বাসিন্দা, বৃহত্তর নিউইয়র্ক বলা যায় | পরিচয় - শিক্ষায় প্রযুক্তিবিদ, পেশায় কন্সাল্ট্যান্ট, নেশায় লেখিকা | শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে বহুকালের সিরিয়াস চর্চা আছে, অল ইন্ডিয়া রেডিওর A গ্রেড শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী | উত্তর আমেরিকায় করোনা ভাইরাসের এপিসেন্টারে বসে বদলে যাওয়া প্রবাস-জীবনের ডায়রী লিখছেন |

করোনা – ধারায় এসো – 1

জীবন চলে ভার্চুয়ালে

গত কয়েকসপ্তাহে পৃথিবীর তথা উত্তর আমেরিকার তথা বৃহত্তর নিউইয়র্ক অঞ্চলের ভোল পাল্টে গেল।  যাদের পায়ের তলায় ছিল সর্ষে, তারা বাড়িবন্দী।  যাদের বেরোতে হচ্ছে তারা প্রাণ হাতে করে বেরুচ্ছে।  বাকি সবাই হয় তাদের স্যালুট করছে নয়তো গালি দিচ্ছে ইনফেকশন ছড়ানোর জন্যে।  যদিও আমার জন্যে গৃহবন্দী ব্যাপারটা নতুন নয়।  এদেশে যাদের কাজ কনসালট্যান্সি – এই অধমের মতো – তারা হয় সোম-থেকে-বৃহস্পতি ট্র্যাভেল করে, নয়তো বাড়ি থেকে কাজ করে ।  যদিও আপিসে বসে থাকতে আমি বেশ ভালোই বাসি, সারাদিনে বারংবার প্যান্ট্রি-অভিমুখে গমন ও এককাপ কফি সহযোগে সবার সঙ্গে রাজা-উজীর নিপাতন – এ সবই আমার বরাবর ভারী পছন্দের।  শ্রদ্ধেয় মুজতবা আলীসাহেবের ভাষায় ‘গুষ্টিসুখ’।  কিন্তু আমার ঊর্দ্ধতন প্রভুরা তা মানবেন কেন? অতএব লোভ সংবরণ করেছিলুম।  কিন্তু ওই যে বলেছে – ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।  আমায় এখন প্লেনে চড়তে বারণ করে দেওয়া হয়েছে।  আর বাকিরা – যাদের দিব্যি এক-একখানি নিজস্ব আপিস ছিল – সবকটায় তালা লটকে দিয়ে তাদের বাড়ি থেকে কাজ করতে বলা হয়েছে।  তার মানে নো লাঞ্চব্রেক, নো কফি-গুলতানি।  বাড়তি পাওনা অন্তহীন কনফারেন্স কলের ঠ্যালায় তিতিবিরক্ত বাড়ির লোক।  বেশ হয়েছে! ঠিক হয়েছে!
কিন্তু এহ বাহ্য।  কনসালট্যান্সি থাক।  করোনা-ঝড়ে এখন কুচো-কাঁচাগুলোও বাড়ীবন্দী।  আর সেজন্যে মা-বাবার এখন চব্বিশ ঘণ্টার ডিউটি।  নিজেদের আপিস তো আছেই, কাজের চাপ একটুও কমে নি।  বাড়ী থেকেই ওয়েবএক্স, তাতে আবার মুখও দেখাতে হয় – ভিডিও কনফারেন্স।  তার মধ্যে ছানাদের নানারকম।  হ্যাঁ, তাদের ক্যালেন্ডার বাবা-মায়ের থেকেও বেশি ব্যস্ত।  ইশকুল তো বটেই, অন্য আরো নানান বিদ্যা, যা এতদিন নানান জায়গায় হাজির হয়ে শেখা হচ্ছিলো এবং বাবা-মা পালা করে শোফারের কর্তব্য পালন করছিলেন – সে সবই এখন অনলাইনে কিনা?
পড়াশোনাটা অনেক আগে থেকেই ভার্চুয়াল।  গাদা গাদা কোর্স ইন্টারনেটে পড়ানো হয়।  কিন্তু তাও যখন বাচ্চাদের লেখাপড়া গুগলস্যারের ক্লাসে আসে, তা মা-বাবার কাছে বিভীষিকা হয়ে দাঁড়ায়।  অনলাইনে হোমওয়ার্ক জমা করতে গিয়ে কাউন্টি কলেজের দিন-আনি-দিন-খাই গরীবগুর্বো ছাত্রছাত্রীদের নাভিশ্বাস ওঠে।  সেসব নাহয় পরেরবার লিখবো’খন।
সত্যিকারের ইনোভেশন দেখতে পেলুম অন্যান্য বিদ্যাশিক্ষাতে।  যেমন ধরা যাক ক্যারাটে।  ফেসবুক পোস্টে দেখা গেল সামনে ল্যাপটপে ক্যারাটে-গুরু শিক্ষা দিচ্ছেন, ভবিষ্যতের ব্ল্যাকবেল্ট তা দেখে দেখে হাত-পা চালাচ্ছে।  ফুট সুইপ, নী স্ট্রাইক, ফ্রন্ট কিক – স-অ-ব! ভার্চুয়াল কারাটে ক্লাস মোটেই খারাপ হচ্ছে না ।

আর গানের ক্লাস তো এখন স্টেট অফ দ্য আর্ট।  ওস্তাদজীর সামনে খান চারেক ল্যাপটপ অথবা আইপ্যাড, প্রতিটায় আবার চারটি করে খোপ, এক এক খোপে এক একটি সংগীতপিপাসু হাস্যমুখ।  ষোলোজনের ক্লাস, সংগীতশিক্ষা চলছে।  ইচ্ছে করলে আমি-আপনিও লগ-ইন করে শুনতে পারি।  ঠি ক যেমনটি আমাদের গুরুজনেরা গানের ক্লাসে বসে বসে গান শুনতেন।  ওটি ছিল তাঁদের উপরি পাওনা।  নাচের ক্লাসও কম যায় না।  জুম্ বা স্কাইপে নাচের প্রশিক্ষণ তো এখন জলভাত ।

তবে সব ইনোভেশনকে দশ গোল দিলো আমারই পাড়া পারসিপেনির সকার, মানে ফুটবল ক্লাব।  ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু ফোন করেছিল, এই দুর্দিনে খবরাখবর নেওয়ার জন্যে।  তার পুত্র সকার ভক্ত, পারসিপেনির ক্লাবেই শেখে।  কথায় কথায় জানালো যে সকার ক্লাস হচ্ছে গুগল ক্লাসরুমে।  চমৎকৃত হয়ে শুধোলুম – সকার বল নিয়ে প্র্যাক্টিস কি তাহলে ঘরেই হচ্ছে? আমার অজ্ঞতায় সে হেসে জানালো – না না, বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডটা তাহলে আছে কি করতে? কোচ ভিডিওতে অ্যাসাইনমেন্ট পাঠিয়ে দেন।  হবু মারাদোনা সেটি ব্যাকইয়ার্ডে গিয়ে প্র্যাক্টিস করে।  তারপর পুত্রগর্বে গর্বিত পিতা ফাইনাল আউটপুট ভিডিও করে কোচের কাছে পাঠিয়ে দেন।

করোনার কারণে কিছুই থেমে নেই!
সত্যিই কি তাই? কতকিছুই যে থমকে গেছে সে খবর কে রাখে?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।