• Uncategorized
  • 0

গদ্যে অনিন্দ্য রায় 

জন্ম ১৯৭১, বাঁকুড়া নব্বই দশক থেকে লেখালেখি শুরু পেশা:চিকিৎসক প্রকাশিত বই: তিরিশে ফেব্রুয়ারি, স্পার্ক অ্যাভেনিউ, কাগজের হারপুন

নিঃসঙ্গ চাঁদ, বিষাদসম্রাজ্ঞী এবং আমাদের শেষ নিরাময়

“ স্মৃতি
হঠাৎ
হঠাৎ সমস্ত ব্যথা-বেদনা হয়ে
জীবনের ওপর ছড়িয়ে পড়ে,
হঠাৎ শীতের মরশুমে
কারো ওপর বরফের মতো ঠাণ্ডা জল
ছুঁড়ে দিলে
যেমন লাগে
ঠিক তেমনি।”
এ লেখা যাঁর স্মৃতি তো এরকমই তাঁর কাছে, শীতে শরীরে ঠাণ্ডা জলের শিহরণ আর মর্মবেদনায় অস্থির করে, বিষণ্ণ করে তাঁকেও যাঁর রূপলাবণ্যে সারা দেশ মুগ্ধ হয়েছে ; রুপোলি পর্দায় যাঁর উপস্থিতি ঘুম কেড়ে নিয়েছে কত না পুরুষের। জীবনের সেরা কাজ যে সিনেমায় তা মুক্তির তিন সপ্তাহ পরেই তাঁর লিভার সিরোসিসে মৃত্যু। তিনি ভারতীয় সিনেমার ট্র্যাজেডি কুইন, দিলীপ কুমারও নাকি তাঁর সামনে শান্ত থাকতে পারতেন না, তাঁর কণ্ঠস্বর মাদকতাময়, বিষাদসুন্দরী তিনি কবি, তিনি মীনা কুমারী।
“ আমি
আমার জীবনকে দিয়েছি
আমারই রক্তাক্ত হৃদয়,
কিন্তু আমার জীবন
কি দিয়েছে আমাকে,
আমারই স্বপ্ন আমার কাছে হয়ে গিয়েছে গরল
আমার আমার কল্পনা
আমাকে ঠুকরে ঠুকরে খাছে।”
জীবন সম্পর্কে এই ছিল উপলব্ধি তাঁর, রক্তমাখা-বিধ্বস্ত এক মানুষের প্রতিচ্ছবি আমাদের সামনে ফুটে ওঠে।
জন্ম ১অক্টোবর, ১৯৩৩ । মেহজবীন বানো তাঁর পারিবারিক নাম । বাবা আলি বক্স, থিয়েটার কর্মী, সঙ্গীত শিক্ষক, লিখতেন উর্দু কবিতা, সিনেমাতেও টুকটাক অভিনয় করেছেন, সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন । মা ইকবাল বেগম (প্রভাবতী দেবী পারিবারিক নাম)। মঞ্চাভিনেত্রী ; ‘কামিনী’ ছিল তাঁর অভিনয়জীবনের নাম। এঁর মা হেমসুন্দরী ঠাকুর(মুখার্জী)) ছিলেন যদুনন্দন ঠাকুরের স্ত্রী, যদুনন্দন দর্পনারায়ণ ঠাকুরের প্রপৌত্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তুতোভাই।
মেহজবীনের চলচিত্রদুনিয়ায় আত্মপ্রকাশ মাত্র চার বছর বয়সে, বিজয় ভাট পরিচালিত ‘Leather Face’ ( ফরজঁদে বতন নামেও পরিচিত, ১৯৩৯-এ মুক্তি পায় ) সিনেমায় । পরবর্তীতে ‘ এক হি ভুল’ সিনেমায় বিজয় ভাট এই শিশুশিল্পীর নাম রাখেন বেবি মীনা । একের পর এক সিনেমা, পরিবারের প্রধান উপার্জন তখন মীনার । যদিও একটা স্কুলে ভর্তি হল কিন্তু কাজের চাপে পড়াশুনোয় বাধা । পড়াশুনো চলল বাড়িতে আর বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিল ক্রমেই, সেটেও বই নিয়ে আসার অভ্যেস তৈরি হল ।
“ আমি নিজেই
জেনেছি নিজেকে
আর যা কিছু জেনেছি
তাকেই আমি আমার নিজের বাইরে
খুঁজে মরছি।”
১৯৪৬-এ রাজা নেনে পরিচালিত‘বাচ্চোঁ কা খেল’ সিনেমায় বেবি মীনা থেকে মীনা কুমারী । একের পর ছবি আর ‘বৈজু বাওয়রা’ (১৯৫২) তাঁকে নিয়ে এল নক্ষত্রের আসনে । বিমল রায়ের ‘পরিনীতা’ ( ১৯৫৩) এনে দিল সমালোচকদের স্বীকৃতি ।
এর মধ্যে তাঁর জীবনে ঘটে গেছে দুটি ঘটনা । কমাল আমরোহীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাঁর এবং আমরোহীর আসন্ন ফিল্ম ‘ আনারকলি’র নামচরিত্রে অভিনয়ের জন্য সই করলেন মীনা, তার কিছুদিনের মধ্যেই পথ দুর্ঘটনা , হাসপাতালে ভর্তি হলেন মীনা । তাঁর বাঁ হাতে আঘাত গভীর, ক্ষতিগ্রস্থ হল ওই হাতের বুড়ো আঙুল । আমরা এর পর থেকে পর্দায় তাঁকে দেখেছি শাড়ি বা দোপাট্টায় বাঁ হাত ঢেকে রাখতে । আমরোহীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ল, চিঠি, সারারাতের ফোনালাপ, প্রেম ও বিবাহ ( ১৯৫২-র ১৪ ফেব্রুয়ারি ) , তখন মীনা ১৮ বছরের আর আমরোহী ৩৪, বিবাহিত, তিন সন্তানের পিতা । মীনার বাবা আলি বক্স চাইলেন না এই বিয়ে টিকুক, তাঁর সাথে সংঘাত শুরু হল । বাপের বাড়ি ছেড়ে মীনা এসে উঠলেন স্বামীর ঘরে । দাম্পত্য সুখের হল না, ঈর্ষা-সন্দেহ-পরকীয়া সব মিলিয়ে ট্র্যাজিক চিত্রনাট্য ।
“সময় এখন আমার, নিয়েছে ছিনিয়ে, দুঃখ –জ্বালার সহন শক্তি
এখন দুঃখের ঠুনকো আঘাতেই, কেঁপে কেঁপে ওঠে হৃদয় আমার ।
এখন প্রতিটি, প্রতিটি নতুন আঘাতে আমার হয়ে ওঠে মন
কী ভীষণ করুণ
আমার ঠোঁটে যদিও থাকে হাসির ঝিলিক,
চোখে আমার জলের প্লাবন, অশ্রু প্লাবন ।
জীবন যেন, যেন এক ছড়িয়ে-পড়া ব্যথা, ভীষণ ব্যথা
যেন আমার দুঃখ-কথার, দুঃখ-কথার টানছে যবনিকা ।”
( ‘প্রেম স্বপ্ন এক’ শিরোনামে এই লেখাটি পরিচিত, যদিও কমলেশ সেনের অনুবাদে ‘বারো’ সংখ্যায় চিহ্নিত )
সিনেমায় অভিনয় থামেনি তাঁর, অসংখ্য হিট পেরিয়ে ১৯৬২-তে ‘সাহিব বিবি ঔর গুলাম’ মুক্তি পেল । ছোট বৌয়ের চরিত্রে তিনি অনবদ্য । ছোটবৌ – যার সব আছে অথচ কিছু নেই, আছে শুধু সুরাসক্তি । সিনেমাটি রাষ্ট্রপতির রৌপ্য পদক পেল সেরা হিন্দি ছবি হিসেবে, পেল চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার । অস্কারের জন্য ভারতীয় ছবি হিসেবে মনোনীত হল । বার্লিন ফিল্মোৎসবে মনোনয়ন পেল সেরা চলচিত্রের । বার্লিন যাওয়ার কথা মীনার, কিন্তু স্বামীর সাথে মন কষাকষিতে হল না যাওয়া । ফিল্মটির প্রিমিয়ারে নাকি অভিনেতা-নির্দেশক সোহরাব মোদি মহারাষ্ট্রের গভর্নরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,”ইনি বিখ্যাত অভিনেত্রী মীনা কুমারী, আর ইনি ওঁর স্বামী কমাল আমরোহী ।’ “ না । আমি কমাল আমরোহী, আর ইনি আমার স্ত্রী, বিখ্যাত অভিনেত্রী মীনা কুমারী ।” এই বলে আমরোহী বেরিয়ে যান, মীনা একাই প্রিমিয়ার দেখেন । গুলজার, ধর্মেন্দ্র, শাওয়ান কুমার – এমনই কতজনের সঙ্গে যে সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি, গুজব ছড়ায় ।
“ ভালবাসা
যেন ইন্দ্রধনু
যেন পৃথিবীর এক তট থেকে
আর এক তট পর্যন্ত প্রসারিত
আর তার দুটি প্রান্তই যেন
দুঃখের গভীর সমুদ্রে
ডুবে আছে ।”
অনিদ্রা ছিল মীনার সঙ্গী, সঙ্গী ছিল ঘুমের ওষুধ । চিকিৎসকই নাকি তাঁকে পরামর্শ দেন ঘুমের ওষুধ না খেয়ে রাত্রে সামান্য ব্র্যান্ডি খেতে । ক্রমেই নেশায় ডুবে যান তিনি, মদই হয়ে ওঠে তাঁর যন্ত্রণা ভোলার ওষুধ এবং একইসাথে বিষ । তিনি যেন সাহিব বিবি ঔর গুলাম’-এর ‘ছোটি বহু’, যার সব আছে, অথচ কিছু নেই, মদ ছাড়া । লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয় । চিকিৎসার জন্য বিদেশে, কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন, কাজে ফেরেন, নেশায় নয়। প্রবল মনের জোরে আমরোহী ও তাঁর স্বপ্ন-প্রকল্প ‘পাকিজা’র কাজ শেষ করেন ।
“ সুগন্ধ আর রঙ
আমার দিন আমার রাতকে
ভরিয়ে তুলেছে,
হে আমার মনের মানুষ
তোমার খুশবু
সে তো তোমাকেই,
তোমাকেই পাওয়ার জন্য ।”
১৯৭২-র ৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পায় পাকিজা, ওই বছরেই ৩১ মার্চ লিভার সিরোসিসে মারা যান তিনি ।
তাঁর জীবনের আরেক দিক শব্দের, সুরের, নজ্‌মের, কবিতার । ‘নাজ’ ছদ্মনামে লিখতেন তিনি । ১৯৭১-এ নিজের লেখা গজল খৈয়ামের সুরে বের হল মীনা কুমারীর অ্যালবাম, ‘আমার লেখা, আমার গাওয়া’ । মৃত্যুর পর ১৯৭২-এ প্রকাশিত হল কবিতার বই ‘নিঃসঙ্গ চাঁদ’, গুলজারের সম্পাদনায় ।
“ চাঁদ নিঃসঙ্গ আর নিঃসঙ্গ আকাশও
কোথায় হৃদয় মেলে নির্জনে কোথায়

এই আমাদের বিষাদসম্রাজ্ঞী ।
খ্যাতির চূড়ান্তে, গ্ল্যামারের ঝলকানিতে থেকেও কেন একজন সফল নায়িকাকে কবিতা লিখতে হয় ? কেন তাঁকে খুঁজতে হয় আশ্রয় শব্দের ? কেন তাঁকে বলতে হয়
“ না ধরতে পারলাম হাত
না ধরতে পারলাম আঁচল
আমার খুব কাছ দিয়ে উঠে
সে কোথায় চলে গেল ।”
অধ্যাপক নুরুল হাসানের বই, ‘Meena Kumari The Poet – A Life Beyond Cinema’-র ভূমিকায় ফিলিপ বাউন্ডস ও ডেইসি হাসান তাঁর কবিতাকে বলেছেন, “ পাব্লিক ইমেজ থেকে দূরে থাকবার মাধ্যম । ‘ Meena Kumari : The Classic Biography’ বইটির লেখক বিনোদ মেহেতার কথায়, “ তাঁর বলার মতো কিছু কথা ছিল বলেই মীনা কুমারী লিখেছিলেন, তাঁর কিছু কথা তো ছিলই নিজের সাথে বলার মতো। … তাঁর কবিতা বিষণ্ণ, স্ফুর্তিহীন, নিরাশ, অসুখী – মীনা কুমারীর ধাতের এক নারীর কাছে কী আর আশা করা যায় ?”
কমাল আমরোহী উর্দু কবিতার সুক্ষ্ণতায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ বলেছেন তাঁকে আর গুলজার জোরালো, প্রাণবন্ত চিত্রকল্প পেয়েছেন তাঁর কবিতায় ।
কিন্তু কেন একজন সফল রুপোলি দুনিয়ার মানুষ চান কবিতার শুশ্রূষা?
কবিতা কি শেষ নিরাময় তবে ?
[* চিহ্নিত অংশটি বাদ দিয়ে মীনা কুমারীর বাকি কবিতাগুলির অনুবাদ কমলেশ সেন অনূদিত ]
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।