• Uncategorized
  • 0

গদ্যে দীপ শেখর চক্রবর্তী

আটাশটি উটের ছায়া

শ্মশানের রাস্তা দিয়ে নেমে আসি পুরোনো পাড়াটায়।শীতের গভীর রাতে শ্মশানে পুড়েছে আমার যৌবন।বাতাস ভারী,দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কীর্তনের একটানা সুর।আমার হাতের মুঠোয় প্রসবযন্ত্রণা।অথচ একের পর এক মৃত সন্তানের রক্তে লাল হয়ে যাচ্ছে আমার জীবন।বাজার সংলগ্ন মসজিদের পাশে কিছু অদৃশ্য মোরগের লড়াই আমাকে মগ্ন করে তোলে।তাদের পায়ে জং পড়া ব্লেডের অংশ।সে লড়াইয়ে অংশ না নিয়েও কেন এভাবে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে আমার বুক?নিজের ওপর অজস্র অন্যায় করেছি আমি।আমার অস্তিত্ত্ব এখন ভাড়াবাড়ির দেওয়ালে পোঁতা একটি পেড়েক।আমার প্রেমজীবন এখন দুহাত ছেড়ে সাইকেল চালানো।দৃশ্যের মুক্তি হয় আর ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে আমার বয়স।আমি মেপে রাখি একেকটি চায়ের দোকানের এককে।তারা চেনে আমায়,এই শহরের বহু পুরোনো এক পাপী আমি।আমিই সেই যে এই শহরের বাতাসে ছড়িয়ে দিতাম বারুদ ও পরীর গন্ধ।চিলেকোঠার যে ঘরে হারমোনিয়াম বাজাতে বাজাতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো কোন রুগ্ন তরুণীর দুটো হাত সে হাতে আমি ঠোঁট  বুলিয়েছি।আজ জানিনা সে চিলেকোঠার শিকল আলগা করে রেখেছে কিনা আমার জন্য। ঠোঁটের ওপরে এখন তার হাতের বিচ্ছেদসমূহ লেগে আছে।ঠোঁটেই আমার সেই গান আসে।একটা আশ্চর্য গান আমি পথে পথে গেয়ে যাই শীতের রাতে নিজের অজস্রকে দাহ করে এসে।বুকের ভেতর এভাবে একের পর এক খুলে যাচ্ছে কপাট অথচ ভেতরে সমস্ত আকাশ ঝরে গেছে।অহেতুক ঘুরে ঘুরে এই মাতাল শহরের বুকে কারও নিমন্ত্রণ পাইনি আমি।কেউ এসে দুহাতের জমিতে আমাকে একটা ঘর গড়ে দেবে।সারাদিন অভুক্ত,আটাশটি উটের ছায়া আমার শরীরে দিনরাত খেলা করছে।শীতের গভীর রাত এসেছে,এখন অনন্ত সঙ্গমের সময়।অথচ জীবনকে আহত বাঘের মতো প্রত্যাঘাত করতে পারিনি আমি।ক্ষমা করেছি আর ওমনি জীবন আমাকে গিলে খেয়েছে।আমি তার উদরের মধ্যে ঘুরে বেড়াই আর শ্মশানের মধ্যে পোড়ানো হয় আমার যৌবন।বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।কীর্তন থেমে গেছে,দূরের রাস্তা থেকে আসছে শববাহী যানের শব্দ।আমার আত্মা শীতল,পায়ে একফোঁটা শক্তি নেই হেঁটে যাওয়ার।সামনের পথ শেষে এক বিরাট নদীর কালো জল।অথচ আমি সাঁতার শিখিনি।চলতে হবে সামনে কারণ আমার পিঠে এক অদৃশ্য বন্দুক ধরে রেখেছি আরেকটি আমি।তার পেছনে আরেকটি বন্দুক,আরেকটি আমি,আরেকটি আমি এভাবে দীর্ঘ এক শোভাযাত্রার মতো চলেছি নদীর দিকে।আজ ভাসানের দিন।আমার যৌবন পোড়ানোর অস্থি ভাসিয়ে দিতে হবে নদীতে।যুদ্ধটা জেতা হল নাকি হারা হল বোঝা গেলো না।
নদীতে যাওয়ার পথে বাড়ি বাড়ি কড়া নাড়িয়ে যাই,কেউ কি আছে,কেউ আছে,আমাকে বাঁচাবে?কেউ কি আমাকে রক্ষা করবে আজ রাতে?কেউ কি বুকের ভেতর লুকিয়ে নেবে আমায়?আত্মধ্বংসী এই যাত্রা থেকে আমাকে উদ্ধার করার জন্য সামান্য এক বুকের উষ্ণতা চাই।আমার আত্মা অসম্ভব শীতল তবে তার থেকে বেশি শীতল নদীটির কালো জল,পিঠে  ঠেকানো বন্দুকের নলটি
কেউ দরজা খোলে না।কড়া নেড়ে নেড়ে উন্মাদ হয়ে যাই আমি।উন্মাদের দৃশ্য অতিক্রম করে বেড়ে যাচ্ছে বয়স।কেউ দরজা খুলতে পারেনা।অথচ আমি শুনছি চিলেকোঠা থেকে এখনও হারমোনিয়ামের সুরটা বেজে যাচ্ছে।আর তাতে গলা মিলিয়ে যাচ্ছে আমার জন্মের পর জন্ম,জন্মের পর জন্ম চেনা গলাটি।
মিলিয়ে যাচ্ছে আমার কড়া নাড়ার শব্দ।মিলিয়ে যাচ্ছে শোভাযাত্রার সমস্ত প্রবল বাজনা,আলো,বারুদের গন্ধ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।