রবীন্দ্রনাথ আমার বন্ধু।তিনি আমার”নিভৃত প্রাণের দেবতা” নন।
“জিওল গাছের বেড়ার ধারে ” যে পুকুরপাড় , সেইখানে তার সঙ্গে ছোট্টবেলায় দেখা হয়েছিল।আর “ঝাউতলা জুড়ে” আমার মায়ের সঙ্গে আমি নতুন করে থাকতে শুরু করেছিলাম নিজের বানানো একটা কুঁড়ে ঘরে। আমার মা আমার সঙ্গে রবিঠাকুরের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
তখন বৃষ্টি মানে ” ঘন মেঘ বলে ঋ, দিন বড় বিশ্রী।”
আর সেটা কেটে গেলেই ” গগনে গগনে বরষণ শেষে মেঘেরা পেয়েছে ছাড়া।” আমাদের পাড়ায় প্রতি বছর ঋতুরঙ্গ হত। আমি সেই কোন ছোটবেলায় শুকতারা চিনেছি শরৎকালের শুরুর গানে, চিনেছি নীল দিগন্তে ‘ফুলের আগুন।”
কেন জানি না, আমি টকটকে লাল অনেক কৃষ্ণচূড়া দেখতে পেতাম এটা গাইলে।পলাশ তখনো চিনতাম না। কিন্তু ফুলের আগুন ছুঁয়ে ফেলেছিলাম।
সেই ছোট্ট বেলায় জেনে গিয়েছিলাম, “গগনে গরজে মেঘ ,ঘন বরষা ” মানে ই সেটা বৃষ্টির কবিতা নয়। তখন না বুঝেই গাইতাম” আরো প্রেমে ,আরো প্রেমে /মোর আমি ডুবে যাক নেমে।”
‘আমি’ টাকে যে কীভাবে ডুবিয়ে ফেলতে হয় এ বয়সে এসে বুঝি।ক্লান্ত আমি, রিক্ত আমি বুঝি “সকল অহংকার” কে চোখের জলে কেন ডুবাতে হয়,আজ নতুন করে চিনি “দুঃখ রাতের রাজা” কে।
আমার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও বড় হয়েছেন। কৈশোরে ছুটি গল্পটা পড়তে পড়তে কাঁদতাম খুব আমি আর রবীন্দ্রনাথ। ” এক বাঁও মেলেনা, দুই বাঁও মেলেনা।” কোন এক বিপুল সমুদ্রের মতো জীবনে রবীন্দ্রনাথ আমাকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতেন, ঢেউ এসে আবার আমাকে আমার চোদ্দ বছরের বিছানায় আছড়ে ফেলতো। আমার কিশোর বয়সে শেখা গান ” স্বার্থ হতে জাগো, দৈন্য হতে জাগো, সব জড়তা হতে জাগো জাগো রে। ”
সেই যে আমার বন্ধুটি কানে গুপ্ত মন্ত্র দিলো ‘ সব জড়তা’ থেকে জাগার, আমি বড় হয়ে গেলাম। ” যেখানেতে অবাধ ছুটি” , সেখানে ডানা মেলে উড়তে শিখলাম, শিখলাম নিজের থেকে “বাইরে” দাঁড়াতে।
এই ” বাইরে দাঁড়া” র যে কমান্ডটি তিনি করলেন, কোথায় একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেলো মগজের কোষে কোষে, সেই থেকে আজ ও ছুটোছুটি চলছে প্রাণের মাঝখানটিতে যেখানে ছুট ও আছে ছুটিও আছে।