• Uncategorized
  • 0

গদ্য বোলো না -তে সঙ্কর্ষণ

এও এক গর্ভপাত

সকলেই দেখলেন সে গর্ভবতী ছিলো। সকলেই বুঝলেন একাকী নয়, গর্ভস্থ প্রাণটিকেও সে বিস্ফোরণজনিত উত্তাপ থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলো। সকলেই শুনলেন সে সাধারণ মানুষ তো বটেই হন্তারকদেরও বিন্দুমাত্র ক্ষতি না ক’রে নীরবে জলে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ ক’রেছিলো। কিন্তু যে বিষয়টি অধিকাংশই লক্ষ্য ক’রলেননা যে উদ্ধার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সে ঐ স্থানটি ত্যাগ ক’রলোনা। একান্তই যদি কেউ লক্ষ্য ক’রেও থাকেন, সকলেই ভাবলেন হয়তো মানুষকে সে আর বিশ্বাস ক’রতে পারেনি ব’লেই তার এহেন পদক্ষেপ।
বস্তু মিলিয়ে যাবার মতো বিশ্বাস একে ‘মোক্ষলাভের’ নাম দিলেও আসল কথা হ’লো মানুষের দ্বারা প্রতারণার পরবর্তী বিচারের থেকেও তাৎক্ষণিক শুশ্রূষার বিষয়ে সে অন্ততঃ সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ওপর ভরসা রেখেছিলো। সে নিশ্চিত ছিলো, এই সুন্দর পৃথিবীতে কোনো নিরপরাধের মৃত্যু হয়না, এ প্রচণ্ড যন্ত্রণাও কেবল সাময়িক, প্রাণ হারাতে তাদের কোনোভাবেই হবেনা।
শৈশবে শুনেছিলাম অত্যন্ত হাস্যরসাত্মক এক পৌরাণিক কাহিনী। মা লক্ষ্মী নাকি একদিন তাঁর স্বামী শ্রী নারায়ণের পদসেবা ক’রছিলেন, হঠাৎই দূরে কোথা থেকে যেন সামান্য বিস্ফোরণের মতো আওয়াজ ভেসে এলো। মা লক্ষ্মী অত্যন্ত আতঙ্কিত হ’য়ে স্বামীকে ব’ললেন, “প্রভু? “। স্বামী হেসে বললেন, “ও কিছু না, রাবণ পৃথিবীতে জন্ম নিলো।”। কমলা তা শুনে নিশ্চিন্ত হ’য়ে আবার পদসেবায় মন বসাতে যাবেন, তৎক্ষণাৎ আরেকবার ঐ একই আওয়াজ হওয়ায় আবারও তিনি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকালেন। কমলেশ হেসে উত্তর দিলেন, “ও কিছু না, রাবণ মারা গেলো।”, তারপরে আরামে চোখ বুজলেন।
কাহিনী যতোই হাসির উদ্রেক ক’রুকনা কেন, অন্তর্নিহিত দর্শনটি হ’লো মহাকালের বিচারে মানবজীবনের পরিধি নেহাতই তুচ্ছ। সেই তুচ্ছ জীবনকালের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সময়টুকু মানুষকে গৃহবন্দী হ’য়ে থাকতে হ’য়েছিলো, সে ঈশ্বর, প্রকৃতি, আইন, নিজস্ব তাগিদ, যে কারণেই হোকনা কেন। বর্তমানের ভয়ালতম মারণবীজাণুর প্রকৃতি সম্পর্কে গবেষণায় জানা গেছিলো যে কোনো কৃত্রিম উৎপত্তি নয়, এরা বহুকাল ধ’রেই ‘মনুষ্যেতর’ বহু প্রাণীর শরীরে সহাবস্থান ক’রছিলো এবং বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বৃহত্তর কোনো চারিত্রিক পরিবর্তন না ঘ’টলে ভবিষ্যতেও হয়তো তাইই ক’রবে। কিন্তু প্রাণধারণের তাগিদে তো বটেই (আমিষাহারকে নয় খাদ্যশৃঙ্খলের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যই মেনে নিলাম), কেবল আনন্দ ক’রতেও আমরা এতো বিশাল সংখ্যক প্রাণীকে অকারণে হত্যা ক’রেছি যে এই বীজাণুগুলি এবার মানবদেহে আশ্রয় খুঁজছে এবং মানবদেহ ও তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এহেন মিত্রতায় অভ্যস্ত নয় ব’লেই আজ তার অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মশৃঙ্খলার একাংশ যে আমরা নিজে হাতে অবলুপ্ত ক’রে দিয়েছি এই হ’চ্ছে তার প্রমাণ।
ধর্মাচরণের ভিন্নতর অভিমুখ সম্পর্কে আমার জ্ঞান অতি সামান্য। তৎসত্ত্বেও এটুকু সকলেই জানি যে কোনো এক অজানা, অদেখা বা অস্তিত্বের প্রেক্ষিতে প্রমাণিত বা অপ্রমাণিত ঈশ্বর আমাদের পালনকর্তা। এ পৃথিবীতে সমস্ত ধর্মের সর্বজনসম্মত শাস্ত্রজ্ঞ দার্শনিকরাও ঠিক এই কথাই ব’লে গেছেন। আমরাই শুধু বারংবার ভুলে যাই যে “তিনি সর্বত্র আছেন।”। যাঁরা তাঁকে চায়, যাঁরা তাঁকে চায়না, যাঁরা তাঁর কথা ভাবে, যাঁরা তাঁর কথা ভাবেনা, তিনি প্রত্যেকেরই ‘পরমপিতা’। তিনি “সতেরও মা, অসতেরও মা।”। তবুও কোথাও যেন খুব সাধারণভাবেই তিনি মানুষের প্রতি অতিরিক্ত ক্ষমাশীল আর নয়তো তিনি কোনো এক চরমতম মুহূর্তের অপেক্ষা ক’রছেন। একেবারে মানুষেরই মতো হ’লে তিনিও শত্রুর শেষ রাখতেননা, ব’লে উঠতেন, “হন্তারক, তোমরা কখনও অমৃতের পুত্র হ’তে পারোনা। তোমাদের পালন নয়, নিধনই কেবল শ্রেয়”।
পরিচিত এক লেখকের গল্পে সঙ্গমের দৃশ্যের বর্ণনা প’ড়েছিলাম, “তেহ মানুহ বানায়।”। গল্পের নায়কের মুখ দিয়ে তিনি ব’লিয়েছিলেন যে এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের চোখে নূতন প্রাণের সৃষ্টি আসলে কতোখানি পবিত্র। দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এভাবেই অশ্লীলতার চাদরে আমাদের স্বাভাবিকত্ব ঢেকে রাখে। মনে পড়ে জ্ঞানবৃক্ষের ফলে কামড় দিতেই ইভের মনে লজ্জাবোধ সৃষ্টি হওয়ার কাহিনী। আমি জানিনা হস্তিনীর পক্ষে একেবারে মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া পোষণ করা সম্ভব কিনা, তবে এটুকু অবশ্যই বুঝি যে সে একজন মা। সে ওটুকু গলাধঃকরণ কেবল নিজের জন্য করেনি, গর্ভস্থ সন্তানের জন্যেও ক’রেছিলো।
“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবোধীঃ কামমোহিতম্।”। মা তুমি এক প্রাণঘাতী দস্যুর মুখে এতো জলদগম্ভীর অথচ এতো সুললিত বাক্যবন্ধ ব’সিয়ে দিতে পারলে, কিন্তু অপরের মুখ দিয়ে অভিশাপের পরিবর্তে সামান্য এক ব্যাধকে প্রাণীহত্যা না করার সুবুদ্ধিটুকু দিতে পারলেনা কি আজকেরই মতো এক চরম মুহূর্তের অপেক্ষায়? বিষয়ের ভিত্তি স্থাপিতই যদি রক্তপাতে হয়, ছুটন্ত বাণ তো বিস্ফোরকের উত্তরাধিকার বহন ক’রবেই…
আসলে মনুষ্যত্ব স্বয়ং একটি দর্শন আর মানুষের স্ব-আরোপিত নিয়মে মনুষ্যসৃষ্ট বিজ্ঞানের শেষেই কেবল যেকোনো দর্শনের আরম্ভ হ’তে পারে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।