গল্পকথায় অপর্ণা চৌধুরী

করুণা

[ গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক ]

করুণার সঙ্গে আমার আলাপ হয় মুম্বাইতে। আমার পাশের ফ্ল্যাটে ওরা থাকতো। আমি আজন্ম কোলকাতায় মানুষ, কিন্তু বিয়ের পর কোলকাতা ছেড়ে স্বামীর কর্মস্থল মুম্বাইতে চলে যেতে হল। আমার মত ঘরকুনো, অন্তর্মুখী মেয়েকে যখন মুম্বাইয়ের মত বড় শহরে যেতে হল তখন সত্যি বলতে কি মনে পুলকের চেয়ে বুকে দুরু দুরু বেশী হয়েছিল। 
বাঙালি মা বাবা তাদের মেয়েকে খুব যত্নে মানুষ করেন। বেশীর ভাগ বাড়ীতেই মায়েরা মেয়েকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেন না। বলেন,” থাক যতদিন আমার কাছে আছে। বিয়ের পর তো করতেই হবে । তখন ঠিকই শিখে যাবে।“
এখানে অনেকেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন অবাঙালী মেয়েরা কি যত্নে মানুষ হয় না? তাদের কাছে আমি মাফ চেয়ে নিচ্ছি, হয়তো আমি পক্ষপাত দুষ্ট। কিন্তু আমি অনেক অবাঙালী পরিবারে দেখেছি মেয়েরা কোমর বেঁধে বাড়ীর কাজ করছে থুড়ি কাজ শিখছে। শ্বশুরবাড়ী গিয়ে যাতে কোন অসুবিধা না হয়। 
রবিবার সকালের জলখাবারে ম্যাগি বানানো পর্যন্ত আমার রান্নার দৌড় ছিল। কিন্তু নিজেকে মনে করতাম দারুণ রন্ধন পটীয়সী। এখন বুঝতে পারি মানুষ নিজের সম্বন্ধে এরকম অনেক ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণাগুলো বদলে যায়। যেমন মুম্বাই গিয়ে প্রথম দিন ডিমের ঝোল আর ভাত রান্না করার পর আমারও বদলে ছিল। যাক, সে গল্প আরেকদিন হবে।
মুম্বাইয়ে আমরা যেখানে থাকতাম সেখানে আশেপাশে সবাই ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের। সারা ফ্ল্যাটে দুটি পরিবার ছিল অন্য সম্প্রদায়ের। আমরা আর করুণারা। আমাদের মতই ওদের ও নতুন বিয়ে হয়েছে। 
সাফাইওয়ালাকে ডাস্টবিন দেবার সময় প্রথম চোখাচুখি। একটা টিপ পরা মুখ দেখে আমি প্রথমে একটু হতভম্ভ হয়ে একটা অপ্রস্তুত হাসি হাসলাম। 
ও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে বলে উঠলো,” পুরে বিল্ডিং মে হাম দোনো হি, লাইক।“
আমি একটু অবাক হয়ে তাকাতে ও বলল,” হিন্দু। আই অ্যাম করুণা।“
যদিও আমাদের পড়শিরা খুবই সহৃদয় ছিল কিন্তু কেন জানিনা এই মেয়েটির প্রতি আমার একটা বিশেষ দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। আমি মানুষটা খুব একটা মিশুকে নই কিন্তু তাতে করুণার খুব একটা কিছু যেত আসতো না। ও ওর ভাঙা ভাঙা ইংরাজি মিশ্রিত হিন্দিতে আমার সঙ্গে ওর মনের প্রাণের গল্প করে যেত। 
করুণা ম্যাঙ্গালোরের কাছের একটা গ্রামের মেয়ে। জীবিকার সন্ধানে এসেছিল মুম্বাই। একটি নাইট ক্লাবে ও নাচতো। আমি শুনেই বেশ শঙ্কিত হয়ে উঠি। হিন্দি সিনেমার দৌলতে নাইটক্লাবে নাচা মেয়েরা যে খারাপ মেয়ে হয় এই ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল ছিল। কিন্তু ওকে যত চিনতে শুরু করলাম তত বুঝতে পারলাম ও আমারই মত একটা সাধারণ মেয়ে। স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার করতে চায়। ভোরবেলা কাজ সেরে ফেরার পথে রোজ বাজার করে নিয়ে আসে। তারপর স্নান করে রান্না করে ঘুমিয়ে পড়ে। বেলায় জন আসলে একসঙ্গে খায়। 
ওর স্বামী জন, খ্রিষ্টান। জনের সঙ্গে ওর দেখা হয় নাইট ক্লাবেই। সেখানেই আলাপ এবং প্রেম। তারপর ওরা এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়ে সংসার পাতে।  ওর বাড়ীতে ওর ঠাকুরের সিংহাসনে জিশুখ্রিস্ট আর কোরাগাজ্জার ছবি পাশাপাশি রাখা থাকতো। কাজ থেকে ফিরে স্নান করে দুজনকেই ধূপ দেখাত করুণা। 
আমার সঙ্গে ওর দেখা সাক্ষাত হত কমই। কারণ আমার কাজ ছিল দিনে আর ওর রাতে। যখন আমি বাড়ী ফিরতাম ও বেরত। যেদিন ওর ছুটি থাকতো ও আসতো বা আমি যেতাম ওর বাড়ী। 
আমাদের পড়শিরা অবশ্য আমাদের এই মেলামেশাকে একেবারেই ভালো চোখে দেখত না। অনেকেই আমার বাড়ী বয়ে এসে উপদেশ দিয়ে যেত যে আমি যেন সাবধানে থাকি ও মেয়ে সুবিধের নয়। আমি যেহেতু স্কুলে পড়াতাম তাই সকলে আমাকে ডাকতো ‘টিচার দিদি’ বলে। আমি যখনই সকালে স্কুলে যেতাম পাড়ার মোড়ে আড্ডা মারা ছেলের দল চুপ করে যেত। আমি চলে গেলে আবার তারা হইচই শুরু করত। এতো সম্মান আমায় এর আগে আর কেউ দেয়নি যা এই অশিক্ষিত তথাকথিত ‘বখাটে’ ছেলেগুলো আমাকে দিত। 
একবার আমরা কোলকাতা থেকে ফিরেছি। ট্রেন লেট ছিল তাই পৌঁছেছি রাত দুটোয়। আমাদের ফ্ল্যাট চার তলায়। লিফট ছিল না। আমি আর আমার স্বামী দুজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি কি করে ওই বিরাট বিরাট সুটকেসগুলো নিয়ে ওপরে উঠব। হঠাৎ কোথা থেকে দুটো ছেলে এসে উপস্থিত হল। ওদের নাকি পরীক্ষা, তাই ওরা রাত জেগে পড়ছিল। জানালা দিয়ে আমাদের দেখতে পেয়ে নেমে এসেছে। 
“ টিচার দিদি আপলোগ যাও হাম সামান লেকে আ রহে হ্যায়।“ বলে আমাদের অনুমতির অপেক্ষা না করে সুটকেস দুটো মাথায় করে ওপরে পৌঁছে দিয়ে গেলো। 
আবার এই ছেলেগুলোই করুণাকে দেখতে পেলে আসম্ভব অশ্লীল ইঙ্গিত করত। ওর পক্ষে রাস্তা দিয়ে চলা মুশকিল ছিল। পেশার কারণেই করুণার সাজগোজ ছিল খুবই উগ্র। কিন্তু সেই করুণাই যখন স্নান করে ভেজা চুলে ঠাকুরের আসনে ধূপ দেখাত ওকে দেখে কে বলবে যে ও সারারাত কতগুলো মদ্যপের সামনে নেচে এসেছে!
আমার কাছে ও ওর মনের প্রাণের সব কথা বলত। ওর যখন চোদ্দ বছর বয়স তখন ওর বাবা মারা যায়। ওরা ছয় ভাইবোন। ওর ওপরে ওর বড়দা।  সেই সংসারের দায়িত্ব নেয়। কিন্তু বছর দুয়েক আগে ওর দাদা নারকোল গাছ থেকে পড়ে যায়। ফলে তার কোমর ভেঙ্গে যায়। আর বিছানার থেকে উঠতে পারে না। মা দিন মজুর। যা রোজগার করে তাতে ওদের খাওয়া চলে কিন্তু দাদার চিকিৎসা চলে না। তাই বাধ্য হয়ে করুণা এক এজেন্টের সাথে চলে আসে মুম্বাই। ওকে দেখতে সুন্দর ছিল তাই নাইট ক্লাবে চাকরি পেতে কোন অসুবিধা হয় না। 
ওদের নাইট ক্লাবটা ছিল মাসগাও, ভাইখালাতে। ওখানেই জনদের বাড়ী। প্রায়ই পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে আসতো ওই নাইট ক্লাবে। 
ও যেদিন প্রথম নাচে নাইট ক্লাবে, সেদিনই জন ওর সাথে আলাপ করে । 
“তোমাকে তো আগে দেখিনি।“
“ না আমি নতুন এসেছি। আজই প্রথম দিন।“
“ আগে কোথায় কাজ করতে?“
“ এই প্রথম কাজ করছি।“
“ হুম! বুঝতেই পারছি । এতো লজ্জা পেলে কি আর নাইট ক্লাবে নাচা যায়! যখন কেউ পয়সা দেয় গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। নাহলে আর সেটা তুমি পাবে না।“ বলেছিল জন ।
মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল করুণা। সেদিন কাজ শেষ করে যখন বেরোচ্ছিল বাড়ী যাবার জন্য তখন ওর আবার দেখা হয় জনের সঙ্গে। পরে জানতে পেরেছিল যে ওর সঙ্গে দেখা করার জন্যই জন ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল।
তখন করুণা আবার সেই গ্রামের মেয়ে, মুখে কোন মেকআপ নেই, একটা সাধারণ সালওয়ার কামিজ পরা। রাস্তায় যেতে যেতে ওর সঙ্গে অনেক কথা হয়। 
এরপর থেকে প্রতিদিনই জন আসতো ওই নাইট ক্লাবে। ওকে দর্শকদের মধ্যে দেখলেই একটা অদ্ভুত ভরসা পেত করুণা। কেউ ওর সাথে অসভ্যতা করতে সাহস পেত না। 
গ্রাম থেকে ভাইয়ের চিকিৎসা করানোর জন্য টাকা জোগাড় করার ব্রত নিয়ে ও এসে পড়েছিল এই বিশাল শহর মুম্বাইয়ে। তখন ওর কোন ধারনাই ছিলনা যে ও কি অবস্থার সম্মুখিন হতে চলেছে। সেই অকূল পাথারে ও জনের মত একজন মানুষকে পেয়ে একেবারে আঁকড়ে ধরে।
তাই জন যখন ওকে ওর পুরনো ডেরা ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে আসতে বলে তখন ও সানন্দে রাজি হয়ে যায়।  
করুণার গল্পের সিংহভাগে থাকতো ওর মায়ের কথা, ভাইয়ের কথা, ওদের গ্রামের কথা। কখনো কখনো নিজের ভবিষ্যতের কথাও বলতো। একটা বাচ্ছা চায় ও। একটা মেয়ে। তাকে ও মনের মত করে মানুষ করবে। নিজের গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাবে। দেখাবে ও কোথায় বড় হয়ে উঠেছে। এইসব কথাগুলো বলার সময় ওর মুখে একটা অদ্ভুত মোলায়েম ভাব আসতো। মনে হত ও মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছে সব। আমি কোন কথা না বলে চুপচাপ শুনতাম। কথা বলে ওর দিবাস্বপ্নটা ভেঙ্গে দিতে মন চাইত না। 
ওর গল্পে জন বা তার বাড়ীর লোকেদের উল্লেখ খুব বেশী থাকতো না। প্রথম দিকে আমি অতটা খেয়াল করতাম না কিন্তু যেমন যেমন দিন যেতে লাগলো আমার মনে কৌতূহলের উদ্রেক হতে লাগলো। কৌতূহল বড় খারাপ জিনিষ। যতক্ষণ না চরিতার্থ হচ্ছে ততক্ষণ প্রাণে শান্তি আসে না। একদিন থাকতে না পেরে আমি জিজ্ঞাসা করলাম,” তুমি জনের বাড়ী যাও না?”
“ হ্যাঁ ……কখনো কখনো……” শুকনো গলায় কথাটা বলে ও এড়িয়ে যায় কথাটা।
আমার মনে হয় ও নাইট ক্লাবে নাচে বলে নিশ্চয়ই জনের বাড়ী থেকে ওকে মেনে নেয়নি। তার পরদিন থেকে আমি আর ওই বিষয়ে ওকে কখনো জিজ্ঞাসা করিনি। 
মাস দুয়েক পরের কথা। সেদিন ছিল রবিবার।  আমরা যথারীতি গড়িমসি করে ঘুম থেকে উঠে সবে চা নিয়ে বসেছি। আমাদের কলিংবেলটা সাংঘাতিক ভাবে বেজে উঠলো। আমি প্রায় ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলতেই  করুণা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ঢুকে এলো । 
প্রথমে তো ও কি বলছে তার একবর্ণও বুঝতে পারলাম না। 
“ ইউ নো লাইক…… জনলাইক…… হিস মাদার লাইক……( এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে লাইক বলাটা ছিল করুণার মুদ্রাদোষ)
ওকে এক গ্লাস জল এনে দিলাম। জল খেয়ে ও খানিকটা ধাতস্থ হল। তারপর যা বলল তা এইরকম – 
জন চারদিন হল আসছে না। চারদিন আগে করুণার সাথে ওর সাংঘাতিক ঝগড়া হয় আর ও বেরিয়ে যায় বাড়ী থেকে।   তারপর থেকে করুণা ওকে অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু ও কোন জবাব দিচ্ছিল না। তখন করুণা বাধ্য হয়ে জনের মাকে ফোন করে জানায় যে জন চারদিন হল বাড়ী আসছে না। আজ জন ফোন করে ওকে বলেছে যে ওর সঙ্গে জন আর কোন সম্পর্ক রাখতে পারবে না। 
“কেন? কি নিয়ে এমন ঝগড়া হল যে ও একেবারে সম্পর্ক ছেদ করতে চায়?” আমরা দুজন অবাক।
বিয়ের আগে জন ওকে একবার নিজের বাড়ী নিয়ে গিয়েছিল। মা এবং বাড়ীর বাকি সদস্যদের সাথে ওকে আলাপ করিয়ে দেয়। জনের বাবা বহুদিন আগে মারা গেছেন। তার কিছুদিন পর ওদের বিয়ে হয় রেজিস্ট্রি করে।  সেখানে ওদের পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিল না। জন বলেছিল ওর মা অসুস্থ তাই আসতে পারেনি। করুণার পরিবারের তো আসার প্রশ্নই ওঠে না। একে তারা বহুদূরে তার ওপর ওর খ্রিষ্টানকে বিয়ে করা ওর মা একেবারেই মেনে নেয়নি। 
জন প্রতিদিন বিকালে আসতো। আর রাতে করুণা যখন কাজে বেরত তখন ও বাড়ী চলে যেত। সেদিন ওর বাড়ীতে ফোন করার পর করুণা জানতে পেরেছে যে জন ওদের বিয়ের কথা এখনও ওর মাকে বলেনি। ও যখন নিজেকে জনের স্ত্রী বলে পরিচয় দেয় তখন ওর মা হতবাক হয়ে যান। এখন ও বুঝতে পারছে, কেন জন ওকে বিয়ের পর কখনো  নিজের বাড়ী নিয়ে যায়নি । 
এরপর করুণা নিজের মাতৃভাষায় জন এবং তার পরিবারজনের সম্বন্ধে অনেক বাছা বাছা বিশেষণ ব্যবহার করতে লাগলো, যার একবর্ণও আমরা বুঝতে পারলাম না। কিন্তু এটা বুঝলাম তাতে আমাদের বিশেষ ক্ষতি নেই ।  
খানিকক্ষণ বাদে ও যখন একটু শান্ত হল তখন আমি জিজ্ঞাসা করলাম,” এখন তো জেনে গেছে। তাহলে আর কি অসুবিধা? প্রথমে কিছুদিন অশান্তি হবে তারপর সবাই মেনে নেবে।“
ও আমার দিকে চেয়ে সজল চোখে হাসল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,” জিন্দাগী লাইক উতনা আসান নাহি হোতা।“ 
জনের মা ওদের সম্পর্কের কথা জানত। ছেলের হিন্দু বান্ধবীতে ওনার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু বৌ হিসাবে উনি একজন খ্রিষ্টান মেয়েকেই চান। 
এখন করুণার কাছে দুটো রাস্তা খোলা আছে হয় ও ধর্ম পরিবর্তন করুক বা জনকে ডিভোর্স দিয়ে দিক। 
আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। আমার স্বামীর দিকে তাকাতে ও আমাকে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলল। 
খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে কি সব ভাবল করুণা। তারপর নিজের মনে বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই বলতে লাগলো,” ধরম নহি ছোড়ুঙ্গি ম্যায় । নহি……” আসতে আসতে উঠে নিজের বাড়ী চলে গেল ও। যাবার সময় ও এতোটাই নিজের চিন্তায় বিভোর ছিল যে বলেও গেল না।
ও বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেতেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম আমার স্বামীর ওপর,” তুমি কোন কথা বলতে মানা করলে কেন? ও বেচারি কত বড় মুশকিলে পড়েছে। আমরা ওকে কোথায় একটু সাহায্য করব তা না আমরা মুখে কুলুপ এঁটে মজা দেখছি!”
আমার স্বামী আমার দিকে চেয়ে স্মিত হেসে বলল,” তা কি বলতে? তুই কনভার্ট হয়ে যা, না কি ডিভোর্স দিয়ে দে?”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
“ এটা ওর জীবন, সিদ্ধান্তটা ওকেই নিতে হবে।“   
“ কিন্তু কোথায় যাবে ও? ও যা কাজ করে তাতে ওর পক্ষে ওর গ্রামের বাড়ীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়…… “
“ জানি সেটা। কিন্তু ধর্ম একটা বিশ্বাস সেটা যে কারুর মনে কতটা গভীর অবধি আছে সেটা এমনিতে বোঝা খুব মুশকিল। এই সমস্যাটা যে একদিন না একদিন দেখা দেবে এটা কি করুণা জানত না?”
আমি আর কোন উত্তর দিলাম না। কারণ দেখলাম এ তর্কের কোন শেষ নেই।
এরপর এক সপ্তাহ কেটে গেছে । সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে এমনিও আমার করুণার সঙ্গে খুব একটা দেখা হত না তার ওপর এই কদিন আমাদের স্কুলে খুব কাজ ছিল তাই আমিও একেবারে শ্বাস নেবার সময় পাইনি। 
রবিবার জন আর করুণা একসাথে এলো আমাদের বাড়ী। দুজনকেই বেশ খুশী খুশী দেখাচ্ছে। ওদের দেখে আমার বুকের থেকে একটা পাষাণ ভার যেন নেমে গেল। যাক বাবা একটা নিশ্চয়ই সমাধান হয়েছে। 
আমি ওদের বসিয়ে কফি বানাতে গেলাম। একটু বাদেই করুণা আমার কিচেনে এসে উপস্থিত। 
“ উওলগ লাইক……বারান্দে মে… সিগারেট……লাইক……”
“ এসো এসো।“ বলে আমি ওকে ডেকে নিলাম।
“ এক গুড নিউজ হ্যায়। আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট। “ লাজুক স্বরে বলল করুণা।
আমি লাফিয়ে উঠলাম,” আরে বাহ! এতো দারুণ খবর! জন কি বলল?” 
খুব ভালো লাগছিল আমার। যাক ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য। এবার ওদের মধ্যের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। 
“ আমি ফোন করে জনকে জানাতেই ও চলে এসেছে। ও খুব খুশী। আমার মনে হয় এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা এখানেই থাকবো আমাদের মত। কি বল?“ বলল করুণা। 
“ নিশ্চয়ই। আই আম সো হ্যাপি ফর ইউ বোথ।“ আমি বলে উঠলাম।
সেদিন আমরা সবাই বাইরে খেতে গেলাম। সারাদিন খুব হইচই করে কেটে গেল। 
রাতে বাড়ী ফিরে আমি খুব খুশী মনে আমার স্বামীকে বললাম,” যাক বাবা ওদের মধ্যে মিটমাট  হয়েগেছে। আমার খুব নিশ্চিন্ত লাগছে।“
আমার স্বামী দেখি অতটা উৎসাহী নয়। একটু চিন্তিত মুখে বলল,” তাই কি? আমাকে যা জন বলল তাতে আমিতো অত খুশী হতে পারছি না। “
“কি বলেছে ও?”
“ করুণা যদি খ্রিষ্টান না হয় তাহলে  জুডের মা ওকে সম্পত্তির থেকে বঞ্চিত করবেন। জুডের ব্যবসা খুব একটা ভাল চলছে না। আর কোন অন্তঃসত্বা মেয়েকে নিশ্চয়ই নাইট ক্লাবে নাচতে দেবে না। তাহলে ওদের চলবে কি করে?”
“ তাহলে?”
“ জন অবশ্য বলছে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে করুণা রাজি হয়ে যাবে……কিন্তু……”
“ হ্যাঁ সেদিন করুণার কথাবার্তা শুনে আমারও ……” ব্যাপারটা মনের মধ্যে কাঁটার মত খচখচ করতে লাগলো।
কিন্তু এরপর ওদের মধ্যে অশান্তি কমে গেল। আমি দেখতাম জন নিয়মিত বাড়ী আসছে। মাঝে মাঝে ওরা একসাথে বাইরে যাচ্ছে। 
পরের মাসে আমার স্বামী মুম্বাইয়ের বাইরে একটা চাকরি পেলো। আমাদের মুম্বাই ছেড়ে চলে যাবার পালা। খুব মন খারাপ করছিল। করুণা আর জন আমাদের জিনিষপত্র প্যাক করা থেকে আরম্ভ করে ট্রেনে ওঠা অবধি সঙ্গে ছিল। 
যখন আমারা বাড়ী খালি করছি তখন আমাদের লফ্ট থেকে একটা কাপড়ে মোড়া কোরান পাওয়া গেল। যে মজুরটি জিনিষপত্র গোছাচ্ছিল সে ওটাকে নিয়ে এসে আমাকে দেখাল,” ইসকা ক্যা করে?” 
আমি বুঝলাম নিশ্চয়ই আমাদের আগে যারা এই বাড়ীতে থাকতো তাদেরই কেউ এটা ফেলে গেছে। বললাম,” ওখানেই রেখে দাও। আমি আর ওটা নিয়ে কি করব?”
করুণা হঠাৎ ওটা নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বলল,” মুঝে দে দো। ইয়ে হামারা নেহি লাইক কিসিকা তো ভগবান হ্যায়! ম্যায় বাজুকে ফারিদাকো দে দুঙ্গি।“
আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই ফরিদা আর তার পরিবার আমাকে করুণার সম্বন্ধে কতবার যে সাবধান করেছে তার ঠিক নেই। আর রাস্তায় যে ছেলের দলটা ওকে যেতে আসতে অপমান করে তাদের মধ্যে ফরিদার দেওর একজন। অথচ……
মুম্বাই ছেড়ে চলে আসার পর করুণাদের সঙ্গে প্রথম দিকে আমাদের যোগাযোগ ছিল কিন্তু মাস দুই তিনেক পর থেকে আর ফোন করা হয়ে ওঠেনি। আমার স্বামী তার নতুন চাকরিতে মন বসানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আর আমি একটি  স্কুলে চাকরি নিলাম। আমার স্কুলের কাছে একটা বাড়ী ভাড়া নিয়েছিলাম আমরা। আসতে আসতে নতুন জায়গায় নতুন বন্ধু হল। আর ব্যাস, নতুন জায়গায় মন বসে গেল। এখন আর মুম্বাইয়ের জন্য মনের ভিতরটা চিনচিন করে না। 
সেবার আমার স্কুলে শীতের ছুটি পড়তেই সব বন্ধুরা বায়না ধরল ,” তোদের বাড়ীতে একটা ক্রিসমাস পার্টি হোক!”
আমরা দুজনেও রাজি। ভালোই তো হইচই করা যাবে। পার্টির জন্য বাড়ী সাজাতে গিয়ে বেরোল পুরনো ক্রিসমাস ট্রি টা। মনে পড়ে গেল  করুণা আর জন ওটা আমাদের উপহার দিয়েছিল। ধুলো ঝেড়ে ওটাকে ঘরের কোনে সাজিয়ে রাখলাম।
অফিস থেকে ফিরে ও ট্রিটা দেখে খুব খুশী হল। বলল,” এটা তো সেই ট্রিটা না যেটা……”
আমি বললাম,” হ্যাঁ, অনেকদিন ওদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। কেমন আছে দুজন কে জানে?”
“কাল বরং একটা ফোন করব ওদের কি বল?”
পরের দিন , ২৫শে ডিসেম্বর, একটু বেলার দিকে আমরা ফোন করলাম। 
ফোনটা বার তিনেক রিং হবার পর জন তুলল,” হাই ! কতদিন বাদে…কেমন আছো তোমরা…… মেরি ক্রিসমাস……” 
ওর গলার আওয়াজ শুনেই বোঝা যাচ্ছিল ও আমাদের ফোন পেয়ে খুব খুশী হয়েছে।  হইহই করে অনেক কথা বলে গেল জন। বেশ খানিকক্ষণ কথা হবার পর আমি বললাম, “ করুণা কোথায়? ওকে দাও, একটু কথা বলি।“ 
জন একটু চুপ করে গেল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,” করুণা নেই। ও ম্যাঙ্গালোর চলে গেছে।  আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।“ 
তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল,” আসলে… আমাদের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল। তারপরই করুণা কেমন একটা হয়ে গেল। আমাকে একদম সহ্য করতে পারতো না। শেষে……”
আমার আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করলো না।  ফোনটা রেখে দিলাম।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।