• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় অরণ্য দেব

২০৪০

২০৪০ সালের জুন মাসের মধ্য দুপুর। কোলকাতার তাপমাত্রা তখন ৭২ ডিগ্রী ছাড়িয়ে গেছে। গোটা শহর জুড়ে গাছপালা অস্বাভাবিক রকমের বেশি কিন্তু সব আর্টিফিশিয়াল রেনট্রি। গুটিকয়েক পুরোনো গাছ যা বেঁছে আছে সেসব কার্বন ডাই অক্সাইডের ধোঁয়া দিয়ে সালোকসংস্লেষ করে। আই আই টি পাউয়াই ইনোভেশন সেল থেকে বছর কয়েক আগেই প্রত্যেকটা গাছের গায়ে ইলেক্ট্রোড বসিয়ে দিয়েছে। যা বাতাস থেকে পিওর কার্বন ডাই অক্সাইড টেনে নিয়ে তাকে কার্বন আর অক্সিজেন মলিকিউলে ভেঙ্গে দেয়। তারপর গাছের গায়ে লাগানো বায়োমেট্রিক ট্রান্সমিটার থেকে প্রত্যেকে নিজের নিজের জন্য বরাদ্দ অক্সিজেন সকাল বেলা নিয়ে নেই। সরকার থেকে আধার কার্ডের সাথে অক্সিজেন কার্ড লাগানো ম্যান্ডেটরি করে দেওয়ার ফলে এই সুবিধে। যাদের যাদের হাঁপানি জাতীয় রোগ আছে তাদের সাবসিডি ছাড়ার জন্য এক্সট্রা ডেটা প্যাকেজও দিয়েছে সরকার। তিলোত্তমা কোলকাতা এখন গ্লোবাল ভিলেজের আর এক নাম। দিল্লি মুম্বাই তেল আভিভ থেকে দলে দলে লোক এসে এখানে উন্নয়ন দেখে আর চমকে যায় একদম। গঙ্গার নিচে ট্রাম লাইন আর তারো নিচে দিয়ে মেট্রো যাবার জন্য সুপার হাই স্পীড হাইপারলুপ চলে বনগাঁ শালিমার অবধি। সময় মাত্র সাড়ে দুই মিনিট। যদিও বিরোধীরা বলে এটা নাকি পুঁজিবাদী চক্রান্ত কিন্তু উন্নয়ন আর যাদবপুরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই এটি সম্ভব হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের বিশ্বাস। রাজারহাট প্রায় বাঘাযতীন ছাড়িয়ে সোনারপুরের কাছাকাছি। কোলকাতার চারিদিকে বিলাস বহুল শহরের প্রত্যেকটি মাপকাটি বেঁধে তৈরী শহর। হাওড়া স্টেশন থেকে প্রতি চার মিনিট পর পর ট্রেন ছাড়ে পুরুলিয়া যাবার জন্য। ওদিকে সুন্দরবন অবধি উন্নয়ন চলছে। প্রতিটি বিল্ডিং মাল্টিসুপার ফেসিলিটি দিয়ে বানানো।
এখানে ইন্টারনেট চলে না। সুপার লেবারিজমের আর সাম্যবাদের পক্ষ থেকে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। ডাইরেক্ট স্পেকট্রাম থেকে হ্যান্ডহোল্ড ডিভাইসে কানেকশন নিয়ে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে
ভয়েড ইমাজিনারি টেকনোলোজি দিয়ে নিজের রেপ্লিকা পাঠিয়ে দেওয়া যায়। পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় যাকে বলে। তবুও কোলকাতায় বর্ষা হয় এখন। বন্ধু চীনের পাঠানো আর্টিফিশিয়াল বৃষ্টি জুলায়ের শেষ থেকে আগস্ট অবধি থই থই করে রাখে প্রিয় শহর। তখন গঙ্গার ধার দিয়ে হেঁটে চলে মানুষজন। প্রত্যেকের বুকের কাছে পেসমেকারের মত লাগানো থাকে সহিষ্ণুতা মাপার যন্ত্র আর পকেটে থাকে একটা করে মব জাস্টিস আইডেন্টিফায়িং ডিভাইস। কেও খাবার খায় না কোলকাতার লোকেরা। অনেক বছর আগে এখানে একবার ভাগাড়ের মাংস খাবার ফলে প্রত্যেকের স্টমাচ সিস্টেমে বড়সড় পরিবর্তন আসে তারপর প্রত্যেকে খিদে পেলে অ্যালকোহোল মাপার যন্ত্রের মত একটা করে যন্ত্র মুখের কাছে ধরে। সেটা থেকে নানান খাবারের গন্ধ আর ছবি বেরোয়। সেই ছবি বুকে বসানো যন্ত্রের মাধ্যমে ডাইরেক্ট ম্যানুপুলেট হয়ে সেভেন ডি ডাইমেনশনে পেটের ভেতর ঢুকে যায়। প্রতিটি মোড়ের মাথায় এরকম একটা করে দোকান আছে। কেও কেও চাইনিজ দোকানও খুলেছেন।
আমাদের গল্পের নায়ক নায়িকা হচ্ছে উৎসব আর উপাসনা নামে একজোড়া কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়ে। উৎসব থাকে সেই আসানসোলে আর উপাসনা থাকে শিলিগুড়ির দিকে। সেই জুনের দুপুরে যখন চারদিকে রোমান্টিক হলুদ আসিড বৃষ্টি হচ্ছিল উৎসব বাড়িতে ল্যাপটপের সামনে বসে সিলিগুড়িতে ভার্চুয়াল ট্রাভেল করছিল। ওর বন জঙ্গল ভালো লাগে। এদিকে কোথাও নেই বলে মাঝে মাঝেই সময় পেলে গুগল থেকে সফটওয়্যার নামিয়ে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায়। তো সেইদিন ঘুরছিল শিলিগুড়ির কাছাকাছি করোনেশন ব্রিজের ওপর। হঠাত দেখতে পেল একটা পাইন গাছের মাথার ওপর একটা বেনেবৌ পাখি। উৎসব তো অবাক পুরো। বেনেবৌ সেই ১৯৯০ সালের পর থেকে কোত্থাও পাওয়া যায় না। এত বছর পর ছোট্ট হলদে রঙের একটা পাখি ইতিউতি ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়ছে দেখে অবাক লাগলো ওর। উৎসব পাখি, গাছ, পাহাড় আর নদী ভালোবাসে। পাখিটার ছবি তুলবে বলে যেই চোখের চশমায় লাগানো ক্যামেরাটায় কমান্ড দিল ওমনি পাখিটা ফুড়ুৎ। সটান উলটো দিকের তিস্তা পেরিয়ে একদম রামলিং বাজার পেরিয়ে লেপচা বস্তির মাথায় বসে পেট চুলকোতে শুরু করলো। উৎসর তো রেগে আগুন একদম। আচ্ছা ত্যাঁদড় পাখি তো।
দেমাকে একদম মাটিতে পা পড়ছে না। উৎসবও চলল পিছু পিছু। আজকে পাখিটার ছবি নিয়েই ছাড়বে সে। পঞ্চাশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া একটা পাখি কি করে এখন পাওয়া যায় সেই ব্যাপারে অর উৎসাহ বেড়ে গেছে। প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পর সে লেপচা বস্তিতে পৌছোলো। অনেক কস্টে একটা বিমান নামানো মিশাইল ছোঁড়ার লম্বা পাইপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবার চোখের চশমায় কমান্ড দিলো ৪০০ মিটার। চশমা সেকেন্ডের মধ্যে রেডি, উৎসব দেখতে পাচ্ছে চোখে স্ক্রিণে পাখিটার প্রতিটা মুভমেন্ট। আরো একটু কাছে এগিয়ে যাবার জন্য লোভ সামলতে পারলো না। ৩০০ মিটার থেকে হাই রেজোলিউশন লাইভ ছবি তোলা যায়। যেই ছবিটা শট্ নেবে ওমনি পাখিটা আবার ফুড়ুৎ। জেদ চেপে গেল উৎসবের। পাখিটা উড়তে উড়তে একদম তিস্তা পার করে আরো উঁচুতে উঠতে শুরু করেছে। উৎসব মনে মনে প্রমাদ গুনলো। ওর চোখে লাগানো ডিভাইসে অত ক্ষমতা নেই যে পাখিটাকে ট্রাক করবে। এদিকে আসানসোলের বাড়িতেও স্পেকট্রাম স্পীড মাত্র ৩২৫ গিগাবাইট। সে সঙ্গে সঙ্গে লিভ লাইফ উইথ আনরিয়েল নামের অ্যাপে বন্ধুদের ক্লোজ গ্রুপে এলো। এই গ্রুপটা ডাইরেক্ট স্যাটেলাইট থেকে চালানো হয়। সেখানে আছে প্রচুর বিদেশি বন্ধু। ও অনুরোধ করলো কেউ যেন পাখিটাকে ট্রাক করে একটু। পাখিটা চীনের দিকে গেছে । ওখান থেকে কেও যদি কমান্ড সিস্টেম কন্ট্রোল করে উৎসবের স্পেকসের তাহলে ও ছবি তুলতে পারবে। একজন চ্যাং চুং নামের বন্ধু বলল ও ট্রাক করবে পাখিটাকে কিন্তু বিনিময়ে ওকে কোলকাতার আন্ডার গ্রাউন্ড বিন মাইনিং ওয়ার্ডে ঢুকিয়ে দিতে হবে। লোকটা ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে কীসব একটা স্টার্টআপ চালু করছে। উৎসব রাজি হল।
বিকেলের দিকে উৎসব দেখলো লোকটা ওর পকেটে রাখা ফোরডি রেডিও অ্যাক্টিভ ডিভাইসে কানেক্ট করেছে। উৎসব সঙ্গে সঙ্গে অ্যাক্সেস দিল। চোখে সামনে একটা ১৫ ইঞ্চি স্ক্রিন ফুটে উটলো উৎসবের। স্পষ্ট দেখতে পেল পাখিটা উড়তে উড়তে ভারতের দিকে আসছে আবার। পাখিটার পেছনে একটা ২২ সেলিটনের মাইক্রোওয়েব পাখিটাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে নিজের দেশের দিকে। উৎসব তো অবাক। চ্যাং এতো ভালো মাইক্রো ওয়েব হ্যান্ডেল করে দেখে। হাতের স্পীডের আওয়াজে বেশ বুঝতে পারছে কোড লেখার সাবলীলতা। কিন্তু ওমা একটু পড়েই অর ভুল ভাঙলো। এটা তো চ্যাং নয়। চ্যাং একটা ছবি পাঠিয়েছে শুধু। উৎসব আবার সেই গ্রুপে গিয়ে চ্যাং কে জিজ্ঞেস করলো কি ব্যাপার হে কমরেড! পাখিটাকে ট্রাক না করে ছবি তুলছো কেন? চ্যাং অবাক হয়ে বলল আরে পাখিটা চীনের দিকেই আসছিল তারপর হঠাৎ করে উল্টো দিকে উড়তে শুরু করে দেয়। বাংলাদেশ বর্ডারের কাছাকাছি যাবার পর চ্যাং লক্ষ্য করে অন্য কেউ পাখিটাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে ইন্ডিয়ার দিকে। চ্যাং তারপর তার জিওমেট্রিক লোকেশন আর গ্লোবাল আইপি ট্র্যাক করে দেখে যে আইডিটা পাখিটাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসছে সেটার নাম উপস আন্ডারস্কোর দেশিগার্ল।
সেটার ছবিই ও উৎসবকে দিয়েছে। উৎসব চুপচাপ শুনছিলো। এতসব জটিল কোড, গেট ওর মাথায় ঢোকে না। ও শুধু নদী আর পাহাড় ভালোবাসে। নিজের অনলাইন ভার্চুয়াল নামটাও উৎসবই রেখেছে। কোন চেঞ্জ না করেই। এমন সময় চ্যাং বলল যে আইডিটা পাখিটাকে ট্রাক করেছে সে পাখিটার ছবির সাথে নিজের সিগনেচারও লাগিয়ে দিয়েছে। উৎসব শুনেও শুনলো না কিছু। আচ্ছা ঠিক আছে বলে বেড়িয়ে গেল। ওকে যেতে হবে সেই সাংডিহা। ওখানে টিউশনি পড়িয়ে ফেরার পথে বাবার জন্য মেডিসিন আর নিজের জন্য কিছু বই আনবে, তারপর রাতে বইগুলো শেষ করবে। এই হচ্ছে ওর আজকের প্ল্যান।
রাতে ফিরে আসার পর উৎসব সেই ব্লোয়ার মেশিন থেকে কিছুটা রুটি আলুর দম আর টক দইএর গন্ধ নিয়েছে। তারপর গন্ধটা লাউড থাকার জন্য পেট কেমন কেমন করছিল বলে একটা জেনেটিক্যাল স্মেল ডিফিউজার ইনিজেক্ট করেছে। তাই চুপচাপ শুয়েছিল নিজের ঘরে। এমন সময় ওর মনে পড়লো সন্ধ্যে বেলার কথা। ও ভাবলো দেখা যাক পাখিটাকে ট্রাক করা যায় কিনা। ও গুগলে ডার্ক ওয়েব কানেক্ট করে পাখিটা খুঁজতে গিয়ে মনে পড়লো উপস আন্ডারস্কোর দেশিগার্ল আইডিটার কথা। একটু খুঁজতেই বেড়িয়ে পড়লো আইডিটা। তখন আইডিটা মিশরের নাইল নদীর
কাছাকাছি একটা জায়গায় মুভ করছে। স্পস্ট দেখা যাচ্ছে নদীর ওপর একটা পাথরের ওপর চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে মাঝে মাঝেই কিছু গুনগুন করে উঠছে। আইডিটার স্টাটাস লাইন চেক করতে গিয়ে উৎসব দেখলো সেখানে লেখা- পৃথিবীর কন্দরে,বন্দরে,অন্দরে গিয়ে পৃথিবী দেখতে চাই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।