ছোটবেলায় মুখচোরা ছিলাম। বন্ধু হত না বিশেষ। প্রচুর খোরাক হতাম। এখন ভাবি কি বোq
কা ছিলাম। হাসি পায় ভাবলে। প্রথম বন্ধুত্বের সংজ্ঞা শেখায় ‘কৃষ্ণা’ আর ‘সুদর্শনা’ । তাও আমরা এক কলেজে ছিলাম না। দক্ষিণ কলকাতার তিনটে কলেজের তিনজন। টিউশন পড়তাম অনার্সের একসাথে। কি ভাবে কি জানি বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ‘সপ্তপর্ণী’ বাড়িটা প্রানের আখড়া হয়ে উঠেছিল। আমাদের পড়ার ঘরটা চারতলায় ছিল। তাঁর পাশেই ছিল একটা মহীরুহ। ডালপালা ছড়িয়ে তাঁর বিশাল বিস্তৃতি। খুব সম্ভবত শিরীষ গাছ ছিল। তাঁর ডালে কলকাতায় বসে প্রথম ‘সিভেট ক্যাট’ দেখেছিলাম।
একটা ফুচকাওয়ালা বসত ওই কমপ্লেক্সে। প্রতি শনি, মঙ্গলবার অনার্স ক্লাসের টিউশন ছুটি হত একদিন ‘পাঁচটা’ একদিন আঁটটায়। ঘড়ি বেঁধে সে বসে থাকত। সেদিন তাঁর রমরমে ব্যবসা। বাসভাড়া বাঁচিয়ে ওই ফুচকাটুকুই জুটত। কখন বা ‘স্টপওভার’ অবধি হেঁটে এসে এগরোল। দাম ৬ টাকা তখন। এই হাঁটাটুকুর মধ্যে যে মাদকতা থাকতে পারে সেই প্রথম চেনা।বাবার বারণ ছিল সার্কুলার রোড ধরে হাঁটার। সপ্তপর্ণী র সামনে থেকেই বাসে ওঠার কথা। তবে নির্জন রাস্তায় টিপটিপ বৃষ্টিতে বন্ধুদের সাথে হাঁটার অমোঘ নেশাকে কোন বারণ কবে ঠেকাতে পেরেছে। কবিতা, ছবি, গান সবটুকুই চিনতে শেখা বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে গড়িয়াহাটের ফুটপাত ধরে হাটতে হাটতে। তখন গীটারে বাংলা গানের ঝড় তুলছে সুমন, অঞ্জন, নচিকেতা। আর আমাদের হৃদয় জুড়ে ‘বিটেলস’, লেনন, জন বায়জ, বব দিলান। সবে তখন নেশা ছড়াচ্ছে। মিল খুজতাম। মজার খেলা ছিল এই পূর্ব ,পশ্চিমের মে্লবন্ধন খোঁজায়। খানিকটা নাক উঁচু ভাবও বটে। একটা দেয়াল লিখন ছিল ‘বাবু গো মানুষের চেয়ে ছাগল দামি’। বারবার পড়তাম আমরা লেখাটা আর কিছু বুঝে কিছু না বুঝে হেঁসে গড়াতাম। একবার সপ্তপর্ণীর লিফটে আঁটকে গেছিলাম আমি, কৃষ্ণা আর অনির্বাণ (আমাদের ব্যাচের আমীর খান)।ওই টিউশন ক্লাসে প্রিমিআম কলেজের মেয়েরাও পড়তে আসত। কি হাহাকার তাদের ‘আমরা কোনদিনও লিফটে আটকালাম না আমীর খানের সাথে। এরা আঁটকে গেল।’ খুব হেসছিলাম । বেড়ালের ভাগ্যেও তো শিকে ছেঁড়ে কখনো । ওই আধঘণ্টা লিফটেই ‘জিন্দাগি মেইন বিতাই হুয়ি হাসিন ৩০ মিনিট’।
দেখতে দেখতে অনার্সের তিন বছর শেষ । পোস্ট গ্রাজুয়েসনের পালা এবার। আমি গেলাম বিশ্বভারতী, কৃষ্ণা রইল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তে, সুদর্শনা গেল জে.এন.উ। গ্রীষ্মের ছুটি, পুজার ছুটিতে বাড়ি এসে তিনজনে দেখা করতাম। কোন একজনের বাড়ীতে রাত কাটানো হত। শান্তিনিকেতন এসেছিল ওঁরা আমার কাছে। সেই প্রথম তিন কন্যে মিলে বাড়ীর বাইরে রাত কাটানো। শান্তিনিকেতনের লাল মাটিতে, খোয়াইয়ের ধুলোয়, প্রান্তিক স্টেশনে শুধু ছড়িয়েছিল বন্ধুত্বের অনাবিল রঙ। যত নিষিদ্ধ অলিগলির রহস্য উন্মোচিত হত একসাথে। কবিতা, গান, ছবি, উপন্যাস সবকিছু নিয়ে সে কি মহাসমারহে বন্ধুতা যাপন চলত।
এরমধ্যে প্রেম ভেঙেছে, প্রেম গড়েছে। এই ঝড় ঝাপটা, ভাঙা গড়ার খেলার মাঝখানেই একদিন দেখলাম সুদর্শনা কোথাও নেই। আমার সাথে শেষ কথা হয়েছিল ৯৯ এর ৩১ সে ডিসেম্বর। বলল ‘কাল দেখা করতে পারব না রে । কাজ আছে।’ আমাদের মধ্যে না বলার মত কোন গোপনীয়তা থাকতে পারে তখনও ভাবতে পারি নি। গলাটা ওঁর অসম্ভব বিষণ্ণ ছিল। কৃষ্ণা তখন হিমাচল প্রদেশে । মা বাবার সাথে বেড়াতে গেছে। দিন পনেরো বাদে ফেরার পথে সুদর্শনার সাথে থাকার কথা দিল্লীতে। সুদর্শনা তাঁর মধ্যে পৌঁছে যাবে দিল্লী। দিল্লী সুদর্শনা পৌঁছয় নি। বা পৌঁছেছিল কিনা খবর পাই নি আমরা। কৃষ্ণা ওঁকে দিল্লীতে খুঁজে পায় নি। ওঁর বাড়ীতে বারবার টেলিফোন করলে, ওঁর মা বলতেন ‘আমায় জিজ্ঞেস কোর না’, ওঁর বাবা বলতেন ‘ও ভালই আছে’। খালি মনে হয়েছে আমাদের, বন্ধুদের কাছেও তবে অনেক কিছু লুকনো যায়। আমরা তো একই সাথে চোরা বাঁক খুঁজেছিলাম। আমাদের দুজনের পথ তো সোজাই রইল। শুধু সুদর্শনাই হারিয়ে গেল। কৃষ্ণা আর আমি দিল্লীতে পাশাপাশি সংসারও করেছি। আমার কন্যার আগমনের খবরও কৃষ্ণার পাশাপাশি সংসার করার কালেই এসেছিল। কৃষ্ণা আর ওঁর বর সুমন বিরাট সাংবাদিক এখন। ব্যাংগালরে থাকে ওরা। দুই ফুটফুটে কন্যা ওদের । আমি ব্যাঙ্গালর, দিল্লী, সুইজারল্যান্ড ঘুরে এসে কলকাতায় থিতু। শুধু আমাদের মনে হয়েছে বারবার কোথায় ফাঁক রয়ে গেল আমাদের?
ভুলে গেছিলাম সব । পলি পড়েছে সময়ের।
শুধু যখন চৈত্র মাসের কোন দুপুরে কাঠফাটা রোদের বদলে আকাশ জুড়ে আঁচল বিছায় মেঘেরা আর সন্ধ্যে নামার একটু আগে গাছগুলো ঝড় আসার আনন্দে শিউরে ওঠে ঠিক তখনি বন্ধুত্বের সংজ্ঞার বিদ্যুৎ খেলে যায় সারা আকাশজুড়ে।
এই যেমন আজ হচ্ছে।