গল্পকথায় কাকলি দাশ ব্যানার্জী

আঠারোর জন্মদিনে

দেবী একা ঘরে বসে ভাবেছ … আকাশ পাতাল ফুঁড়ে ভাবনার ঢেউ তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আজ । মনে পড়ছে যেদিন তিন্নি হলো সেদিনের কথা । দেবী মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল , কি রে দুষ্টু ? কি দেখছিস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে? কেউ আসেনি তোকে দেখতে বলে তোর মন খারাপ নাকি ? ধুর …না আসুক কেউ, আমি আছি না ….তোর বন্ধু …. বলেই নিজের বুড়ো আঙুলের সাথে তিন্নির কচি বুড়ো আঙুলটা ঠেকিয়ে বলেছিল ভাব ভাব ভাব ।
সেই থেকে মা আর মেয়ে অঙ্গাঙ্গী । মেয়েকে ঘিরেই দেবীর সব কিছু …
একটু একটু করে বড় হয়েছে তিন্নি ।এখন সেও স্কুলে যায় ।তিন্নি রোজ দেখে সারাদিনের অকথ্য পরিশ্রমের পর শুধু জল ঢেলে নুন চটকে ভাত খাচ্ছে তার মা। কিন্তু ঘরে মাছ আসেনি তা নয় ।দেবীই রান্না করেছে সব কিন্তু তার ভাগ্যে কিছুই জোটেনি । তার উপর ছিল ঠাকমার আর বাবার অত্যাচার ।দেখেছে গভীর রাতে বাড়ি ফিরে মাকে ঘুম থেকে তুলে দেয় বাবা । তারপর হেঁচড়ে খাট থেকে নামিয়ে জোর করে শুইয়ে দেয় মেঝেতে । কাঠ হয়ে খাটে শুয়ে থাকে তিন্নি । একটুও নড়ে না । একদিন এমন সময় মাকে ডেকে ফেলে ছিল বলে বাবা তাকে খুব মার মেরেছিল চুলের মুঠি ধরে । বাবার মুখে কি গন্ধ ।মা আটকাতে এসে সেদিন মাও মার খেয়েছিল খুব।
তাকে না মাকে বাবা মেরে ছিল বলে বাবার হাতে জোরে কামড়ে দিয়েছিল সে । তারপর ঘুম ভেঙে মাকে পাশে না দেখলেও ডাকে না । ও জানে একটু বাদেই মা এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে ।তারপর ওরা দুজনে একসাথে ঘুমাবে ।
অনেকদিন তিন্নি সকালে উঠে মাকে জড়িয়ে ধরে যখন দুগালে দুটো চুমু দিতে গিয়ে দেখছে মায়ের ঠোঁটের ডগায় লেগে আছে রক্ত ।
একদিন স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে তিন্নি দেখে মায়ের চোখের পাশে কালশিটে । ছোট্ট তিন্নি সেদিন সোজা সবার সামনে প্রশ্ন করে , মা তোমায় কে মেরেছে ?বাচ্চাটার দিক থেকে এমন একটা তীর আসবে ভাবতে পারে নি কেউ।মনে আছে তার ঠাকুমা নিজের ছেলেকে ডেকে পরদিন বলেছিল , ওরে পরাণ ওই ডাইনিটার পেটে একটা কালকেউটে জন্মেছে । এখনই ফণা তুলছে…।সেদিন বাড়িতে তিন্নির পিসিও ছিল ,বলেছিল বেশি বাড়ালে দিবি দুটোকেই গলা টিপে মেরে ..… ।তারপর এম এল এ , এম পি আমি বুঝে নেবো ।
শালা সব কটার টিকি বাঁধা আমার এই কেড়ে অাঙ্গুলে ।
দেবী বুঝতে পারছিল এখান থেকে পালাতে হবে মেয়েকে নিয়ে … নচেৎ মুশকিল, দুজনের কেউ বাঁচবে না …. । আর জীবনে বাঁচলেও … ভদ্রভাবে বাঁচা তো নয়ই ।
তিন্নি হঠাৎ একদিন পড়তে পড়তে জিজ্ঞেস করলো , মা তুমি পড়াশুনা জানো তো ?তাহলে কোয়েলের মায়ের মত চাকরি করো না কেন ? তিন্নি জানতো না শুধু সহজ পাঠ পড়তে পারলেই কারোর পড়াশুনা জানা হয়না… তার যে কোন কাগজ নেই । মাধ্যমিকটা দিতেই দিলো না সৎমা আর সৎভাইটা । বাবাটা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা না করলে তার হয়ত এমন দুর্গতি হতো না ।
একদিন মেয়েকে স্কুলে পৌঁছোনের জন্য বাসে উঠেছে হঠাৎ দেখে বাসে ওদের গ্রামের ময়না,ও এখন একটা স্কুলে পড়ায়।একথা সেকথার পর দেবী ময়নাকে বলেই ফেলল ,
–একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারবি ? নাহলে মেয়েটাকে নিয়ে আমাকেও বাবার মতো মরতে হবে ।
ময়না একটা ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল যোগাযোগ রাখিস । বলেই নেমে গেছিল তার স্টপে ।
এই ময়নাই একটা খ্রিষ্টান স্কুলে খাতাপত্র বওয়ার কাজ জোগাড় করে দেওয়ায় দেবী হাতে স্বর্গ পেল যেন । খ্রিষ্টান স্কুলটির সিস্টার তার সব কথা শুনে বলেছিল দেবী চাইলে স্কুল লাগোয়া ফোর্থগ্রেড স্টাফের একটা কোয়ার্টারের ব্যবস্থা হতে পারে সেখানে সে তার মেয়েকে এনে রাখতে পারে । দেবী এক কথায় রাজি । ঠিক এমনটাই তো চাইছিল সে।
তারপর এলো সেইদিন ।মেয়ের আর নিজের জামাকাপড় একটু একটু করে একটা সুটকেসে আগেই গুছিয়ে নিয়েছে দেবী দুদিন ধরে । তিন্নিকেও বলেছে সব । ছোট্ট মেয়েটা খুব উত্তেজিত । সারারাত ঘুমায় নি মা আর মেয়ে ।চুপ করে মরার মত পড়েছিল বিছানায় ।শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে বরটাকেও ঠেকিয়ে রেখেছিল সেই রাতে ।শাশুড়ি আর বরটা সেদিন ঘরে বসে নেশা করছিল খুব, অন্য দিন হলে দেবী বারণ করতো কিন্তু সেই রাতে দেবী কিচ্ছু বলেনি । ননদটাও বাড়ি গেছে কাল। নেশা যখন ওদের দুজনের মাথায় চড়ে গেছে আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়েছে দুটো শরীর তখন শুধু অপেক্ষা । একটু বাদেই দুজনে নাক ডাকতে লাগলো ভোস ভোস করে ।
এই সুযোগে ভোরের আলো ফোটার আগেই নিজেদেরকে আপাদ মস্তক একটা চাদরে ঢেকে নিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে আর স্যুটকেসটা নিয়ে খুব সন্তর্পণে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো দেবী ।
বাইরে ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে । দেবী তিন্নিকে নিয়ে ছুটছে তার নতুন জীবনের সন্ধানে ।

এই স্কুলে দেবী আর তিন্নি খুব ভালোবাসা পেয়েছে সকলের।এখানে আসার পর স্কুলে র সিস্টার রোজ তিন্নিকে এই স্কুলেই ভর্তি করে নিয়েছেন । প্রতি বছর তিন্নি ফার্স্ট হয় । গর্বে বুকটা ভরে যায় দেবীর ।

তিন্নির এখন ক্লাস নাইন ।ও পড়াশুনায় খুব ভালো বলে স্কুলের দিদিমণিরাও তিন্নিকে নিয়ে আশাবাদী । হেডক্লার্ক সমীরণবাবুও খুব ভালোবাসে তিন্নিকে । তিন্নি বোঝে মাকেও ভালোবাসেন তিনি। পুজোর আগে সমীরণকাকু তিন্নির জন্য একটা ফ্রক কিনে তাদের কোয়ার্টারে এসেছেন দেখে তিন্নি ফস করে বলে বসলো
—কাকু, মায়ের শাড়ি আনোনি ?
চমকে উঠলো দেবী … কি বলছে মেয়েটা ? চোখ পাকিয়ে দেবী ধমক দিয়েছে তিন্নিকে ।তিন্নির দিকে তাকিয়ে সমীরণবাবু জিজ্ঞেস করলেন ,
—আচ্ছা তোমার মায়ের জন্য শাড়ি আনলে তোমার ভালো লাগবে ? বেশ আমি আনবো ।
এরপরদিন তিনি দেবীর জন্য শাড়ি আনতেই কি আনন্দ তিন্নির । এই প্রথম সে নিজে ছাড়া অন্য কেউ তার মাকে ভালোবেসে কিছু দিয়েছে । তিন্নি সেদিন রাতে মাকে বলে যদি সমীরণকাকু তার বাবা হতো তবে কি ভালোই না হতো …
দেবী ধমক দেয় তিন্নিকে বলে তিন্নি যেন আর কোনদিন একথা না বলে…
দিন এগিয়ে চলল এভাবেই । তিন্নি মাধ্যমিক স্টার নিয়ে পাস করে সায়েন্স পড়ছে ।
গরমের ছুটি পড়ার কয়েকদিন আগে সিস্টার রোজ মাকে ডেকে বললেন , দেবী আজ একটা কথা বলবো তোমায় , তোমার বয়েস অল্প ।নিজের জন্য কি কিছু ভেবেছো ?
— মানে সিস্টার ?
— মানে আমি বলছি আমি বুঝতে পারি আমাদের স্কুলের ক্লার্ক সমীরণবাবু তোমাকে পছন্দ করেন, আমার মনে হয়েছে তুমিও তাকে পছন্দ করো । কেন তোমরা নতুন করে কিছু ভাবছো না ?
দেবী লজ্জা পায় বলে,সিস্টার এত বড় মেয়ে যার সে কিনা ..
সিস্টার সমীরণবাবুকে ডাকেন … আসলে সিস্টার আগেই সমীরণবাবুর সাথে কথা বলেছিলেন । সমীরণবাবুও রাজি এমনকি তিনি আইনমাফিক দত্তক নিতে চান তিন্নিকেও ।
কিন্তু তিনিও তিন্নির সম্মতি চান । সিস্টার ডেকে পাঠালেন তিন্নিকে । সমীরণবাবু তিন্নিকে কাছে ডেকে বললেন ,
—কিরে মা আমি যদি তোর আর তোর মার দায়িত্ব নিই তুই খুশি হবি তো ? তিন্নি মায়ের মুখের দিকে তাকালো একবার ওর দুটো চোখে খুশির আলো … বলল , সত্যি সত্যি তুমি আমার বাবা হবে ?
টপটপ করে কান্না ঝরে পড়ছে মা আর মেয়ের চোখ থেকে ।

কিন্তু মেয়ের আঠারো পার না হলে কোন সিদ্ধান্ত নয় ।মেয়ের আঠারো পার করে তবেই সমীরণের সাথে ঘর বাঁধবে দেবী– একথা তখনই জানিয়ে দিলো দেবী সমীরণকে ।বলল, তখনও যদি তিন্নি তার চাওয়ায় অনড় থাকে তবেই নতুন ভাবনা নচেৎ নয় । সমীরণও রাজি ছিল ।আর তো কয়েকটা মাস তিন্নির আঠারো পূর্ণ হতে ।
স্কুল বাড়িটা সেজে উঠেছে আজ।আজ আঠারো বছরের জন্মদিন তিন্নির । সে আজ থেকে সাবালিকা ।
স্কুলের দিদিরাই সব ব্যবস্থা করেছে ।
ঘরে ফোনে একটা সানাইএর সুর চালিয়েছে তিন্নি .. আজ শুধু তিন্নির জন্মদিন নয় তো আজ তিন্নির সবথেকে প্রিয় বন্ধুর বিয়ে বলে কথা …।
দেবী ভাবছে ভেবেই চলেছে । তিন্নি এসে ডাকলো মা এসো তোমায় সাজিয়ে দি । বাবাকেও সাজিয়ে এসেছি । আজ না তোমাদের বিয়ে । রেজিষ্টার এসে যাবে তো ..

ও হ্যাঁ আঠারোর তিন্নির এখন থেকে নতুন পরিচয় ও আলো মিত্র তিন্নি সাঁপুই তো মারা গেছে আজ সকালে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।