গল্পকথায় প্রতিমা রায়

লক্ষনের মিথ্যে 

বউ ভাত দে,  বেলা যে গড়িয়ে যাচ্ছে 
ঘরের ভেতরে মেঝেতে  শুয়ে মালতী কোন উত্তর আসে না 
ঘরের সামনে চিলতে বারান্দায় বসে ঘেমেনেয়ে নড়বড়ে টেবিল ফ্যানটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সুইচ অন করতে করতে করতে বলে লক্ষণ —–কাল রাতে ঘুমাতে পারিনি তাই আজ দুপুরে চোখটা জুড়ে এল নাহলে আমিই দুটো রান্না করে রাখতাম পাঁচবাড়ি কাজ করে এসে দুপুরে দুটো রান্না করতে তোর যে বড় কষ্ট হয় জানিরে বউ, কিন্তু কি করি বলনাইটগার্ডের কাজরাতে ফ্ল্যাটের চব্বিশটা দরজা বন্ধ হয়ে যাবার পর মেন গেট বন্ধ করে লিফটের কাছে ফাঁকা জায়গাটায় গায়ে চাদরটা টেনে একটু শুয়ে পড়িকালও শুয়েছিলাম, ফ্ল্যাটের চব্বিশটা ঘর থেকে , সি ফ্যানের আওয়াজ আসছিল এই গরমে রোজই আসে, সেই শব্দে নিজের শরীরটা জুড়িয়ে নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়ি কিন্তু কাল ঘুম এল নারে, মাথাটা  ঝিম মেরে গেল আর তাতেই———-
ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরে মালতী মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে,গায়ের শ্যামলা রংটা ইদানিং জং ধরা লোহার মতো হয়ে গেছে, বুকের ফুলে ওঠা নরম অংশ ও শুকিয়ে কুঁকড়ে গেছে কাজ বাড়ির দেওয়া পুরানো রংচটা শাড়িতে সস্তা গোল টিপ আর থেবড়ানো সিদূরে ঘাম জবজব করছে লক্ষণ মালতীর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে উঠে গিয়ে ফ্যানটা মালতীর মাথার পাশে রেখে এসে ফের বারান্দায় বসে একটা বিড়ি ধরায় ফেনিয়ে ওঠা ধোঁয়া লক্ষণের চারপাশে লক্ষণরেখার গন্ডি ছাড়িয়ে মাথার থেকে ওপরের দিকে ঘুরে ঘুরে , রেলের জায়গায় বস্তি কলোনির ভাঙাচোরা শ্যাওলাধরা ছোপছোপ দাগ পড়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ঘরগুলোতে বাস করা বেঁকে যাওয়া মানুষগুলোকে ছাড়িয়ে, দূরে কোথাও যেন মিশে যেতে থাকে সে পথ বেয়ে আসে একটা বৃত্তখুব চেনা, একটা সুখী গার্হস্থ্য যার অভিমুখ রানাঘাট স্পষ্ট রানাঘাটের পথঘাট, জনারণ্যের ভেতর তিরতির করে বয়ে চলা জীবনস্রোত,মানুষের মুখ তার ভেতর প্রিয়জনেরাবাবা মা ভাইবোন লক্ষণের পরিবার–  সিং পরিবারলক্ষণেরা অবাঙালি উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর থেকে রানাঘাটে এসেছিল চটকলের কাজ করতে দুপুরুষ আগে খান দান উঁচু
ফুঁকতে ফুঁকতে জ্বলন্ত বিড়িটা ছোট হয়ে আসে, মুখ থেকে ঘন ধোঁয়া একটু একটু করে ছাড়তে থাকে  লক্ষণ বেশ একটা সুখের অনুভব  বেশ একটা সুখের অনুভূতি ,তার ভেতর  ঘন হয়ে আসে মালতীর মুখ গঙ্গার ঘাটে ছটপূজা পূজা পূজা ঘোরের ভেতর মালতী এলোফ্রক পরা মালতীফ্রক ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে উঠছে যৌবনদুচোখে আগুন ধরে গেল আগুনের জ্বালা বড় দুর্বিষহ ! শেষে লক্ষণের দুবাহুর ভেতর ধরা দেওয়া মালতী, লক্ষণের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলেআমায় ঠকাস না, কখনও  মিথ্যে বলিস না
 ঠকায়নি লক্ষণপ্রনয় সব কিছু ভাসিয়ে দেয়— ‘ লক্ষণ ভেসে গেল বাঙালি মালতী হাত ধরেভাসতে ভাসতে নিজের পরিবার থেকে অনেক দূরে ঠিকানাএই রেল বস্তির ঘুপচি অন্ধকার ঘরচটকলের ঠিকা শ্রমিক লক্ষণ সিং, বাপ উধম সিং পূর্বতন বাসিন্দা গোরখপুর, উত্তর প্রদেশখান দান বংশবিড়িটা পুড়ে পুড়ে অজান্তে হাতে ছ্যাঁকা লাগে, লক্ষণ সেটা ছুঁড়ে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে দেয়
রিকশা নিয়ে টুং টাং করতে করতে পাশের ঘরে ঢোকে পড়শি মনোজ কিছুক্ষণ পরেই মনোজের বউয়ের  চিৎকার— মিনসে ঘরেএলি কেন?
 ভরদুপুরেও ভরপেট গিলে এসেছে মনোজ এরপর  মুখ নয় মনোজ  মনোজের বউয়ের  হাত  পা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার রূপ নেবেএ বস্তিতে  রোজগার ব্যাপার  এসব ঘরে ঘরে  অভাব দেবতার বাসবস্তির মেয়েমানুষেরা তোলা ঝিয়ের কাজ করে,পুরুষেরা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের নয়তো রিক্সা চালায়, রাস্তায় ট্রেনে হকারি করে, মুটে মজুরের কাজ করে, লটারির টিকিট বিক্রি করে অন্যের ভাগ্য ফেরাতেআর নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে হাত দুটো কপালে তুলে অদৃশ্যে যিনি বসে আছেন তার কাছে কৃপা প্রার্থনা করে লক্ষণ উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার টিনের দরজাটা বন্ধ  করতে যায়, দেখে দরজার সামনে দিয়ে বস্তির একপাল পোষা ছাগল  লেজ তুলে কৃতকর্ম করে ম্যাঁ ম্যাঁ এ,,এ,, করতে করতে চলে গেল, একটা গরু এসে লক্ষণদের টিনের দরজায় খরখর আওয়াজকরে মুখ ঘষতে লাগলো, শুধু সামনের গাছটায় বউ কথা কও পাখিটা সুন্দর সুর করে ডাকছে-বউ কথা কও লক্ষণ থমকে দাঁড়ায় কেন  যে এ পাখির ডাক ওর এত ভালো লাগে ! হয়তো এই টুকরো টাকরা ভালো  লাগাগুলো আছে বলেই শত দুঃখ কষ্টে ও মানুষ বাঁচে মানুষ  ভারি  অদ্ভুত  না !
দরজা টা বন্ধ করে লক্ষণ ফিরে এসে ঘরে ডাঁই করে রাখা পুরানো জামাকাপড় জিনিসপত্রের স্তূপের উপর বসে পড়ে স্তূপের ভেতর থেকে একটা নেংটি ইঁদুর বেরিয়ে এদিক ওদিক দৌড়াতে থাকে ,বোধহয় নতুন আস্তানার খোঁজে দেখে মুচকি হাসল লক্ষণএরাও পরিস্থিতি সামলে বাঁচে! আশ্চর্য জীবন প্রতি মূহুর্তে বাঁচাটা কি অদ্ভুতভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস
মুখ ঘুরিয়ে  দেখে  মালতী  একভাবে শুয়েলক্ষণের নিজের ভেতর থেকে  বেরিয়ে আসা শ্বাসটা ভাঙা  কলসি ভেতর হাওয়া  খেলে যাওয়ার  মতো ফ্যাসফ্যাস শোনায়, বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠেমালতী খুশিতে বাঁচাতে চেয়েছিল তাদের ছেলে ফেলনা কে বুকে ধরে না ! চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মালতী বুকে জড়িয়ে আছে ফেলনাকে, এই বস্তি ঘরের  স্যাতস্যাতে ছাদ মেঝে জুড়ে  উপচানো  খুশির আলোমালতী শেখায় ফেলনা বলবাবা
ফেলনা তাকিয়ে থাকে ভ্যালভ্যালিয়ে
মালতী সান্ত্বনা খোঁজে ছেলে বাবা বলবেআজ না হয় কাল  না হয় পরের দিন । 
মাস গড়িয়ে বছর পাঁচ বছরের  ফেলনাহাবাগোবা ফেলনা তবু নিজের আত্মজ ,বুকের ধনফেলনা কে নিয়ে  স্বপ্ন দেখে মালতী, বাঁচার স্বপ্নঊর্নাভের মতো একটু একটু করে স্বপ্নের জাল বোনে যেমন সবাই করেছেলেকে রেখে রোজই কাজে বেরোয় মালতীপেটের যে দায় আছে ছেলেও বড় বাধ্য ,ঘরের মধ্যে নিজেই নিজের মত থাকে ,কাজের ফাঁকে মালতী এসে ছেলেকে দেখে যায় ,খাইয়ে যায়
 লক্ষনের শ্বাস ভারী হয়ে ওঠে , বুকের সাউন্ড শুনতে পারছে: অভিশপ্ত রাতটা লক্ষণের মনে পড়ছে, স্মৃতির পাতা খসে পড়ে সে রাত সামনে এসে দাঁড়ায়গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ওরাকেমন করে যেন পাশে ফেলনা নেই।  নেই মানে নেইই  ।খোঁজাখুঁজি, থানা পুলিশ—-কর্পূরের  মত উড়ে গেল হাত  পা সমেত  একটা  আস্ত মানুষ গোল গোল শূন্য শূন্য  জীবন!
মালতীর চোখে ঘন সবুজ পিচ্ছিল  শ্যাওলার আস্তরণসে আস্তরণ সরিয়ে কখনও কখনও জিজ্ঞাসা করেআমাদের ছেলে ফিরে আসবে না গো ? ফেলনা ফিরে আসবে?
আসবে তোকত মানুষই হারিয়ে যায় ,আবার ফিরে আসেগলা বন্ধ হয়ে আসেতবু লক্ষণ বলে  ফেলনা ফিরে আসবেঠিক ফিরে আসবে
চকচক করে মালতীর চোখ, বিশ্বাসেভরসায় বুক ভরে বাঁচার অক্সিজেন  নেয় মালতী লক্ষণ বোঝে বুঝতে পারে
উঃ, আজ মনোজ  মনোজের বউয়ের ঝগড়া  থামার কোন  লক্ষণ নেইদুপুরের রোদের মতো ওদের ঝগড়ার পারদ বেড়ে  চলেছেফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে দেয় লক্ষণএতক্ষণে পেটের খিদেটা বেশ চাগড় দিয়ে ওঠেছে মালতীর কাছে  সরে এসে , পরম মমতায়  মালতীর গায়ে হাত দিয়ে লক্ষণ  বলে– —  ওঠ বউ ভাত দেতুইও দুটো খেয়ে নে
একি ! জ্বরে যে গা পুড়ে যাচ্ছে মালতীর মুখে কাছে মুখ টা নিয়ে আসে লক্ষণ ,চিবুক ধরে নাড়ায়—- একবার চোখ মেলে দেখনা বউ
জ্বরের ঘোরে মালতী বিড়বিড় করে— কাঁসার থালায় ভাত সাজিয়ে রেখেছি, পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে মাছের বাটি থেকে মুড়োটা তুলে রেখেছি ফেলনা এলিরে  বাপ আমার  মাছের  মুড়ো যে জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল !
লক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে মালতীর পাশে বুকের ভেতরে একশ হাতুড়ি যেন দমাদম শব্দে পেটাতে থাকে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলনা হারিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর গঙ্গায় ভেসে ওঠা তার পচাগলা দেহটা
মালতীর কাছে ছেলে বেঁচে থাকবে চিরকাল  কিন্ত এই চরম মিথ্যা কথাটা বহন করে  প্রতিদিন লক্ষণ   কি করে বাঁচবে !!

প্রতিমা রায় কবি ও কথাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি থেকে গল্প কবিতা লিখে চলেছেন । 2018 সালে গাঙচিল প্রকাশনী থেকে প্রকাশিতঅন্দরে কোয়ার্টার জীবনউপন্যাসটি বেশ প্রশংসিত হয়েছেএর জন্যনীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী স্মৃতি পুরস্কার পান
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।