গল্পকথায় ভজন দত্ত

হলুদ পলাশ

“ফাগুনের আগুনে পোড়ে কত কত জন , কে তার হিসেব রাখে।জীবনে শালা কত কত ফাগুন বিফলে গেল কেই বা তার খতিয়ান রাখে ! ফাগুনের আগুনে হিয়া জ্বলে রে !”
আরে গুরু, রাখে রাখে ,কত জনই তো রাখে ! আসলে রাখতে জানতি হয় । জীবনকে ঝিঙালালা বানাতে জানতি হয় । শালা,কংক্রিটের জঙ্গল ছেড়ে আসলি জঙ্গলে যা । আবে পুরো জঙ্গলি বনে যা ।আর জঙ্গলি বিল্লি ! মিয়াঁও মিয়াঁও… কথা কটা বলে একটু থামলো অনীশ ।
শেষ ফাগুনে সাড়ে ন’টায় পার্কস্ট্রীটের এই বারটাই এখন পুরো মাতাল হয়ে গেছে । রুদ্র ও অনীশের টেবিলের সামনে বসেই এক জোড়ি যা করছে , সেদিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুদ্র ছোট্ট ছোট্ট চুমু আঁকছে গ্লাসে ।
অনীশ বলে, এই রুদ্র তোর কি নেশা হয়ে গেছে ? ওরকম করে তাকায় কেউ ? এটা কি শালা মেট্রো ট্রেন ? অই, তোর জিভে জল এসে যাচ্ছে না কি বে ? শালা ! ভাড়ার যন্ত্র দেখেই লাল টপকাচ্ছিস ! এই, কী যেন ফাগুন, আগুন নিয়ে বলছিলি ? বল বল,বেশ রোমান্টিক রোমান্টিক লাগছে শুনতে । গ্লাসের তলানিটা গলায় ঝেড়ে নিয়ে অনীশ আবার বললো, হ্যাঁ রে, তুই কি আজকাল কাব্যি মারাচ্ছিস ? কবিতা লিখছিস ? তবে শোন ,হ্যাঁ রে রুদ্র , পলাশ, সত্যিকারের পলাশ দেখেছিস কোনোদিন ?
রুদ্র বলে, কি যে বলিস ? পলাশ দেখবো না ! গুনগুনিয়ে গায়, ‘কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপার…’
অনীশ একটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,থাক। ঢের হয়েছে তোকে আর এ জীবনে চাঁপায় চাপতে হবে না । চাপার রস খুব না ? হ্যাঁ রে,তো পলাশ দেখেছিস তো বললি । কিন্তু হলুদ পলাশ ! হলুদ পলাশ দেখেছিস কোনদিন কোথাও ?
রুদ্র ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,হলুদ পলাশ ?
অনীশ বললো ,হ্যাঁ রে,হলুদ পলাশ । আর দাঁড়া , তার সঙ্গে তোর জন্য একটা জঙ্গলি চাঁপার ব্যবস্থা করছি ।চল চল বিলটা মেটা । বাকি কথা পাখি রব করার আগেই , চল ,সব যেতে যেতে বলছি । এরই মাঝে মাইরি দেখ মিরচি আবার পাঁচ-পাঁচটি মিসকল মেরেছে ,সর্বনাশ ! তার ওপর শালা তোর জন্য আবার মাল খেতে হলো । বাওয়াল তো হবেই ।চল ওঠ,ওঠ , বিলটা মেটা ।বকি সব কথা তোকে যেতে যেতে বলছি।কিন্তু তোর আবার যা ড্যাশের অফিস ! শালা ছুটি চাইবি ফাগুনে ,পাবি বৈশাখে । কোনো মানে হয় ! ড্যাশের এই চাকরিটা ছাড় । অন্যকোনো কাজ খোঁজ।
রুদ্র-র চোখে এক অদ্ভুত ঘোর । হলুদ পলাশ ও কোনোদিন স্বচক্ষে দেখেনি ।জঙ্গলি চাঁপার সুবাসের সঙ্গে হলুদ পলাশের ককটেলের মজা এবার সে লুটবেই লুটবে, তা যেমন করেই হোক ।
##
ফাগুন পেরিয়ে, চৈত্র এসে গেল । অনীশ ঠিকই বলে ,’ ড্যাশের অফিস,ড্যাশের কাজ’ ।অনেক ধরাধরি করে পেয়েছে তিনদিনের ছুটি।
অনীশের করে দেওয়া ব্যবস্থায় অবশেষে রুদ্র ব্যাগপত্র গুছিয়ে চললো হলুদ পলাশ ও জঙ্গলি চাঁপার সন্ধানে।জঙ্গলের মধ্যেই একটি বাড়িতে ওর হোম স্টে। দু রাত ,তিন দিনের প্যাকেজ।
ওর যে বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানে থাকে একটি নিষ্পাপ মেয়ে ও তার বাবা।মেয়েটির নাম রিমলি।ওর বাবার নাম বুধুয়া। একটা দড়ির খাটিয়ায় রুদ্রর শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে ।তার ওপর ট্রাভেল কোম্পানির নির্দেশ মত,ওদের দেওয়া একটা তোষক ও সাদা চাদর পেতে দিয়েছে। একটা ঘরের ভিতরে তালপাতার তৈরি তালাই টাঙিয়ে জাস্ট একটা পার্টিশন করে আলাদা করা হয়েছে অতিথির বিছানা।সেই ঘরের মধ্যেই একপাশে কাঠে রান্না করা হয়।তার ঝুলকালি নেই একটুও।মাটির মেঝে গোবর দিয়ে নিকানো।উঠনো ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকটি মুরগি।এখানে স্বচ্ছ ভারতের শ্লোগান কেউ শোনে নি।তবুও কোথাও নোংরা নেই একটুও।কুসুম তেল লাগানো মুখ দুর্গা প্রতিমার মুখের মতই চকচক করছে রিমলির ।আকাশ তো রিমিল ।আর আকাশের সব রূপ রিমলির একার।
ঘরের ভিতর, বুধুয়া ও রুদ্র মাটিতে একটা তালাই পেতে বসে ।এখানে এসে থেকেই রুদ্রর চোখ রিমলির সারা শরীরে নির্লজ্জের মত এঁটে গেছে।
তা এড়ায়নি বাবার চোখ।
রুদ্র হলুদ পলাশের কথা তুলতেই বুধুয়া বললো –
ও হ! কটা দিন আগ্যে আল্যে নাই ! ফাগুনের শেষদিক্যে আল্যেও ই জঙ্গলের মাঝটতে তুমাকে গাদা গাদা হলুদ পলাশ ফুল দেখ্যাতে পারতম গ ।
পুকুর থেকে তুলে আনা নুন হলুূদ দিয়ে মেখে টাটকা শামুক ভাজা আর শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে নুন ও তেল দিয়ে মাখা চাট বানিয়ে দিয়েছিল রিমলি।তাই দিয়ে বুধুয়া ও রুদ্র হাঁড়িয়া খেতে খেতে গল্প করছিল।মাটির কলসিটা এখন প্রায় ফাঁকা।কাঁসার বাটির হাঁড়িয়াটা এক চুমুকে শেষ করে,পকেট থেকে রুমাল বের করে রুদ্র ঠোঁট মুছে নিয়ে বুধুয়াকে বললো , চলো চলো আপাতত দিনের আলোয় ঐ পলাশের গাছটাই দেখে আসি তারপর রাতে না হয় দেখবো ,গন্ধ নেবো জঙ্গলী চাঁপার। ঘোর নেশার চোখে রিমলির দিকে তাকিয়ে তর্জনীতে লেগে থাকা লঙ্কাপোড়ার চাট চাটতে চাটতে তাড়া দিল বুধুয়াকে, চলো চলো।ফুল নেই তো আর কী হবে ? গাছটাই দেখে আসি এখন। তারপর আপডেটটা মেরে দি ।পরের ফাগুনেই না হয় প্রাণ ভরে দেখবো হলুদ পলাশ।
রিমলির বাবা তালাই থেকে উঠতে গিয়ে একটু টাল খেলেও সামলে নিল নিজেকে।পরনের খাটো ধুতিটাকে আরো খাটো করে শক্ত করে বেঁধে নিল।চালে রাখা ছোট হাঁসুয়াটা কোমরে গুঁজে নিয়ে বললো , চল বাবু চল ।হামার সনে চল । ত বাবু একটু দূর আছে কিন্তুক ।তুমহি যাত্যে পারব্যে ত ?
রুদ্র টলতে টলতেই বললো,তাতে কী হয়েছে ? আমি ঠিক যেতে পারবো।
লোকটার গতিক দেখে রিমলির হাসি পেল ,তবুও সে হাসলো না ।তার জানা আছে এই সব শহুরে জানোয়ারদের।সবার নজর শুধু তার গতরে।রান্না করতে করতে মনে হয় বিষ দিয়ে দি ,দেয় না।দিতে পারে না। এই সব লোকগুলোকে সে পাত্তাই দেয় না । কিন্তু ওদের অভাবের সংসারে দুটো কাঁচা টাকা আসে তাই ভালো না লাগলেও ওরা বাপবেটিতে মেনে নিয়েছে এই ব্যবস্থা।এর মধ্যে আবার অনেক ভালো মানুষেরও দেখা যে তারা পেয়েছে সেটাও অস্বীকার করা যায় না।
রিমলি ভাবে।ভাবনা তো হয়ই। দুজনেই যে টলতে টলতে গেল ।
##
জঙ্গলের ঠিক মাঝখানে যে ঝিলটায় ঝর্ণার জল এসে জমা হয় সেই ঝিলটাতেই পরদিন সকালে রুদ্রর শরীরটা ভাসতে দেখা গেল।
রুদ্রর পরিবার ট্রাভেল এজেন্সি র নামে ,অনীশের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে । অনেক কষ্টে মিরচি অনীশের জামিন করিয়েছে। মামলার প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে জলে ডুবে মৃত্যু। পেটে পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত এলকোহল।পুলিশ তাই ঘটনাটি দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা, দুটোর সম্ভাবনা ধরে নিয়েই এগোচ্ছে ।

##

ই বচ্ছর ফাগুনটা সত্যি সত্যি আগুন লাগাই দিয়েছে।এত এত পলাশ কুনও বচ্ছর দেখা যায় নাই।পরকিতি মাতা এক্কেরে উপুড় করে দিয়েচে গ।

বুধুয়া কপালে হাত ঠেকিয়ে আকাশে একটা প্রণাম এঁকে দেয়।প্রকৃতির মতোই বুধুয়াদের পুরো গেরামটাই আনন্দে আত্মহারা । মেয়েরা সব মাথায় ফুলাম তেল দিয়ে টেনে খোঁপা করেছে। কপালে খড়িমাটির টিপ পরেছে।সকলের খোঁপায় গোঁজা একটা করে হলুদ পলাশ।হলুদ রংএ রাঙানো লালপাড় শাড়ি পরে সকলে এই জঙ্গলের প্রাচীন শালবৃক্ষটির তলায় সমবেত হয়েছে । দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মাদল,বাঁশির সুরে সমবেত সঙ্গীত ।
বুধুয়াদের জঙ্গলে, গাঁয়ে , এখন আর কোনো ট্রাভেল কোম্পানির পাঠানো টুরিস্ট আসে না । রিমলিদের আজ গণ বিবাহের পরব। ধিতাং ধিতাং,ধিতাং, ধিতাং…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।