• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

দেয়ালার দিন

বাস থেকে নেমেই দৌড়োতে দৌড়োতে হাসপাতালের দিকে ছুটলাম। বেডে শুয়ে আছে সুমি। দামি কাপড় পরা। কানে সোনার দুল। নাকে নোলক। হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডের অতো বড়ো ঘরটা লোকে লোকারণ্য।
আমি সুমিকে জিগ‍্যেস করলাম “কি হয়েছে সুমি?”
ও বললো “আমি বিষ খেয়েছি সেজদা।”
সর্বশক্তি দিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরে বললাম “সে কি, কেন?”
সুমি বললো, “আমি তোমাকে ভালবাসতাম সেজদা। তাই তোমার ভালোর জন্যে সরে গেলাম।”
রেগে উঠে বললাম “কি বলছিস সুমি তুই? ভালবাসতিস মানে? তুই যে আমায় সেজদা ডাকতিস। দাদাকে ভালবাসতে হয়? ছি!”
“ছি তো বলবেই। কিন্তু ভালবেসে ফেললে কি করব বলো?”
তুই যে আমার থেকে অনেকটা ছোটো। আমি যে তোকে ফ্রক পরা দেখেছি।
আমায় টেপফ্রক পরাও দেখেছ সেজদা। গ্রীষ্মের দুপুরে তোমাদের বাগান পাহারা দিতাম। তোমার কলেজের ক্লাস তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলে তুমি তোমাদের আম বাগান দেখতে আসতে। আমি কাঁচা আম কেটে নুন মাখিয়ে দিলে তুমি খেতে ভালবাসতে। মুখে অবশ্য রাগ দেখাতে। এত টক খেতে নেই। আমি বলতাম টক, তবু মিষ্টি, এর নাম কাঁচামিঠে। কাঁচাতেই এ আমের স্বাদ। পাকলে তেমন ভালো লাগে না।
হ‍্যাঁ মনে আছে। নিচু আমডালে চড়ে পা দোলাতিস।
হ‍্যাঁ সেজদা। বড্ড দুষ্টু ছিলাম। আমার বুকে চুপি চুপি কুঁড়ি উঠছিল। টেপফ্রকের আড়াল থেকে তুমি আমার আমকুমারী বুকের গোলাপি বৃন্ত দেখতে পেতে।
হ‍্যাঁ তুই যেন কি রকম ছেলে মানুষ ছিলি। বুঝতে পারতিস না আমি অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছিলাম।
ইস, কত যেন বড়ো একেবারে! সাত আট বছরের বড়ো বরকে গ্রাম ঘরে সমবয়সী ধরে।
না, আমি তোর থেকে অন্তত ন দশ বছরের বড় ছিলাম।
একদিন বলে ফেলেছিলে, সুমি, তুই টেপফ্রক পরে বাইরে ঘুরে বেড়াস কেন?
হ‍্যাঁ। তুই বড়ো হয়ে যাচ্ছিলি, টেপফ্রক পরে ঠিক করতিস না।
সুমি বলল, বাজে বোকো না সেজদা, আমার জামা কাপড় বেশি ছিল না। ছিঁড়ে ফেটে গেলে সেলাই করে চালাতাম।
ক‌ই, আমায় বলিস নি তো কোনো দিন?
ভালবাসার মানুষকে দু হাত তুলে সর্বস্ব দিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে সেজদা। কিন্তু মরে গেলেও ভিক্ষে চাওয়া যায় না।
আমার কাছে তোর কিছু চাওয়া মানে ভিক্ষে চাওয়া?
আমি তোমার কাছে থাকলে কোনো রকম লজ্জা সংকোচ পেতে ভুলে যেতাম সেজদা। খালি ইচ্ছে হত, কখন তুমি আমায় আদর করে স্পর্শ করবে। রুনিদিকে তুমি একদিন পড়িয়েছিলে, “চির চন্দন উরে হার না দেলা, সো অব নদী গিরি আঁতর ভেলা।” ওর মানেটা আজও মনে রেখেছি সেজদা। তোমার সাথে একটুও যাতে দূরত্ব না থাকে, আমার বুকের সবটুকু পরশ যাতে পাও, তাই বুকের আঁচল সরিয়ে রেখেছি, বুকে চন্দনটুকু মাখি নি, পাছে চন্দনের প্রলেপ সামান্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়, আর হারটুকুও পরি নি, একটুও দূরত্ব রাখতে চাই নি যার সাথে, সে আজ কত না দূরে!..
কিন্তু আমি তোকে কোনো দিন স্পর্শ করি নি।
জানি সেজদা। সেইজন্যে কোনো দিন একটু স্পর্শ পেলে তা আমি মাথায় করে নিতে চাইতাম। মেলায় গিয়ে একবার নাগরদোলা চাপিয়েছিলে। যে বীরপুরুষ তুমি! একপাক ঘুরতে না ঘুরতেই আমাকে আঁকড়ে ধরেছিলে।
রাগ করে বললাম তুই জানতিস নাগরদোলা চড়তে আমার ভয় করে। তবু তোর জেদে চড়তে হয়েছিল।
ওর গালে আলতো করে টোকা মেরে বললাম, তোর যে বিয়ের যোগাযোগ হচ্ছিল, তখনও তো কাউকে কিছু বলিস নি।
জিভটা সামান্য একটু বের করে সুমি আমাকে ভেংচি কেটে বললো, আহা, বললে যেন কি সুরাহা হতো আমার! তোমার রাজপুত্রের মতো ফরসা চেহারা। তায় এম এ পাশ করে স্কুল মাস্টার। তোমার সাথে আমার বিয়ে কেউ কি মেনে নিত?
তুই আমাকে ভালবেসে ফেললি কি করে?
তুমি যে রুনিদিকে পড়াতে আসতে। তুমি রুনিদিকে পড়াতে ভালবাসতে।
বাজে বকিস না সুমি। ও ডিসট‍্যান্স কোর্সে গ্র‍্যাজুয়েশন করবে বলল। আমি সাহায্য করতে রাজি হলাম।
আমি তোমার পড়ানো মন দিয়ে শুনতাম গো। ‘ঘর কৈনু বাহির বাহির কৈনু ঘর, পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।’ তুমি বলতে ‘এলাইয়া বেণী ফুলের গাঁথনি, দেখয়ে খসায়ে চুলি, হসিত বয়ানে চাহে মেঘপানে কী কহে দু হাত তুলি ….’ , পূর্ব রাগের কবিতা কী ভাল করে পড়াতে তুমি।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ না করতে করতেই রুনিদির বিয়ে হয়ে গেল। রুনিদির বাড়িতে আমি বাপ মা মরা মেয়েটি বড় হচ্ছিলাম। ওর বর বিডিও অফিসে কাজ করে দেখে সবাই বলল সরকারের ঘর থেকে কিছু দিয়ে থুয়ে আমার একটা হিল্লে হয়ে যাবে। আসলে আমি ছিলাম রুনির শ্বশুরবাড়ির বিনা মাইনের ঝি।
রুনিকে তুমি পড়াতে ভালবাসতে সেজদা। কিন্তু তুমি জানতে চাইলে না আমার পড়া হল না কেন? রুনি যে স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল, ওই স্কুলেই আমিও ক্লাস নাইনে পড়তাম। রুনির বর নতুন বিয়ে করে ব্লক অফিসের কাছে তোমাদের বাগান বাড়িতে আড়াইখানা ঘর ভাড়া নিল। তার ঘরে ব‍উয়ের সাথে ফাউ জুটলাম আমি। ওদের সংসারে পেট চুক্তিতে খাটবার ঝি। রুনির বর পঞ্চায়েত সমিতির এডুকেশন অফিসার হলে কি হবে, শিক্ষা ছাড়া ব্লকের আরো অনেক কাজে তাকে জড়িয়ে থাকতে হত। ব্লকের ছোটোখাটো অফিসাররা সব চাইতে বেশি যে কাজে ডুবে থাকত, তা হল ইলেকশন। সারা বছর ধরে ইলেকশন নিয়ে অজস্র রকম কাজ। ওই অফিসের কাজ সামলাতে রুনির বরের সবটুকু সময় আর মনোযোগ ক্ষয়ে যেত। রুনির আর পড়াশোনা করা সম্ভব কি না, সে নিয়ে তার ভাবার ফুরসৎ ছিল না। তুমিই রুনির মাথায় ঢোকালে যে ডিসট‍্যান্স কোর্সে ভর্তি হয়ে কলেজে না গিয়েও বেশ গ্র‍্যাজুয়েট হ‌ওয়া যায়। ব‌উ গ্র‍্যাজুয়েট হ‌ওয়া না হ‌ওয়া নিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির এডুকেশন অফিসারের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। যখন বেশ বোঝা গেল রুনি ফের পড়তে শুরু করলে তার দায় ঝক্কি নোটস যোগাড়ের কাজটা তুমিই সামলে দেবে, আর মেয়ে যতদূর পড়তে চায়, সে খরচ তার বাবা দেবেন, তখন পঞ্চায়েত সমিতির এডুকেশন অফিসার আপত্তির কোনো কারণ দেখলেন না। ঘরে রান্না করা, কাপড় কাচা আর বাসন মাজার সবটুকু দায়িত্ব ছিল আমার। কাজেই ব‍উয়ের পড়ার জন্য অফিসার বাবুর টাইমের ভাত না হবার আশঙ্কা ছিল না। তাছাড়া ব্লক টাউনে তোমাদের একলপ্তে অতোখানি জমির ওপর আম কাঁঠালের বাগান বলে দিত ব্লকে তোমরা একটা মান‍্যগণ‍্য লোক। রুনির বর কোনো কিছু লস না করে তোমাকে সন্তুষ্ট করবার সুযোগ হাতছাড়া করে নি। আমি যে বাড়িতে একটা কিশোরী মেয়ে একটা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছি, পরের বাড়িতে বেগার খাটছি, তা তোমার পর্যন্ত চোখে পড়ে নি সেজদা।
একটানা এতটা বলে সুমি যেন হাঁফাতে থাকে। আমি আমতা আমতা করে বলি, তুই তো কোনো দিন পড়ার জন্য জেদ করিস নি। তাহলে অন্তত মুক্ত বিদ‍্যালয়ে তোর একটা ব‍্যবস্থা করে দিতাম।
হ‍্যাঁ, সে কথা আর বোলো না। হেঁসেলের সব ঝক্কি আমি মাথায় নিয়েছিলাম বলেই রুনি পড়তে পেয়েছিল। আমি পড়লে সংসারটার লাটে ওঠা অফিসারবাবু সহ‍্য করতো না।
তুমি রুনিকে পড়াতে ‘রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর, প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতি অঙ্গ মোর, হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে, পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে.. ‘ , রুনি কতটা কী বুঝত জানি না, কিন্তু তুমি যখন বলতে, ‘কানুর পিরীতি চন্দনের রীতি, ঘষিতে সৌরভময়,’ আমি মাংস রান্নার জন্যে লবঙ্গ এলাচ দারুচিনি শিলে বাটতে বাটতে তোমার সাথে মনে মনে উচ্চারণ করে যেতাম। সে যেন শুধু উচ্চারণ নয়, সে যেন জপ। তুমি বলতে ‘হাথক দরপণ, মাথক ফুল,.. ‘ , বলতে ‘নয়নক অঞ্জন, গীমক হার, …’ তার প্রতিটি শব্দঝঙ্কার আমার সমস্ত চেতনা দিয়ে শুষে নিতাম। সন্ধ্যায় তুমি আসবে ভেবে রুনি কে প্রাণভরে সাজাতাম। নিজেও কাজল পরতাম খুব যত্ন নিয়ে। রুনি বলতো, “যাঃ তোর অমন সুন্দর কাজল কালো চোখ, তুই আর কাজল পরিস না, লোকজন হাবুডুবু খাবে।” বলতো বটে লোকজনের কথা, জানতো সে তোমাকে। তুমি আসার আগেই আমি বিকেলের সাজ ধুয়ে ফেলে কোমর বেঁধে সংসারের কাজে ডুব দিতাম। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে তোমার ভারি তেষ্টা পেত, রুনি নয়, আমি কাচের গ্লাসে জলটুকু নিয়ে না দাঁড়ালে তোমার চলত না। তুমি গ্লাস হাতে নেবার সময় ভারি আলতো একটা স্পর্শ দিতে। গ্লাস হাতে নিয়ে বলতে, মন গঙ্গার তোলা জল। আমি জানতাম, শেষের কবিতায় লাবণ্যের সাথে অমিতর শরীরী মিলন হয় নি। আমি মনে মনে বলতাম মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।
সুমির কথাগুলো আমার অসহ্য লাগছিল। মুখপুড়ি মেয়ে, তুই আমায় ভালবাসলি কেন বল?
সুমি ম্লান হেসে বললো, মনে আছে আজও, সেই প্রথম তোমার দর্শন পেয়েছিলাম। তুমি কোনো দিন বাড়িভাড়া চাইতে আসতে না। সে দপ্তর ছিল তোমার বড় জ‍্যাঠা মশায়ের হাতে। তুমি এলে বাগান দেখতে। এলে গোধূলি লগনে। আম পাকার গন্ধে সব কিছু মাতোয়ারা। তুমি এলে আম দেখতে। পরদিনই লোক লাগিয়ে আম পাড়ার কাজ। তুমি বলেছিলে বাগানের গাছ মুড়িয়ে সব ফল যেন বেচে দিয়ো না। পাখ পাখালি আর বাদুড়ের জন্যে কিছু রেখো। অমন সুন্দর করে কথা কেউ কোনোদিন বলে নি আমাকে। ফাঁকা নিরালা বাগানে তুমি বলেছিলে আমরা পৃথিবীতে আসার অনেক আগে থেকে পাখি আর বাদুড়েরা গাছে গাছে ফল খেতে অভ‍্যস্ত। ওদের বঞ্চিত করলে প্রকৃতি রুষ্ট হন। তুমি ফলের কথা বললে, প্রকৃতির কথা বললে। কী রকম করুণায় আর্দ্র হয়ে বলেছিলে তুমি। আমার চোখে তুমিই প্রথম পুরুষ হয়ে দেখা দিলে। আমার তখন বুক উঠেছে সবে। আমাদের কথা শুনতে পেয়ে রুনি আমার টেপ ফ্রকের ওপর একটা গামছা জড়িয়ে দিয়ে গেল। সহসা লজ্জা পেয়ে তুমি অন‍্যদিকে তাকিয়ে র‌ইলে।
তুমি ঘড়ি ধরে রুনিকে পড়াতে আসতে সেজদা। আমি তোমার জন্য জলখাবার বানিয়ে রাখতাম, কোনো দিন চিঁড়ের পোলাও, কোনো দিন সুজির মোহনভোগ। তুমি বেশ জানতে তোমার জন্য যত্ন করে কে খাবার বানায়। তুমি রাধার অভিসার পড়াতে গিয়ে গোবিন্দদাসের পদ বলতে “… কুল মরিযাদ কপাট উদ্ঘাটলু তাহে কাঠ কি বাধা..” বলতে “গাগরি বারি ঢারি করি পীছল চলতহি অঙ্গুলি চাপি …” আর রুনির বরের জন্যে পরোটা ভাজতে ভাজতে আমি মনে মনে অভিসারিকা হয়ে যেতাম। তুমি ছিলে দক্ষ অভিজ্ঞ মাষ্টার, তুমি জানতে পড়ুয়াকে হোমওয়ার্ক করতে দিতে হয়। কিন্তু সেই হোমওয়ার্কের খাতার লেখার আড়ালে লুকিয়ে থাকা মেয়েটাকে তুমি চিনতে না। তোমার তো জানার‌ই কথা নয় যে তোমার দেওয়া হোমটাস্কের উত্তর কে রুনিকে বলে দিত। নিস্তব্ধ দুপুরে আমাদের উঠোনে ঘুঘু দম্পতির ভালবাসা দেয়ানেয়া দেখতে দেখতে আমি তন্ময় হয়ে উত্তর বলে যেতাম আর রুনি সেই সব কথা দ্রুত হাতে লিখে নিত। তুমি এসে লেখা পড়ে আহ্লাদিত হতে। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে। রুনির তাতে একটু অস্বস্তিবোধ হত। ও যে জানত রান্না করতে করতেও আমার সবটুকু মন পড়া নিয়ে ব‍্যস্ত থাকে। কেবল তুমিই তলিয়ে দেখতে চাইতে না, প্রশ্ন করলে যে মেয়ের মুখে কথা ফোটে না, সে মেয়ে এত আঁতের কথা লেখে কি করে। তুমি জানতে গ্রামের স্কুলে ক্লাস নাইনে কদিন পড়া পড়া খেলা করে যে মেয়ে পরের বাড়ি হাঁড়ি ঠেলার কাজ করে, সে বাংলা অনার্সের পড়ার গভীরে ডুব দিতেই পারে না। তোমার সহজ পাটিগণিত তোমাকে ওইরকম বোঝালেও রুনি বেশ বুঝে গিয়েছিল যে খেলাটা বেশি টানা ঠিক হচ্ছে না। আমায় দিয়ে ওর হোম টাস্ক উৎরে গেলেও, ওর সংসারের খুঁটিনাটি আরাম আয়েশের ব‍্যবস্থা নিশ্চিত হলেও, আমাকে নিয়ে ওর চাপা অস্বস্তি ছিল।
আমার চোখে জল পড়তে থাকে। সুমি চোখ অন‍্য দিকে ফিরিয়ে থাকে। বলে, নিজের বিএ পরীক্ষাটুকু শেষ হতেই রুনি কোমর বেঁধে আমার বিদায়ের উদ্যোগ নিয়ে ছিল। দুবেলা লোকজন আমাকে দেখতে আসত। পাত্রের বয়স জানার দরকার নেই, ঠিক কী করে জানার দরকার নেই, নেশা করে কি না খোঁজ খবর নেবার দরকার নেই, রুনি আমার বাসাবদল করাবে বলে হন‍্যে হয়ে উঠেছিল। ওর পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতে আর ওর নোটসের প্রয়োজন ছিল না। অথচ তোমার পড়ানোর প্রতিটি বাক্য আমি প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন করে নেড়েচেড়ে দেখছি, অভিজ্ঞ জহুরী যেন দামি হীরে গাঢ় আনন্দে বারেবারে দ‍্যাখে ঘুরেফিরে, আমার সেই দশা। চলতে ফিরতে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নায়িকার গুণবর্ণনা করি, মাইকেলের কবিতা আবৃত্তি করি মন থেকে। রুনির হীনমন্যতাবোধ ওকে আমার দুর্মর স্মৃতির প্রতি ঈর্ষাকাতর করে দিত। একদিন রুনির বর বলে বসল রুনির সাথেই আমারও পরীক্ষায় বসে যাবার ব‍্যবস্থা করলে ভাল হত। তখনই রুনির মুখ নীলচে হয়ে গেল। ও বেশ বুঝতে পারছিল ওর অফিসার বর পর্যন্ত টের পায় আমার পড়াশুনা করার আগ্রহটা আমার আত্মার সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। সারা জীবনে এর আর বিচ্ছেদ নেই। আর ও ওর পাশটুকু করার প্রয়োজন বোধ থেকে রাগে জ্বলত। ও চাইছিল আমার একটা যে কোনো রকমে পরের বাড়ি যাবার ব‍্যবস্থা হোক। যারা মেয়ে দেখতে আসত, তারা সাহিত্য অনুরাগিণী খুঁজতে আসত না। মন নয়, চারটে হাত পা, আর খাঁজে খোঁজে পরিমাণ মতো মাংস আছে কিনা, সেই তাদের কাছে একটা মেয়ের পরিচয়।
আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, ওদের বাড়িতে গিয়ে আমায় ঝি হয়েই থাকতে হবে। কোথাও কোনো ভাবেই আমার কোনো সুরাহা হবে না। আমি কোনো পাত্রকেই মনে মনে পছন্দ করতে পারতাম না। বুঝতে পারতাম অপছন্দের মানুষের সাথে বিছানায় সহাবস্থান কি রকম জঘন্য। আমার মুখ দেখে পাত্রের বাড়ির লোকজন বেশ বুঝতে পারত, আমায় দিয়ে তাদের কাজ চলবে না। রুনি বুঝতে পারছিল একটার পর একটা যোগাযোগ আমার আগ্রহের অভাবে বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
এই সময়েই রুনির বরের মধ্যে কেমন একটা বেচাল লক্ষ্য করছিলাম। একদিন রুনির বর ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিল। তারপর সেই সুযোগে অঘোরে ঘুমাতে থাকা ব‌উকে বিছানায় ছেড়ে এসে রুনির বর আমার ছোট্ট ঘরের দরজা ঠেলতে থাকল। আমি ভেতর থেকে প্রাণপণে দরজা ঠেলে ঠেকিয়ে রাখলাম। সকাল হলে রান্না বসালাম না। অফিসারবাবু ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো ব‌উকে ঠেলে তুলতে পারছিল না। এদিকে আমাকেও কিছু বলতে পারছে না। এই অবস্থায় খানিকটা এদিক ওদিক ছটফট করে অফিস চলে গেল।
একটু বেলা বাড়লে রুনির ঘুমের ওষুধের ঘোর কেটে যেতে সে দেখল সাড়ে দশটা বেজে গেছে। রান্নাবান্নার চিহ্ন নেই। বুঝতে পারল, তার বর না খেয়েই অফিসে চলে গেছে। আমার ওপর সে তর্জন গর্জন শুরু করে দিল। আমি জবাবটুকু দিচ্ছিলাম না বলে একসময় কাঁদতে শুরু করল। আমি ওর কান্নাকাটিকেও কোনো গুরুত্ব দিলাম না। একটু ভদ্রস্থ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রুনি আমায় পিছু ডাকল, “ও সুমি, কোথায় যাস?” আমি শুনেও শুনলাম না। বিডিও অফিসে গিয়ে সোজা সাহেবের চেম্বারে ঢুকে পড়লাম। কোনো ভনিতা না করে তাঁকে বললাম, “আমার মাথা গুঁজে থাকার জায়গা নেই, আমার একটু কিছু ব‍্যবস্থা করে দিন।” উনি আমার চিনতে পেরেছিলেন। বললেন, “আপনি আমাদের এডুকেশন অফিসারের রিলেটিভ না?”
বললাম সত্যি কথাটা। “কি জানেন, আমি বিনা মাইনের ঝি। ইদানিং জামাইবাবুর রকম সকম মন্দ। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিন।” বেশ খেয়াল করলাম, বাইরের ক‍রিডর দিয়ে রুনির বর বার দুয়েক হেঁটে চলে গেল।
এদিক ওদিক অকারণ ঘুরে সময় কাটিয়ে সন্ধ্যা নামলে চুপি চুপি নিজের ঘরে ঢুকে দোর দেব, ভেবে রেখেছিলাম। ওরা কর্তা গিন্নি দুজন মিলে দরজায় পাহারা দিচ্ছিল। আমি বাড়ি ঢুকতেই রুনি আমার চুল ধরে টেনে জিজ্ঞেস করল আমি তার বরের বিরুদ্ধে বিডিও সাহেবের কাছে নালিশ করতে গিয়েছিলাম কি না। বললাম, “এখনো অভিযোগ করি নি, তবে কাল বেশি রাতে যা করেছে, আবার তেমন করলে হেস্তনেস্ত করব।”
নিজের সংসার টিঁকিয়ে রাখার দায়ে রুনি বলল, “তার চেয়ে গলায় দড়ি দে না, তোর নিজের বর জোটে না, অন‍্যের বরের দিকে লোভ!”
আমার সাংঘাতিক অভিমান হল। বেশি রাতে একটু সাজগোজ করে শেষবারের মতো তোমাকে স্মরণ করে আমি বিষ খেলাম।
আমি বললাম, খুব ভুল করে ফেলেছিস সুমি। অন‍্যায় করেছিস।
এমন সময় মুখে আঁচল দিয়ে ককিয়ে কেঁদে উঠে রুনি বলল, তুমি কার সাথে দেয়ালা করছ সেজদা, সুমি যে মরে গেছে!
নার্স ওর চোখের পাতা টেনে নামিয়ে দিল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।