• Uncategorized
  • 0

গল্পকথায় রাজদীপ ভট্টাচার্য

একটা শীতের ভোর

লাভপুর থেকে বোলপুর যাবার বাস ধরব। শীতের ভোরবেলা। গতকাল বিকেলে বাগসিনা থেকে বাসে উঠে রাতে এসে পৌঁছেছিলাম লাভপুর বিডিও অফিসে পিসেমশায়ের কোয়ার্টারে। বড়পিসি পরিমাণ মতো চাল, দেশি হাঁসের ডিম, আলু আর তেল-মশলাপাতি দিয়ে দিয়েছিলো সাথে। রাতে ডিমের ঝোল ভাত রেঁধে নিয়েছিলো বাবা। তাই খেয়ে অচেনা বিছানায় ঘুম। আজ সকাল সকাল উঠে আমাদের বোলপুর যাত্রা।
শীতের ভোরে মসৃণ কালো পিচপথ। চাপ চাপ কুয়াশা জমে আছে দূরের সবুজে। এই প্রথম রবিঠাকুরের দেশে যাবো। আমি তখন ক্লাস সিক্স। রবীন্দ্রনাথ ঠিক কি -কেমন-কবে এসব বোঝার বয়স হয়নি। রবীন্দ্রনাথ মানে তখন সহজপাঠ। মা-বাবার বিয়েতে পাওয়া সঞ্চয়িতার পাতায় ছবি। তবে ওই মানুষটা যে বেশ কেউকেটা এটা বুঝি। রাস্তার দুপাশে সোনাঝুরি গাছ। বিডিও অফিসের কোয়ার্টারগুলোর সামনে একসার ইউক্যালিপটাস। গা থেকে সদ্য বাকল উঠে যাওয়ায় সারা গায়ে সাদা সাদা ছোপ। আমি ঘুরেফিরে লম্বা শুকনো পাতা তুলে হাতে ঘষে অম্রুতাঞ্জনের ঘ্রাণ নিচ্ছি। চায়ের দোকানে উনুনে সবে আঁচ দিয়েছে। ঝকঝকে সকালে সাদা ধোঁয়া ঠিক জায়গা পাচ্ছে না। ঠান্ডা হাওয়ার ঝলক নিমেষে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে জাগতিক মালিন্য। এখান থেকে একটু হাঁটলেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। সে আমার ইতিপূর্বে দেখা হয়েছে। ফুল্লরার মেলায় গ্রামীণ জীবন, মাটির আনন্দ এসবও নিজের মতো করে উপভোগ করেছি। এবার শান্তিনিকেতনের পালা।
কাকার চা নামলো এতক্ষণে। কাচের গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা চা। সকালের প্রথম বাস আর অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আসবে। দুচারটে লরি, ছোটো গাড়ি মাঝেমাঝেই পিচরাস্তায় প্রবল গতিতে ছুটে যাচ্ছে। একপাল মুরগী দৌড়ে বেড়াচ্ছে পথে, দুপাশের ঝোপেঝাড়ে। খুঁটে খুঁটে খুঁজে নিচ্ছে খাবার, পোকামাকড়, শস্যকণা। দুরন্ত বাচ্ছাদের মতো রাস্তা পেরোচ্ছে। দেখে ভয় লাগছে আমারও। ঊর্ধ্বশ্বাস গাড়ির সাথে তাদের লুকোচুরি। বাড়িতে আমার তখন চা জোটে না, শুধু দুধ। তাই বাবার সাথে বোলপুর যাত্রায় এই চা খাবার সুযোগ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি বেশ। চুমুক দিচ্ছি আর মুরগীগুলোর ছটফটানি দেখছি।
ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে বাবা। চা শেষ। এবার বাস আসার সময় হয়ে গেছে। ততক্ষণে চায়ের দোকানে এসে ভিড় করেছে আরও কিছু গ্রাম্য মানুষ। তারাও বাস ধরবে। অনেক দূরে বাসের আবছা ছায়া যেন দেখা যাচ্ছে। বাতাসে উড়ে আসছে হর্ণের গুঁড়ো গুঁড়ো আওয়াজ। তাই দেখেশুনেই দু-চারজন নিশ্চিত হয়ে গেল আজ ফার্স্ট ট্রিপে আসছে ‘সহদেব’। বাসেরও এমন নাম হয় জানতাম না। একটা ছোটো গাড়ির পিছনেই আমাদের লজঝড়ে বাস। বাবা একহাতে ব্যাগ নিয়ে আরেক হাতে আমাকে ধরে আছে। মুরগীগুলো তীর বেগে পেরোচ্ছে, ছোটো ম্যাটাডোরের চাকার ফাঁক দিয়ে গলে যাচ্ছে। এ খেলা আগেও দেখেছি বারবার। ভয় পেয়েছি প্রথম প্রথম। প্রতিবারই গাড়ি চলে গেলে অক্ষত পাখিগুলোকে দেখে দেখে একসময় প্রত্যয় জন্মেছে। এ এক মরণপন খেলা। তবু মৃত্যুর আশঙ্কা সরিয়ে রাখতে পারলে তাও থ্রিলিং হয়ে ওঠে।
ম্যাটাডোর পেরিয়ে গেলেই বাস এসে দাঁড়াবে। বাবা হাত টেনে রেখেছে। আমার চোখ তখনো পড়ে আছে রাস্তায়। গাড়ি চকিতে সরে যেতেই একঝলকে দেখলাম মসৃণ পিচের গায়ে লেগে রয়েছে রক্ত-মাংস-পালকের একটি মলিন প্রলেপ। ধক্ করে বুকে এসে ধাক্কা লাগলো। বাস হর্ণ মারছে। বাবা হাত ধরে টেনে বাসে তুলছে আমায়। আমার চোখে ভাসছে এতক্ষণ মুরগীগুলোর ছুটোছুটি, ছটফটানি। ওর সঙ্গী-সাথীরা কি এতক্ষণে রাস্তার ওপারে পৌঁছে তাকিয়ে দেখছে একদৃষ্টে?
কষ্ট হচ্ছে। আমিও যেন মৃত পাখির এক বন্ধু। ওর পাশে পাশে এতক্ষণ পথে পথে নেচে বেড়িয়েছি। শীতের ঝকঝকে ভোরে সবুজ সোনাঝুরির পাতায় থই থই করছে সোনালী রোদ্দুর। তারই মাঝে মসীকৃষ্ণ পিচ পথের উপর লেগে আছে কালচে রক্ত, মাংস, রঙিন পালক এবং নিস্তব্ধ মৃত্যু। যেন ঝড়ের মতোই তার আসা, বিদ্যুতের মতো যাওয়া। জাগতিক তাড়না, অহং, সব দুরন্তপনা একনিমেষে স্তব্ধ করে আবার মাটিতেই ফিরিয়ে দেওয়া! এভাবেই সেদিন এক শীতের ভোরে সহসা আমার কাছে জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে গেল পৃথিবীর এহেন গূঢ় রহস্য।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।